কবি-কবি ভাব ছন্দের অভাব (ছন্দ ও কবিতার পাঠ) –পাঁচঃ তালেতালে ছন্দ
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি রুনা লায়লা মহাশয়াকে।  
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
২) কবিতা ও ছন্দ
৩) ছন্দের সংজ্ঞা
৪) রবীন্দ্রকবিতায় ছন্দ
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়-  ৫) তালেতালে ছন্দ
------------------------------------------------------------------------------
আমরা শিখতে বা জানতে চলেছি কবিতার পদ্যছন্দ। বিষয়টা আমরা জন্ম থেকেই জানি। ছোটোবেলা থেকে কোনো গানের বা বাজনার সুরে মন, হাত, পা দুলতে থাকে। কেউ গান করলে মনের অজান্তেই আমরা হাত, পা, মাথা নাড়াতে বা দোলাতে থাকি। অনেকে তা দেখে বলেন কীরে 'তাল' উঠে গেল নাকি! সত্যিই আপনার মনের সাথে মিশে আছে এই 'তাল'। যার থেকেই নাচের সৃষ্টি। এই তালের কিছু পণ্ডিতি নিয়ম আছে। এখানে সেগুলি জানার দরকার নেই। সেই পণ্ডিতি নিয়ম কিছুদিন পরে জেনে নেব। এখন এই বাংলা-কবিতা আসরের সৌজন্যে সহজে শিখে নেব সেই ছন্দের তাল। আমরা ছোটোবেলায় পড়েছি  বা ছোটোদের পাঠ দিই-
"হাট্টিমা টিম টিম,
তারা মাঠে পাড়ে ডিম,
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা হাট্টিমা টিম টিম।"
এই ছড়াটি আমরা নির্ভুল ছন্দে বলতে পারি। ছন্দ না শিখেও সবাই ঠিকঠাক ছন্দেই বলতে পারে।
ছড়াটা আমরা হাতে তালি দিয়ে পড়ছি- তালির জায়গাতে *  চিহ্ন দেওয়া হল।
হা* ট্টিমা টিম টি*ম,তারা
মা*ঠে পাড়ে ডি*ম,তাদের
খা*ড়া দুটো শি*ং তারা
হা* ট্টিমা টিম টি*ম।
হাতে তালি দিয়ে পড়লে ছন্দটা এভাবে দাঁড়ায়-
ধিনতা ধিনা /ধি-ন ধিনা
ধিনতা ধিনা /ধি-ন ধিনা
ধিনতা ধিনা /ধি-ন ধিনা
ধিনতা ধিনা /ধি-ন


তাই প্রথমে কবিতা পড়তে গেলে তালটা ঠিক মতো বুঝতে হবে। তা না হলে ছন্দ শেখাও মুশকিল  হয়ে পড়বে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এইটা। কবিতার তালটা ঠিক মতো ধরতে অসুবিধা হয়। বিদ্যালয়ে কবিতা মুখস্ত লেখা বা পাঠ করা দুটিই দায়সারা গোছের। কোনো রকমে আওড়াতে পারলেই বুঝি হয়ে গেল। কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। এক্ষেত্রে আরও নজর দরকার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'হাট' কবিতা ছেলেবেলায় ক্লাসরুমে গড়গড় করে ছেলেমেয়েরা এভাবে বলে-
কুমোরপাড়ার গোরুরগাড়ি বোঝাইকরাকলসিহাঁড়ি
গাড়িচালায় বংশীবদন সঙ্গে যেযায়ভাগ্নেমদন
স্পষ্ট উচারণে তাল-ছন্দ মেনে কবিতা এভাবে বলা উচিৎ।
কু*মোরপাড়ার /গো*রুরগাড়ি
বো*ঝাই করা /ক*লসি হাঁড়ি
গা*ড়ি চালায় /বং*শী বদন
স*ঙ্গে যে যায় /ভা*গ্নে মদন


তবলায় (কাল্পনিক তাল)
ধিনতা ধিনা /ধিনতা ধিনা
ধিনতা ধিনা /ধিনতা ধিনা
ধিনতা ধিনা /ধিনতা ধিনা
ধিনতা ধিনা /ধিনতা ধিনা


সাঁতার কেউ একবার শিখলে ভোলে না। ছন্দের দোলাও তাই। এখানে তাই নানা রকম ছন্দের কবিতা তালি দিয়ে পড়ব। ছন্দ শেখার আগে কবিতা ঠিকমতো ছন্দের তালেতালে পড়তে পারাটা খুব জরুরী। ছন্দের বোধ তৈরি হয়ে গেলে আর তালি দেবার প্রয়োজন নেই। মনের মধ্যে তখন শুধুই চলতে থাকবে ছন্দের খেলা।
এখানে একটা কথা বলে রাখি। এগুলির কোনোটিই খাঁটি তবলার তাল নয়। শেখার জন্য কাল্পনিক ব্যবহার করা হয়েছে।


কিছু কবিতা তাল দিয়ে পড়ি


পালকি চলে! // ধিনতা ধিনা
পালকি চলে! // ধিনতা ধিনা
গগন-তলে // ধিনতা ধিনা
আগুন জ্বলে! // ধিনতা ধিনা


আবার
শুনতে পেলাম /পোস্তা গিয়ে // ধিনতা ধিনা /ধিনতা ধিনা
তোমার নাকি /মেয়ের বিয়ে।// ধিনতা ধিনা /ধিনতা ধিনা


ভোর হল /দোর খোলো/ খুকুমণি /ওঠোরে
ঐ ডাকে /জুঁই শাখে /ফুলকলি/ ফোটোরে
ধিন ধিনা /ধিন ধিনা /ধিন ধিনা /ধি ধি না।


এক যে আছে /মজার দেশ/ সবরকমে/ ভালো
রাত্তিরিতে /বেজায় রোদ/ দিনে চাঁদের /আলো।
ধিনতা ধিনা /ধিনতা ধিনা /ধিনতা ধিনা  /ধিনা


বলতে পারো /বড়োমানুষ /মোটর কেন /চড়বে?
গরীব কেন /সেই মোটরের /তলায় চাপা /পড়বে?
ধিনতা ধিনা /ধিনতা ধিনা/ ধিনতা ধিনা/  ধিনতা।


বাবুদের /তালপুকুরে
হাবুদের /ডালকুকুরে
সে কি বাস /করল তারা
বলি থাম /একটু দাড়া
ধি ধি না /ধিনতা ধিনা
ধি ধি না /ধিনতা ধিনা  
এখানে দুটি পঙক্তিকে এক লাইনে লেখা হয়েছে। তাই মাঝখানে দুটি রেখা টেনে পঙক্তি বিভাজন দেখিয়েছি। ছন্দ সেই- ধিধিনা ধিনতা ধিনা।
এমন তালে তালে প্রচুর কবিতা আছে। যত কবিতা পড়ার অভ্যাস করব, তত কবিতার ছন্দ বোঝা সহজ হবে। কত তালের ও সুরের কত কবিতা আছে।
১) মহাভারতের কথা অমৃত সমান
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।
২) হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
৩) সুখের লাগিয়া        এ ঘর বাঁধিনু
            অনলে পুড়িয়া গেল।
আশা করি এভাবে ছন্দে কবিতা পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে যাবে। কবিতা পড়তে পড়তে আমরা আরও শিখতে পারব।


***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
----------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণ স্বীকারঃ বাংলা ছন্দের সহজপাঠ, সত্রাজিৎ গোস্বামী, কলকাতা।
----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ ছন্দের বোধ তৈরির জন্য আমরা আরও কবিতা পড়ব। কবিতা পড়ার অভ্যাস করব। প্রয়োজনে এই আসর থেকেই নানা কবিতা পাঠ করব। তাল রেখে সেগুলি এখানে লিখি আর পাঠ করি।  
----------------------------------------------------------------------------
***বিঃদ্রঃ এই আলোচনা যে সবার ভালো লাগবে তেমন নয়। আসুন এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গঠনমূলক মন্তব্য করি।