কবি-কবি ভাব ছন্দের অভাব (ছন্দ ও কবিতার পাঠ) –চারঃ রবীন্দ্রকবিতায় ছন্দ
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি সৌমেন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে।  
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
১) ছন্দ, ছন্দময়তা ও ছন্দপতন  
২) কবিতা ও ছন্দ
৩) ছন্দের সংজ্ঞা
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়-  ৪) রবীন্দ্রকবিতায় ছন্দ
------------------------------------------------------------------------------
        আলোচনার পাতায় যখন এই 'ছন্দ' নিয়ে আলোচনা শুরু করি, তখন অনেক বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ কবিজন বলতে শুরু করলেন কবিতার আবার ছন্দ কী! কবিতা মনের আবেগ! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি ছন্দ মেনে লিখেছেন! ইত্যাদি। আজ তাই অনেকের অবগতির জন্য কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কতটা ছন্দ মেনে ও বুঝে লিখেছেন সে কথা তাঁর লেখনী থেকেই জেনে নিই।
১) 'সন্ধ্যাসংগীত' কাব্যের ভূমিকায় কবি লিখেছেন- "হাতের অক্ষর পাকাবার যে খাতা ছিল বাল্যকালে সেগুলিকে যেমন অনাদরে রাখিনি, এও তেমনি। সেগুলিও ছিল যাকে বলে কপিবুক, বাইরে থেকে মডেল লেখা নকল করবার সাধনায়। -----প্রথম বয়সের কবিতাগুলি সেই রকম কপিবুকের কবিতা।" আবার বললেন- "অতএব 'সন্ধ্যাসংগীতে'ই আমার কাব্যের প্রথম পরিচয়। সে উৎকৃষ্ট নয়, কিন্তু আমারই বটে। সে সময়কার অন্য সমস্ত কবিতা থেকে আপন ছন্দের বিশেষ সাজ পরে এসেছিল। সে সাজ বাজারে চলিত ছিল না।"
এই পর্যায়ের একটি কবিতা থেকে কিছু অংশ তুলে দিলাম।
           কবিতাঃ- উপহার
"ভুলে গেছি কবে তুমি          ছেলেবেলা একদিন
            মরমের কাছে এসেছিলে,
স্নেহময় ছায়াময়              সন্ধ্যাসম আঁখি মেলি
           একবার বুঝি হেসেছিলে।"
২) কবি 'প্রভাতসংগীত' কাব্যের ভূমিকায় লিখলেন- "'কড়ি  ও কোমল' রচনার পূর্বে কাব্যের ভাষা আমার কাছে ধরা দেয়নি।  --- সেইজন্য আমার মত এই যে, 'কড়ি ও কোমলে'র পর থেকেই আমার কাব্যরচনা ভালো-মন্দ সব কিছু নিয়ে একটা স্পষ্ট সৃষ্টির ধারা অবলম্বন করেছে। ---- তাই বলে রাখছি, 'প্রভাত সংগীতে' এ সমস্ত লেখার আর কোনো মূল্য যদি থাকে, সে ষোলোআনা সাহিত্যিক মূল্য নয়।“
এই পর্যায়ের একটি কবিতা থেকে কিছু অংশ তুলে দিলাম।
          কবিতাঃ- চেয়ে থাকা
"মনেতে সাধ যে দিকে চাই
কেবলি চেয়ে রব।
দেখিব শুধু দেখিব শুধু
কথাটি নাহি কব।"
৩) কবি 'ছবি ও গান' কাব্যের ভূমিকায় লিখলেন- "মোটের উপরে অক্ষম ভাষার ব্যাকুলতায় সবগুলিতেই বানানো ভাব প্রকাশ পেয়েছে, সহজ হয় নি। কিন্তু সহজ হবার একটা চেষ্টা দেখা যায়। --- আমার ভাষায় ও ছন্দে এই একটা মেলামেশা আরম্ভ হল।"
এই পর্যায়ের একটি কবিতা থেকে কিছু অংশ উল্লেখ করছি।।
         কবিতাঃ- একাকিনী
"একটি মেয়ে একেলা
সাঁঝের বেলা
মাঠ দিয়ে চলেছে।
চারিদিকে সোনার ধান ফলেছে।"
৪) 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' র ভূমিকায় কবি লিখছেন- "নূতন প্রকাশিত পদাবলী নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, ---- শব্দতত্ত্বে আমার ঔৎসুক্য স্বাভাবিক।" এখানে তিনি আরও লিখলেন- "অক্ষয়বাবুর কাছে শুনেছিলুম বালক কবি চ্যাটার্টনের গল্প। তাঁকে নকল করবার লোভ হয়েছিল। এ কথা মনেই ছিল না যে, ঠিকমত নকল করতে হলেও শুধু ভাষায় নয়, ভাবে খাঁটি হওয়া চাই। নইলে কথার গাঁথনিটা ঠিক হলেও সুরে তার ফাঁকি ধরা পড়ে।"
এই পর্যায়ের একটি কবিতা থেকে কিছু অংশ তুলে দিলাম।
           কবিতা নং- ৮
"গহন কুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে,
বিসরি ত্রাস- লোকলাজে
সজনি, আও আও লো। "
৫) এবার চলে আসি 'কড়ি  ও কোমল' কাব্যের ভূমিকায়। সেখানে কবি লিখছেন- "এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে এই রীতির কবিতা তখনো প্রচলিত ছিল না। সেই জন্যই কাব্যবিশারদ প্রভৃতি সাহিত্যবিচারকদের কাছ থেকে কটুভাষায় ভর্ৎসনা সহ্য করেছিলুম। -- তখন হেম বাঁড়ুজ্জে এবং নবীন সেন ছাড়া এমন কোনো দেশ প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন না যাঁরা নতুন কবিদের কোনো একটা কাব্যরীতির বাঁধা পথে চালনা করতে পারতেন। কিন্তু আমি তাঁদের সম্পূর্ণই ভুলে ছিলুম। আমাদের পরিবারের বন্ধু কবি বিহারীলাল কে ছেলেবেলা থেকে জানতুম এবং তার কবিতার প্রতি অনুরাগ আমার ছিল অভ্যস্ত।"
এই পর্যায়ের একটি কবিতা থেকে কিছু অংশ তুলে দিলাম।
          কবিতাঃ--প্রাণ
"মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই,
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিতকাননে
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।"
৬) ১৯৪০ সালে কবি 'মানসী' ক্যাবের ভূমিকায় লিখছেন-
"পূর্বতন রচনাধারা থেকে স্বতন্ত্র এ ('শিশু') একটা নূতন কাব্য রূপের প্রকাশ। 'মানসী' ও সেই রকম। নূতন আবেষ্টনে এই কবিতাগুলি সহসা যেন নবদেহ ধারণ করল। পূর্ববর্তী 'কড়ি ও কোমল' এর সঙ্গে এর বিশেষ মিল পাওয়া যাবে না। আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণমূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি। 'মানসী'তেই ছন্দের নানা খেয়াল দেখা দিতে আরম্ভ করেছে। কবির সঙ্গে যেন একজন শিল্পী এসে যোগ দিল।"
এই পর্যায়ের একটি কবিতা থেকে কিছু অংশ তুলে দিলাম।
       কবিতাঃ-বর্ষার দিনে
"এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়!
এমন মেঘস্বরে বাদল- ঝরঝরে
তপনহীন ঘনতমসায়।"
এখানে মনে হয় না, আর কিছু বলার দরকার আছে। কবি যে ছন্দ মেনে লিখেছেন এবং ছন্দ নিয়ে নিয়ত গবেষণা করেছেন তা কবির লেখায় স্পষ্ট। ছন্দ বিষয়ে কবির লেখা বই 'ছন্দ' থেকে আগামীদিনে আলোচনা করব।


***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
----------------------------------------------------------------------------
উৎস/ ঋণস্বীকার- রবীন্দ্র রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, বিশ্ব ভারতী
----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ ছন্দ বিষয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর কোনো তথ্য জানা থাকলে লিখুন। আর সম্ভব হলে এমন কিছু লিখুন যা এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
----------------------------------------------------------------------------
***বিঃদ্রঃ এই আলোচনা যে সবার ভালো লাগবে তেমন নয়।