ছন্দ ও কবিতার পাঠ –১৪ - মাত্রা বা কলা
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি খলিলুর রহমান  মহাশয়কে।        
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
১১) ছন্দের উপাদান - ধ্বনি (বর্ণ,শব্দ)
১২) সিলেবল বা অক্ষর বা দল  
১৩) অক্ষরের শ্রেণিবিভাগ (মুক্ত ও রুদ্ধ)
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়-  ১৪) মাত্রা বা কলা
------------------------------------------------------------------------------
কাব্যসাহিত্যে 'ছন্দ' সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে আগে ‘মাত্রা'-র ধারণা থাকা প্রয়োজন। 'ছন্দ' জানতে হলে খুব ভালোভাবে 'মাত্রা' বুঝে নিতে হবে। মূলত এই 'মাত্রা'-র ভিন্নতাই বাংলা ছন্দগুলোর ভিত্তি। কাব্যে গতির সমতা রক্ষাকে 'মাত্রা' বলে। মাত্রা সময় নিরূপক নির্দেশনা। কোন অক্ষরে কত সময় স্বর অবস্থান করবে, 'মাত্রা'-য় তা উল্লেখ থাকে। আবৃত্তির ক্ষেত্রেও মাত্রা অপরিহার্য। বিভিন্ন ছন্দে মাত্রাগণনার রীতি বিভিন্ন ছন্দের আলোচনায় পরে উল্লেখ করা হবে।
     একটি 'অক্ষর' উচ্চারণ করতে যে সময় লাগে, সেই সময়টুকুকে বলে 'মাত্রা' বা 'কলা'। 'মাত্রা' হল অক্ষর পরিমাপের একক। যেমন- 'আমরা' শব্দে অক্ষর আছে দু'টি। 'আম', 'রা'।এই 'আম', 'রা' উচ্চারণে যে সময় লেগেছে তাই হল 'মাত্রা' বা 'কলা'।
      'মাত্রা' দু' শ্রেণির। একমাত্রা ও দুইমাত্রা।
ক) একটি অপ্রসারিত বা মুক্ত অক্ষর উচ্চারণ করতে সাধারণত যে সময় লাগে, তকে ধরা হয় 'একমাত্রা'।
খ) একটি প্রসারিত বা রুদ্ধ অক্ষর উচ্চারণ করতে সাধারণত যে সময় লাগে, তাকে ধরা হয় 'দুইমাত্রা'।
যেমন- 'সকল' শব্দে দুটি অক্ষর 'স', 'কল'। ধীরভাবে লক্ষ করলে জানা যাবে 'স' উচ্চারণে যে সময় লাগছে 'কল' উচ্চারণে তার থেকে বেশি সময় লাগছে। 'স' মুক্ত অক্ষর, এর উচ্চারণ স্বাভাবিক ও অপ্রসারিত। এর উচ্চারণে ব্যয়িত সময়কে ধরছি 'একমাত্রা'। কিন্তু 'কল' হল রুদ্ধ অক্ষর। এর উচ্চারণে স্বাভাবিক সময় থেকে একটু বেশি সময় লাগছে। তাই এখানে 'দুইমাত্রা' ধরা হচ্ছে। সময়ের পরিমাণ মাত্রা দিয়েই বোঝানো হয়। সঙ্গীতে যেমন : ধা। ধিন। ধিন। ধা। =৪ মাত্রা। তেমনি কাব্যে, ছিপ।খান।তিন।দাঁড়।তিন।জন।মাল।লা । = ৮ মাত্রা । অর্থাৎ একটি অক্ষর উচ্চারণে যে সময় প্রয়োজন হয়, তাকে 'মাত্রা' বলে। বাংলায় এই মাত্রাসংখ্যা নির্দিষ্ট নয়, এক এক ছন্দে এক এক অক্ষরের মাত্রাসংখ্যা এক এক রকম হয়।
       এবার বিস্তারিতভাবে 'মাত্রা' বা 'কলা' বিষয়ে জেনে নিই।
সোজাকথায়, মাত্রা মানে পরিমাপক অর্থাৎ 'ইউনিট অফ মেজার'। জল যেমন মাপি লিটারে, কাপড় যেমন মাপি মিটারে আর ছন্দ তেমন মাপি মাত্রায়। কবিতার এক-একটি পঙক্তির মধ্যে যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে, এবং তাকে উচ্চারণ করার জন্য মোট যে সময় আমরা নিয়ে থাকি, সেই উচ্চারণকালের ক্ষুদ্রতম এক-একটা অংশই হল 'মাত্রা'। প্রবোধচন্দ্র সেন তারই নাম দিয়েছেন 'কলা'। 'কলা' মানে এখানে অংশ। ষোলো কলায় যেভাবে চাঁদ পূর্ণ হয়, তেমনি 'কলা' বা 'মাত্রা'-র সমষ্টি দিয়ে তৈরি হয় পূর্ণ এক-একটি পঙক্তি।
      তাই, 'মাত্রা' হচ্ছে যে কোনো জিনিসের পরিমাপক। ভারসাম্য রেখে কথা না বললে আমরা বলি, কথার 'মাত্রাজ্ঞান' নেই। কেউ কাজ কর্মে বেয়াড়া আচরণ করলে বলি, সে 'মাত্রা' ছাড়িয়ে গেছে। সতর্ক করার জন্যে আমরা বলি, কখনও 'মাত্রা' অতিক্রম করা ভালো নয়। বাচ্চার গায়ে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে আমরা বলি, শিশুটির   'মাত্রাতিরিক্ত' জ্বর এসেছে। এই মাত্রা কথাটার মধ্যে একটা ভারসাম্যপূর্ণ রীতিনীতি ও পরিমাপকের কথা বলা হয়ে থাকে। ছড়া বা কবিতায় 'মাত্রা' বলতে অক্ষরের ন্যূনতম সময়কালকে বোঝানো হয়। অর্থাৎ একটি অক্ষরের বা Syllable -এর ন্যূনতম যে সময়টুকু প্রয়োজন হয়- সেটাই 'মাত্রা'। যেমন- 'মালিনী' - এখানে তিনটি মুক্তাক্ষর আছে। প্রতিটি অক্ষরই একমাত্রা বিশিষ্ট হয়েছে।


***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১)  বাংলা ছন্দের সহজপাঠ – সত্রাজিৎ গোস্বামী, কলকাতা।  
----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করুন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানিয়ে লেখাটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবেন।