কবি-কবি ভাব ছন্দের অভাব (ছন্দ ও কবিতার পাঠ) –দুইঃ কবিতা ও ছন্দ
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস


------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি অজিতকুমার কর মহাশয়কে।
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
১) ছন্দ, ছন্দময়তা ও ছন্দপতন
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়-  ২) কবিতা ও ছন্দ
------------------------------------------------------------------------------
      কবিতার সাথে ছন্দের সম্পর্ক আবশ্যিক ও চিরকালীন। ছন্দ ছাড়া কবিতাকে কখনই আমরা ভাবতে পারি না। আবার একটি কবিতার উৎকৃষ্টমানের জন্য ছন্দ একমাত্র উপজীব্য না হলেও এটি যে প্রধানতম এবং অন্যতম একটি দিক তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যে কোনো ভাষার শিল্পসাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল কবিতা ও গান। সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই তাল-লয়-সুর ইত্যাদির সংমিশ্রণে ভাষার মালা হয়ে মানুষের মনে দোলা দিয়ে আসছে এই নানা জাতীয় কবিতা ও গান। অক্ষর ও শব্দের বিভিন্ন দোলায় এই মালা তৈরির প্রক্রিয়া চলে। এই ছন্দ প্রক্রিয়াই কবিতাকে সমৃদ্ধ করে। কবিতার সাথে ছন্দের এই নিবিড় ছোঁয়া কবিতার বাণীকে সহজেই পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়। উৎকৃষ্ট কবিতা নির্মাণের জন্য বিভিন্নভাবে নানা সময়ে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রায় সব ভাষার বিশিষ্ট কবি ও গবেষকেরা তৈরি করেছেন সুনির্দিষ্ট ও সুবিন্যস্ত নিয়ম। এখানে বলে রাখা ভালো এই নিয়ম তৈরির আগে কানে শুনে ছন্দ ঠিক করা হত। সে আলোচনায় পরে আসব। বাংলা কবিতাকেও অন্যান্য ভাষায় রচিত কবিতার মতো বাঁধা হয়েছে ছন্দের এই নিপুণ শৃঙ্খলে।
       কোনো মসৃণপথে গাড়ি চালিয়ে যেতে সবার কত আরামবোধ হয়।  কিন্তু বন্ধুর ও অসমতল রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে সেই সুখ পাওয়া যায় না। সব সময় একটি আতঙ্ক মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করে। কবিতাও ঠিক তাই। যে কবিতা বা ছড়ায় ছন্দ যত নিখুঁত তা আনন্দও দেয় প্রচুর, আর যার ছন্দ নেই–তা পড়লেই মন বিগড়ে যায়! তা আর কিছু সময় পরে মনে থাকে না। সেগুলিকে নাটকের সংলাপ বলে মনে হয়। কিন্তু ছোটোবেলায় পাঠ করা কত ছন্দোবদ্ধ কবিতা আমাদের মনে যেন চিরদিনের জন্য খোদাই হয়ে আছে।
      এই আলোচনা শুরুর জন্য ইট তৈরির কথাতে আসা যাক। আমরা সবাই কমবেশি ইট তৈরি হতে দেখেছি। ইট তৈরিতে প্রথমেই প্রয়োজন হয় ভালো মাটির। সেই মাটিতে জল মিশিয়ে হাত বা মেশিনের সাহায্যে সেই মাটি নরম করার প্রয়োজন হয়। তারপর সেই নরম মাটিকে একটি নির্দিষ্ট ফর্মার (কাঠের তৈরি ছাঁচ) মধ্যে ফেলা হয়। ফর্মায় মাটি ঠিকমতো রাখতে পারলেই সেই মাটি আর মাটি থাকে না, তা ইটে পরিণত হয়। এখানেই শেষ নয়, এই নরম ইটকে কয়েকদিন ধরে আগুনে পোড়ানো হয়। এবার ভালোমানের ব্যবহার উপযোগী ইট পাওয়া যায়। লক্ষণীয় যে, নরম মাটিকে হাত দিয়ে পিটিয়ে বা অল্প পরিশ্রমে ইটের রূপ দেওয়া যায় না। দরকার একটি নির্দিষ্ট ফর্মা যা কিনা মাটিকে সুন্দর একটি ইটের আকার দিতে পারে। অনেকে বলে থাকেন কবিতা মনের আবেগ মিশিয়ে লেখা হয়, তখন আর কোনো কিছু মেনে চলা সম্ভব নয়। সেখানে ছন্দ কোনো কাজে আসে না বা দরকার নেই। আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে বাড়ির দেওয়াল গাঁথা দেখে থাকব। সেখানে রাজমিস্ত্রি যদি মনের আনন্দ আর আবেগে দেওয়াল গেঁথে যায়, তা কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ভেঙে পড়বে। দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাই রাজমিস্ত্রি দেওয়াল গাঁথার আগে দুই প্রান্তে একটি দড়ি টানিয়ে নেন। বালি, সিমেন্ট ঠিকঠাক মেখে নেন। নির্দিষ্ট দূরত্বে ইট সাজান। তার মাঝে আবার সিমেন্ট মাখা দিয়ে দেন। আবার পরের লাইনে যাবার আগে দড়ি টানান। এইভাবে তার গাঁথা চলে। তারপর সেই কাঁচা দেওয়াল পুনরায় পর্যবেক্ষণ করেন। কোনো ত্রুটি আছে কি না দেখেন। অতিরিক্ত সিমেন্ট-বালি তিনি ঝাটা দিয়ে ফেলে দেন। তার কিছুদিন পর প্লাস্টার করে দেন। তাই দেওয়াল দীর্ঘস্থায়ী হয়। কবিতাও ঠিক তাই। একে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে এমন ভাবে দড়ি টানিয়ে অঙ্কের নিয়মে এগুতে হবে। তাহলে সেই কবিতা হবে দীর্ঘস্থায়ী। ঘরে ঘরে যে পাঁচালি বই, বা ধর্মগ্রন্থ আছে তা এই গাঁথনির জন্য আজও টিকে আছে। এই গাঁথনি হল কবিতার ছন্দ।
      কবিতার প্রসঙ্গেও একইরকম ভাবে বলা যায়, প্রথমেই প্রয়োজন হয় সুন্দর একটা বিষয় নির্বাচন। তারপর বিষয় ও শব্দের একত্র মেলবন্ধনে গঠিত হয় কবিতার ভাব, যা ইট তৈরির আগেকার ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করে। এখন প্রয়োজন ফর্মার। কবিতার ক্ষেত্রে এই ফর্মাই হল ছন্দ। বিষয় এবং শব্দকে যদি নির্দিষ্ট ছন্দের মধ্যে গ্রন্থিত করা যায় তবে অন্তত তাপ দেবার আগে কাঁচা ইটের মতো মোটামুটি একটা কবিতা দাঁড়িয়ে যায়। তারপর একে উৎকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজন হয় নানা উপমা, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প ইত্যাদি। তাই, প্রথমে অন্তত সাধারণভাবে একটা কবিতা প্রস্তুত করার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয় দিকের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যিক।
      প্রখ্যাত ইংরেজ কবি কোলরিজ গদ্য আর পদ্যের একটি যথার্থ সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন গদ্য হল “words in the best order “ অর্থাৎ শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস হল গদ্য। আর অপরদিকে পদ্য হল “best words in the best order “  অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস হল পদ্য। এ  থেকে সহজেই গদ্য আর পদ্যের পার্থক্য করা যায়। ফুলের সাথে ফুল গেঁথে মালা তৈরি হয় আর শব্দের সাথে শব্দ দিয়ে তৈরি হয় কবিতা। ভালো মানের মালা গাঁথতে হলে ভালো ফুল চাই। ভালো মালা গাঁথতে হলে ফুলের পাশে ভালো ফুল   দেওয়া উচিৎ। ঠিক ছন্দ এভাবেই কবিতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পদ্য হোক আর গদ্য হোক উভয় ক্ষেত্রেই ছন্দের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যিক।
       কোনো কবিতা বা গান শুনতে শুনতে আমরা আনন্দে মেতে উঠি। সেই গান বা কবিতায় হঠাৎ যদি সুর-তাল-লয়ের মধ্যে কোথাও বিঘ্ন ঘটে তাহলে সেই ছন্দ অনুভূত হয় না। ফলে ছন্দের আনন্দ থেকে পাঠক বা শ্রোতা বঞ্চিত হয়। ধরা যাক, কোনো সুনির্দিষ্ট রাগে কোনো নির্দিষ্ট তালে তবলচি তবলা বাজাচ্ছেন এবং গায়ক গেয়ে চলেছেন। হঠাৎ তবলচি উল্টোপাল্টা বাজাতে শুরু করলে গায়কের পক্ষে আর গান গাওয়া সম্ভব হবে না। কারণ সেক্ষেত্রে তাল কেটে ছন্দের বিঘ্ন ঘটবে। সেই বিখ্যাত গান আমাদের মনে আছে।
"কাহারবা নয় দাদরা বাজাও
উল্টোপাল্টা মারছো চাটি
শশীকান্ত তুমিই দেখছি
আসরটাকে করবে মাটি।"
তাই বলা চলে কবিতার সাথে ছন্দের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাকে বাদ দিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করা বোধ হয় ঠিক নয়। আমরা কবিতা বলতে ছন্দকে, আর ছন্দ বলতে কবিতাকেই বুঝব।


***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
----------------------------------------------------------------------------
উৎস/ ঋণস্বীকার- ছন্দের সহজপাঠ- সুজন বড়ুয়া, ঢাকা।
----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ ছোটোবেলায় পাঠ করেছেন বা কোনো শ্রেণিতে পড়েছেন, এমন কোনো কবির কোনো একটি কবিতার নাম এখানে লিখুন। সম্ভব হলে কয়েক পঙক্তি।
----------------------------------------------------------------------------
***বিঃদ্রঃ এই আলোচনা যে সবার ভালো লাগবে তেমন নয়। যাদের এই ছন্দ নিয়ে আলোচনা পছন্দ নয়, তারা অনুগ্রহ করে দূরে থাকতে পারেন। যারা ছন্দ ভালোবাসেন ও শিখতে চান এই আলোচনা মূলত তাদের জন্য। তারা উত্সাহমূলক ও গঠনমূলক মন্তব্য দিয়ে আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবেন।