ছন্দ ও কবিতার পাঠ –২৬ – বিষয়ঃ ছড়া
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি মোঃ সানাউল্লাহ মহাশয়কে।            
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়-  <পর্ব-৩, ভাগ-২৬> বিষয়ঃ ছড়া
------------------------------------------------------------------------------
'ছড়া' মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ঝংকারময় একপ্রকার পদ্য বিশেষ। এটি সাধারণত স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত হয়। তবে মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তেও এর নমুনা মেলে। এটি সাহিত্যের একটি প্রচীন ধারা বা শাখা। যিনি ছড়া লেখেন তাকে 'ছড়াকার' বলা হয়। ‘ছেলেভুলানো ছড়া’, ‘ঘুম পাড়ানিয়া ছড়া’ ইত্যাদি ছড়া দীর্ঘকাল যাবৎ আমাদের শিশুসাহিত্যে প্রচলিত আছে। প্রাচীনকাল থেকে ইংরেজি ভাষায় 'ননসেন্স রাইম' প্রচলিত রয়েছে। কারণ ছড়ার প্রধান দাবী ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকার, অর্থময়তা নয়।
প্রাচীন যুগে ‘ছড়া’ সাহিত্যের মর্যাদা না পেলেও বর্তমানে সে তার প্রাপ্যসম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এখনও অনেকেই ছড়াসাহিত্যকে শিশুসাহিত্যেরই একটি ধারা বা শাখা বলে মনে করেন কিংবা সাহিত্যের মূলধারায় ছড়াকে স্বীকৃতি দিতে চান না। কেউ কেউ ছড়াকে কবিতা বলার পাশাপাশি আধুনিক গদ্যকবিতার যুগে এসব মিলযুক্ত কবিতা (অন্ত্যমিল) বা পদ্যের অবস্থানকে হালকা করে দেখেন।


ছড়ার ইতিহাসঃ
ছড়ার রয়েছে প্রায় দেড়হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে ছড়ার এই বিকাশ ও উৎকর্ষ আমাদের বারবার চোখে পড়ছে। আদিতে সাহিত্য রচিত হত মুখেমুখে এবং ছড়া-ই ছিল সাহিত্যের প্রথম শাখা বা সৃষ্টি। সাহিত্য লেখ্যরূপে পাওয়ার পূর্বে ছড়ায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করত। লোকসমাজে ছড়া-ই ছিল ভাবপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। গদ্যসাহিত্যের আগে তাই কেউ কেউ ছড়াকে লৌকিকসাহিত্য বলে বিবেচিত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন—'ছড়া শিশুদের খেলামেলার কাব্য'। আধুনিক সাহিত্যিকগণ এসব অভিধান মানতে নারাজ। তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—ছড়া সাহিত্যের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের মতো একটি প্রয়োজনীয় শাখা। এই শাখাটি অন্যান্য শাখার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্যতা সহজেই ধরা পড়ে।


ছড়ার প্রকারঃ
ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তার 'লোকসাহিত্য' গ্রন্থে ছড়াকে লৌকিক ছড়া, সাহিত্যিক ছড়া ও আধুনিক ছড়া—এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এছাড়াও ছড়াকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা হয়। যেমন- শিশুতোষ ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া, ছড়ার ছন্দাশ্রিত কিশোর কবিতা প্রভৃতি। এর মধ্যে শিশুতোষ ছড়া তৈরি হয় কেবলমাত্র শিশু-মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে।


বাংলাসাহিত্যে ছড়া-
বাংলাসাহিত্যের আদিসৃষ্টি বা নিদর্শন চর্যাগীতির প্রথম পদটি ছড়ার মূলছন্দ স্বরবৃত্তে লেখা এবং এটি ছন্দ-মিলে রচিত। এই পদটি বাংলাসাহিত্যের আদিছড়া বললেও ভুল হবে না। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার লৌকিক ছড়াকে প্রথম গ্রন্থভুক্ত করেন এবং গ্রন্থটির নাম দেন 'খুকুমণির ছড়া' এই গ্রন্থটির ভূমিকায় সর্বপ্রথম রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থে সুকুমার রায়ের ছড়া সংকলিত করে ছড়ার গ্রহণযোগ্যতাকে মজবুত করেন। ছড়াপ্রসঙ্গে কবিগুরু বলেছেন, ‘সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা অর্থেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মধ্যে। সেইজন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।’ একসময় ছড়াকে মনে করা হত শুধুই শিশুসাহিত্য। তবে এখন আর তা মনে করা হয় না, বাংলাসাহিত্যে ছড়া তাঁর নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।


বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত ছড়াকারদের তালিকা
অন্নদাশঙ্কর রায়, আবু সালেহ ,আবু হাসান শাহরিয়ার, আমীরুল ইসলাম, আল মাহমুদ, অনিরুদ্ধ আলম, আসাদ বিন হাফিজ, আহসান হাবীব, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, এখলাসউদ্দিন আহমদ, খালেক বিন জয়েন উদ্দীন, দীননাথ মণ্ডল, ফররুখ আহমদ, ফয়েজ আহমেদ, মোহাম্মদ নাসির আলী, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, রফিকুল হক, রোকনুজ্জামান খান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাশেদ রউফ, লুৎফর রহমান রিটন, শাহাবুদ্দীন নাগরী, সত্যজিৎ রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার বড়ুয়া, সুকুমার রায়, সুব্রত বড়ুয়া, সেজান মাহমুদ প্রমুখ।


ছড়ায় যে বিষয়গুলো লক্ষণীয়:
মিলনান্তিক ছন্দোবদ্ধ ভাবের প্রকাশ।
এতে হালকা বা চটুল চাল থাকবে।
চারপাশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংঘটিত অসংগতিগুলোর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ কৌতুক বা কটাক্ষের মাধ্যমে উদ্ভট বা নাটকীয় উপস্থাপিত হবে।
ছড়ার বিষয় হতে পারে ব্যক্তিক বা সামাজিক বা বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে।
ক্ষোভ, কষ্ট বা অন্য কোন তীব্র অনুভূতির আভাস থাকবে।
স্বরবৃত্ত ছন্দকে বলা হয়ে থাকে ছড়ার ছন্দ।

আধুনিক ছড়া’ বৈশিষ্ট্য-
ছড়া বাংলা সাহিত্যে এক বড়ো অংশ জুড়ে বিরজমান। ছড়া অনেকেই লেখেন। কিন্তু অনেকে আধুনিক ছড়ার বৈশিষ্ট্যগুলি জানেন না।
আধুনিক ছড়া’র অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে সেগুলোকে সংক্ষেপে উপস্থাপন করেন এভাবে-
১. ছড়ায় যুক্তিসঙ্গত বা বিশিষ্ট ভাব কিংবা ভাবের পারম্পর্য নেই।
২. ছড়ায় ঘটনার ধারাবাহিকতা বা আনুপূর্বিক কাহিনি থাকে না।
৩. ছড়া ধ্বনিপ্রধান, সুরাশ্রয়ী।
৪. ছড়ায় রস ও চিত্র আছে, তত্ত্ব ও উপদেশ নেই।
৫. ছড়ার ছন্দ শ্বাসাঘাত প্রধান প্রাকৃত বাংলা ছন্দ।
৬. ছড়া বাহুল্যবর্জিত, দৃঢ়বদ্ধ ও সংক্ষিপ্ত।
৭. ছড়ার ভাষা লঘু ও চপল।
৮. ছড়ার রস তীব্র ও গাঢ় নয়, স্নিগ্ধ ও সরস।
আলোচিত মতামতগুলোর ভিত্তিতে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। যেমন:
ক) ছড়া ও সঙ্গীতের পার্থক্য:
১. ছড়া আবৃত্তি বা ধ্বনিনির্ভর। অন্যদিকে সঙ্গীত তাল ও সুর নির্ভর।
২. ছড়ার সুর একটানা বৈচিত্র্যহীন। অন্যদিকে সঙ্গীতের সুর বিচিত্র বা বৈচিত্র্যময়।
খ) ছড়া ও শিশু-কবিতার পার্থক্য:
১. ছড়ার বিষয়বস্তু উদ্ভট, অসঙ্গত। শিশু-কবিতার বিষয়বস্তু সাধারণত সুসঙ্গত হয়ে থাকে।
২. ছড়ার আকার হ্রস্ব। শিশু-কবিতার আকার দীর্ঘও হয়ে থাকে।
৩. ছড়ার ছন্দ শ্বাসাঘাত প্রধান প্রাকৃত বাংলা ছন্দ অর্থাৎ স্বরবৃত্ত। কিন্তু শিশু-কবিতার যে কোন ছন্দ হতে পারে।
৪. ছড়ার পরিণতি আকস্মিক। অন্যদিকে শিশু-কবিতার পরিণতি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত।
৫. তবে পদ্য (কবিতা) এবং ছড়ার মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে- পদ্যের বক্তব্য সহজবোধ্য ও স্পষ্ট হলেও কিন্তু ছড়ায় রহস্যময়তা থাকে।


***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) ছড়া’র গাঁঠছড়াটা খুলবে কে ? -রণদীপম বসু  
                   ২) উইকিপিডিয়া
                   ৩) ছড়া- গোলাম মাওলা আকাশ
----------------------------------------------------------------------------
আসরের কবিদের কাছে আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করুন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানাবেন।