কবি-কবি ভাব ছন্দের অভাব (ছন্দ ও কবিতার পাঠ) –আটঃ ছন্দ কেন প্রয়োজন
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি মূলচাঁদ মাহাত মহাশয়কে।      
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
৫) তালে তালে ছন্দ
৬) কবিতার সংজ্ঞা ও উপকরণ
৭) ছন্দের সাথে আবৃত্তির সম্পর্ক  
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়-  ৮) ছন্দ কেন প্রয়োজন?
------------------------------------------------------------------------------
       এখন প্রশ্ন হল, ছন্দ কেন প্রয়োজন? ছন্দ প্রয়োজন ভাষার প্রাণসঞ্চার করার জন্য। তরঙ্গসৃষ্টির মধ্য দিয়ে কথাকে ব্যঞ্জনাময় করার জন্য। এই ছন্দের কারণেই গদ্য ও কবিতার ভাষায় আমরা বিস্তর তফাৎ দেখি। গদ্য লেখায় যে কথাটা আমাদের কাছে নিতান্ত সাধারণ ও সাদামাটা মনে হয়, কবিতায় সেই একই কথা হয়ে ওঠে অসামান্য মাধুর্যমণ্ডিত। কবিতার সাথে তাই ছন্দের সম্পর্ক নিবিড়। ছন্দই কবিতার বাণীকে সুরের খেয়ায় করে পৌঁছে দেয় পাঠকের হৃদয়ে। তাই ছন্দের প্রয়োজন কখনও ফুরোয়নি আর ফুরোবেও না। কবিতায় আমরা যে দোলা বা স্পন্দের কথা বলি তা এই ছন্দ থেকেই আসে।
      ছন্দ ছাড়া ছড়া,কবিতা বা গান লেখার কোনো সুযোগ নেই। যারা মনে করেন ছড়া কবিতা লিখতে গেলে কোনো নিয়মকানুন বা পদ্ধতির প্রয়োজন নেই, শুধু মনের আবেগকে ভাব-ভাষায় প্রকাশ করলেই  হল,তাদের ধারনাটা পুরোপুরি ভুল। অনেকে আবার ছন্দ বলতে অন্ত্যমিলকেই বুঝে থাকেন। সেটাওতো ভুল। ছন্দ ও অন্ত্যমিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। যদি আমরা লেখালেখি ভালো করতে চাই তবে
লেখালেখির নিয়মকানুন বিষয়ে অবগত হতে হবে। বিশেষ করে কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে ছন্দজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
      ছন্দ কি শুধু গদ্যপদ্যের বিষয়? মোটেও না। আসলে ছন্দ মিশে আছে আমাদের জীবনের সবকিছুতে। আমাদের হৃৎপিণ্ড বা শ্বাসপ্রশ্বাস নিরবচ্ছিন্ন ছন্দে প্রবহমান। এ কথা আগেও বলেছি। সে ছন্দে হেরফের হলেই বিরাট সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের দেহের যে গঠন তারও একটা আলাদা ছন্দ বা ছাঁদ আছে। সমগ্র বিশ্বচরাচরেও এ রকম ছন্দময়তা মিশে আছে। একটা সামগ্রিক ভারসাম্য নিয়ে সেটা প্রতিষ্ঠিত। তাই ছন্দ ছাড়া কোন সৃজনকর্মই সম্ভব নয়। কবিতা তো নয়ই।
    কবিতা কি সেটা বোঝাবার একটা যুৎসই চেষ্টা করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর ‘ছন্দ’ গ্রন্থে বলেছেন- ‘শুধু কথা যখন খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তখন কেবলমাত্র অর্থকে প্রকাশ করে। কিন্তু সেই কথাকে যখন তির্যক ভঙ্গি ও বিশেষ গতি দেওয়া যায় তখন সে আপন অর্থের চেয়ে আরও বেশি কিছু প্রকাশ করে। সেই বেশিটুকু যে কী তা বলাই শক্ত। কেননা তা কথার অতীত, সুতরাং অনির্বচনীয়। যা আমরা দেখছি শুনছি জানছি তার সঙ্গে যখন অনির্বচনীয়ের যোগ হয় তখন তাকেই  আমরা বলি রস। অর্থাৎ সে জিনিসটাকে অনুভব করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না। সকলে জানেন এ রসই হচ্ছে কাব্যের বিষয়।’  এই বিষয়টাকে তিনি একটা উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন- 'শ্যামের নাম রাধা শুনেছে'। ঘটনাটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু যে-একটা অদৃশ্য বেগ জন্মাল তার আর শেষ নেই। আসল ব্যাপারটা হল তাই। সেইজন্যে কবি ছন্দের ঝংকারের মধ্যে এই কথাটাকে দুলিয়ে দিলেন। যতক্ষণ ছন্দ থাকবে ততক্ষণ এই দোলা থামবে না। ’সই,কেবা শুনাইল শ্যামনাম।’ কেবলই ঢেউ উঠতে লাগল। ওই কটি ছাপার অক্ষরে যদিও ভালোমানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকার ভান করে কিন্তু ওদের অন্তরের স্পন্দন আর কোনোদিনই শান্ত হবে না। ওরা অস্থির হয়েছে, এবং অস্থির করাই ওদের কাজ’।
      কবিকে তাই কবিতা লিখতে হয় ছন্দ মেনেই। সে কারণে কবিকে ছন্দ শিখতে হয়। কবিতা কী সেটাও শিখতে হয়। শেখার কাজটা চলে কবিতার সাথে নিরন্তর বসবাস করে। প্রকৃতির মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাকে সবই শিখে নিতে হয়। পাখির ছানা বা ছাগলছানা স্বাভাবিক জিনিস সহজাত সামর্থ্য দিয়ে শিখে নেয়। হাঁসের বাচ্চা সহজেই জেনে যায় সাঁতার। মানুষকে শিখতেই হয় হাঁটা থেকে শুরু করে কথা বলা, লেখা পর্যন্ত সবই। এই বিধিলিপিও কবিকে ছন্দ শেখার দায়ে আবদ্ধ করেছে। কবিতায় ছন্দ তাই আপনাআপনি জেগে ওঠে না। কবিকে রীতিমতো সাধনা করে ছন্দনির্মাণ করতে হয়। কাব্যরসধর্মী সুসমশব্দ চয়নের মধ্য দিয়ে কবি কবিতায় ছন্দনির্মাণ করেন।এই নির্মাণকৌশল যেমন গাণিতিক তেমনি আবার বৈজ্ঞানিক।
      কথা হল প্রথমেই কি কবি ছন্দ শেখেন ? শেখেন না। শেখেন তখনই যখন সত্যি সত্যি কবি হবার সিন্ধান্ত নেন। রবীন্দ্রনাথও ’জল পড়ে পাতা নড়ে’ ছন্দ শেখার আগেই লিখেছেন। কিন্তু সেখানে থেমে যাননি বলেই তিনি সবার রবীন্দ্রনাথ। লেখক সৈয়দ শামসুল হকও অবলীলায় স্বীকার করেছেন, ’পেছনের দিকে তাকিয়ে এখন শিউরে উঠি যে লেখার কৌশল কতখানি কম জেনে — আরও ভালো, যদি বলি কিছুই না জেনে, একদা এই কলম হাতে নিয়েছিলাম।’ সৈয়দ হক আরেকটা গুরুতর কথা মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি-’ লেখাটা কোনো কঠিন কাজ নয়, যে কেউ লিখতে পারেন, কঠিন হচ্ছে, লেখাটিকে একটি পাঠের অধিক আয়ু দান করা।’
     সব কবিই প্রথমে ছন্দ বা কবিতার ভেতরের কারিগরী না জেনে লেখা আরম্ভ করেন। কারও কবিতা পড়ে কিংবা শুনে কবি সে কবিতার প্রেমে পড়েন। প্রেমে পড়া কবিতার আদলটা শিখে নিয়ে তার ছাঁচে গড়েন নিজের প্রথম কবিতা। তারপর ছন্দ শেখা আর কবিতা লেখা, শেখার জন্য অন্তরের রক্তক্ষরণের এক কঠিন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কবি হয়ে ওঠেন। ছন্দ শিখলেই কবি হবেন এরও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ছন্দ না শিখে কখনও কবি হওয়া য়ায়নি। অন্তত এ ব্রহ্মাণ্ডের যিনি কবি বলে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি ছন্দ জেনে, ছন্দ মেনে কবিতা লিখেছেন।
আরেকটা কথাও এসে যায়। সেটা শিল্পী বা কবির স্বাধীনতার প্রশ্ন। প্রকৃত কবিতো দুরন্ত ,স্বাধীনচেতা। কবি কেন ছন্দের বন্ধন মানবেন ? যদিও জানি, কবি ভালোবাসার বাঁধনের কাছে সদা নতজানু। তারপরও বন্ধনের অধীনতা কেন দরকার তার জবাবটা নিচ্ছি ছন্দের সবচেয়ে বড়ো গুরুদের অন্যতম, রবীন্দ্রনাথের কাছে-’আমরা ভাষায় বলে থাকি কথাকে ছন্দে বাঁধা। কিন্তু এ কেবল বাইরের বাঁধন, অন্তরের মুক্তি। কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার জন্যেই ছন্দ। সেতারের তার বাঁধা থাকে বটে কিন্তু তার থেকে সুর পায় ছাড়া। ছন্দ হচ্ছে সেই তার-বাঁধা সেতার, কথার অন্তরের সুরকে সে ছাড়া দিতে থাকে। ধনুকের সে ছিলা, কথাকে সে তীরের মতো লক্ষ্যের মর্মের মধ্যে নিক্ষেপ করে।‘
      ছন্দ কবিতার গঠন কর্ম বা রূপ প্রকল্পের একমাত্র উপাদান নয়। তবে অন্যান্য সৌন্দর্য উপাদানের পূর্ণতা দানের বাহন। আবদুল মান্নান সৈয়দের ভাষায় ‘চৈতন্যহীন শরীর বা শরীরহীন চৈতন্যের মতো ছন্দহীন কবিতা বা কবিতাহীন ছন্দ সোনার পাথরবাটি মাত্র। কবিতা থেকে ছন্দকে পৃথক করা যায় না, ছন্দ থেকে কবিতাকেও আলাদা করা অসম্ভব। সেদিক থেকে ছন্দ বিচার কবিতারই বিচার, কবিতার বিচারেও ছন্দের আলোচনা অবশ্যম্ভাবী। অর্থাৎ ছন্দ হল কবিতার রক্ত প্রবাহ বা প্রাণ প্রবাহ। কবিতার প্রতি পাঠকের যে অনুরাগ তার অনেকটাই ছন্দের উপর নির্ভরশীল। ছোটোবেলার মুখস্ত হওয়া 'কবর', 'দুইবিঘা জমি', 'রানার', 'রাখাল ছেলে' সব তারই উদাহরণ। ছন্দের ত্রুটিযুক্ত অথচ ভাবসমৃদ্ধ কবিতা কখনোই পাঠকের হৃদয় জয় করতে পারে না। ছন্দযুক্ত লেখা মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করে।
     কবিতা লেখার ক্ষেত্রে অবশ্যই কবিকে ছন্দের অনুশাসন মানতে হয়। ছন্দ সচেতনতা কবির অন্যতম প্রধান গুণ। ছন্দ প্রকৃত প্রতিভাবান কবির একটি স্বভাবজাত বিষয়। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন- ‘কবি প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য।‘ কবিতায় বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্যও ছন্দজ্ঞান প্রয়োজন। ছন্দ না জানালে ছন্দ ভাঙা যায় না। আর ছন্দ না জেনে ছড়া লেখা? সেটা পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ ছন্দই ছড়ার প্রাণ।
     এখানেই ছন্দের প্রাসঙ্গিকতা। আরেকটা প্রশ্ন উঠতে পারে নতুন যারা কবিতা লিখতে শুরু করবেন তারা ছন্দের কঠিন জগতের ছকে সৃজনশীলতাকে মেলাবেন কীভাবে? এর জবাবটা নানা জনের জন্য নানা রকম হবে। তবে পাশাপাশি চলতে পারে কবিতাপাঠ,ছন্দ জানা, অলঙ্কার, রসতত্ত্ব আর কবিতার আলোচনা পড়া। এক সময় নবীনকবি আবিষ্কার করবেন ছন্দ তার হাতে খেলতে শুরু করেছে।
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) ছন্দ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্র রচনাবলীঃ একাদশ খণ্ড)
                    ২) ছন্দের সহজপাঠ- সুজন বড়ুয়া, ঢাকা
-----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছন্দ' প্রবন্ধটি সম্পূর্ণ পাঠ করতে অনুরোধ করি। তারপর এই বিষয়ে কোনো মতামত থাকলে জানাবেন।
--------------------------------------------------------------
***বিঃদ্রঃ এই আলোচনা যে সবার ভালো লাগবে তেমন নয়। আসুন এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গঠনমূলক মন্তব্য করি।