(গত ২৯/১/২০১৮ তারিখে মুরশিদাবাদের দৌলতাবাদে একটি বাসের সলিলসমাধি ঘটে। মৃত্যু হয় ৪২ জনের। তার মধ্যে ছিলেন উনত্রিশ বছরের বিদ্যালয় শিক্ষিকা সুফিয়া মমতাজ। তার বিরহে তার স্বামীর কণ্ঠে এই কবিতা।)
         (১)
সকালে দেখেছি খবর পাতায়
'সেতু থেকে জলে বাস';
উদ্ধার শুরু মিলতেই থাকে
একের পর এক লাশ।
লোকে জমায়েত ভৈরবী পার
অশ্রু মানেনি বাঁধ;
রাজ্যের চোখ শুধু এইদিকে
আজ দৌলতাবাদ।


তখনও ভোরের আলো ফোটে নাই
বাস ছিল ভিড়ে ঠাসা;
যাত্রীরা প্রায় ঘুমের দেশেতে
বাইরে ছিল কুয়াশা।
দ্রুত গতিতে ছুটেছিল বাস
ছিল না নিয়ন্ত্রণ;
বিয়াল্লিশটি দেহের মাঝেই
সুফিয়া যে একজন।


স্বামীটি তাহার করিছে বিলাপ
সৎকার সেরে এসে;
তার সব ব্যথা লিখে গেছে আজ
প্রিয়াকেই ভালোবেসে।
বধূর তরেতে এ চিঠি তার
করুণার মাঝে স্মৃতি;
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে গেছে আজ
বেদনায় ভরা রাতি।


প্রিয়া মোর তুমি! সখী মোর তুমি!
আর কি পাইব চোখে;
আমাকে ছাড়িয়া পরানবন্ধু
পাড়ি দিলে কোন লোকে!
আজ তাই বসি একা একা ভাবি
বেঁচে থাকি স্মৃতিতেই;
তোমার জীবন চোখের কোণেতে
আজ লিখি  চিঠিতেই।


           (২)
সেদিন ছিল যে শীতের সকাল
কুয়াশার ভোরবেলা;
কে জানিত আজ কী ঘটিবে প্রিয়!
আনমনে সুর তোলা।
সেদিন সকাল আমার আঁধার
আমার জীবনে শোক;
তোমাকে হারিয়ে সুর তুলি বুকে
দেখেছে অন্যলোক।


হ্যাঁগো প্রিয়তমা, আমিই বলছি
তোমার পাগল সোনা;
শুনছ কি তুমি, শুনছ সুফিয়া
আমার আঁখির কোণা।
চলে গেলে তুমি তোমার দেশেতে
শেষবার হল কথা;
সারাটি জীবন কেমনে কাটাব
মনেতে অনেক ব্যথা।


সকালেতে উঠি দুজনায় মিলে
প্রথম সে সোমবার;
একসাথে বসি, চা পান করি
কথা কিছু বলিবার।
সকালের কালে তোমার যাওয়া
তোমার কাজের দেশে;
একসাথে হেঁটে মিনিট পাঁচেক
দিয়েছি তুলিয়া বাসে।


তুমি যেয়ে ওই বাসেতে উঠেছ
শীতের দেয়ালে কাঁচ;
তবুও সেখানে হাত নাড়িয়াছ
পেয়েছি তোমার আঁচ।
সেই চোখাচোখি শেষবার হবে
কে ভেবেছে  প্রিয়তমা!
তোমার বিদায়ে ফিরে আসি ঘরে
কত কাজ ঘরে জমা।


         (৩)
তোমার ছেলেটি, তোমার মেয়েটি
তখনও গো বিছানায়;
কপালে কী আছে! কী শুনিবে জেগে
অদেখা অপেক্ষায়।
হাতের বাসন পড়ে গেল নীচে
কোন সে অলক্ষণ!
পোড়া মনে আজ বাড়ে সন্দেহ
কোথা বুঝি অঘটন।


সকালের পথে চলেছিল বাস
হয়ত অনেক দ্রুত!
ভোরের কুয়াশা ভেদ করে ওই
বাস ছোটে অবিরত।
কিছু পথ পরে এ 'বালিরঘাট'
নীচেতে ভয়াল নদী;
চালকের ভুলে বাস পড়ে গেল
অনেক প্রাণ সমাধি।


কাহারে বা বলি, কাহারে শুধায়-
কেমনে নীরবে কাঁদি!
দিনের শুরুতে জনমের মতো
তোমার সলিলসমাধি।
এই ছিল বুঝি  শেষের যাত্রা
স্বামী-সন্তান ছেড়ে;
বিনা মেঘে আজ এ বজ্রপাত
ব্যথা এল অন্তরে।


চলে গেলে তুমি মায়া মমতায়
সুন্দর পৃথিবীর;
সন্তানদের রেখে গেলে শুধু
করে মন অনাথির।
দিন চলে যায়, সময়ের স্রোত
থাকে শুধু কথকতা;
কিছু জানি নাই, কিছু বুঝি নাই
চরম বাস্তবতা।


       (৪)
তোমার ছোটোটি কোলের মানিশ
দুই বছরে সে প'ল;
বুঝল না আজ, জানল না কিছু
তার মায়ের কী হল?
দরজা খুললে আওয়াজ হত
আসে বুঝি তার মা;
হাজার বায়না জুড়বে এখন
তবু মা আসবে না।


কেউ যদি তারে জিজ্ঞেস করে
কোথায় মা তোর মানিশ?
'বাসে আসবেই, ভুম করে সেই
ঠিক আসবে জানিস!'
সেও জেনে গেছে তোমাকে নিয়েছে
জীবন নিয়েছে বাস;
এই ভাবনায় তাকে কুড়ে খাবে
বছর বছর মাস।


এখন ছেলে যে খেলিয়া বেড়ায়
বল হাতে ওই মাঠে;
আমি আজ তাকে সময় দিয়েছি
আমার কাজের ফাঁকে।
ছোটো সাইকেল চালিয়ে বেড়ায়
খেলে বসে তার সাথে;
মায়ে বুঝি তার বারণ করে না
আরতো দিবস রাতে।


এইতো সেদিন জনমের দিন
করেছি সাড়ম্বরে;
বুঝতে দিইনি তুমি নেই কাছে
তুমি নেই এই ঘরে।
সাজিয়েছি বাড়ি, ফুল সারি সারি
ছেলের খুশির তরে;
জীবনের শুরু এভাবেই এল
জীবন রয়েছে পরে!
(৫)
তোমার মানিজা গিন্নি বালিকা
চিন্তা কোরো না প্রিয়া;
নিজের মনকে শক্ত করেছে
অন্যকে বুঝাইয়া।
নিজের থেকেই আজকে যে সে
বাবাকে নিয়েই ভাবে;
কখন বুঝিগো বাবার চোখেই
অশ্রু আসে নীরবে!


সাতটি বছর বয়স তাহার
নবীন বালিকা মন;
বুক পুড়ে যায়, মন পুড়ে আসে
এই অকালদহন।
বাবার চোখেতে হাত দিয়ে দেখে
দেখে চেয়ে বারেবারে;
বাবা বুঝি তার কেঁদে ওঠে ওই
আড়ালে অন্ধকারে।


মেয়ে যে তোমার সোনার মেয়ে
ওর ব্যথা কম নয়;
সকলের কাছে ছুটে ছুটে গেছে
কী জানি কি আজ হয়?
আমি তো ছুটেছি ঘটনার পর
শেষ আশা সাথে নিয়ে;
ফিরে আসি সেই রাত বারোটায়
বাড়ি রেখে ছেলে মেয়ে।


আমার সময় কেটে গেছে জানি
সমব্যথা কথা টানে;
কী ঝড় বয়েছে শিশু মন পরে
ভেবেছি রোদন বানে!
বাড়িতে বয়েছে কান্নার রোল
আত্মীয় প্রতিবেশী;
শিশুদের চোখে আঁখি জল ছিল
দূর হয়ে গেছে হাসি।


            (৬)
আমি যে তোমার অভাগা কাঙাল
আমার কথাটা থাক;
দশটা বছর একসাথে চলা
তারপরে নির্বাক!
আজ আমি সখী ভগ্ন হৃদয়ে
আশাহত এ পথিক;
জানি না জীবন কেমনে চলিবে
কোন পথে ঠিক ঠিক!


আমার বিলাপ, আমার বিরহ
অরণ্যে রোদন জানি;
স্মৃতি নিয়ে আজ বেঁচে থাকি শুধু
তোমার কথায় আমি।
তোমারে হারিয়ে আমি যে কেমন
কেমনে বোঝায় তা;
শুধু মোরে আজ ঋণী করে গেছ
ওগো তুমি প্রিয়তমা।


কোন অজানায় চলে গেছ আজ
সেই যে না ফেরা দেশ;
এক দশকের জীবন পথের
আজ বুঝি হল শেষ।
মনে পড়ে আজ কত কথা প্রিয়ে
তোমার ছবিতে সাথি;
যতবার দেখি কেঁপে কেঁপে উঠি
আমার দিবস রাতি।


তুমিই আমার প্রথম পাত্রী
তুমিই ছিলে দ্বিতীয়;
এই  ভুবনের গোপন এ ঘরে
তুমি ছিলে মোর প্রিয়।
তখন যে তুমি কলেজেতে পড়ো
বয়স সবে উনিশ!
তোমার মেধার মর্যাদা দিই
ওই রূপে কুর্নিশ।
(৭)
সব জেনে-শুনে কবুল করিলে
আসিলে আমার ঘরে;
তোমার আস্থা, পড়াশোনা দিয়ে
মিশে গেলে অন্তরে।
নতুন এ ঘর, নতুন সে বাড়ি
নতুন মধুজীবন;
তোমার মহিমা পরম মুক্তি
সুন্দর ওই মন।


আমাদের সুখে প্রথম সন্তান
ঘর বুঝি আলো হয়;
স্নেহের মানিজা জন্ম নিল
আমরা আনন্দময়।
তারপরে শুধু সুখের দিবস
খুশিতে বছর মাস;
অবশেষে প্রিয়া কণ্ঠ যে রোধ
ভাগ্যের পরিহাস।


তুমি যে দিয়েছ  ওই মনপ্রাণ
আমার সহধর্মিণী;
তুমি নেই আজ শোক জ্ঞাপনে
আমি কত মর্মীনি।
আজ যে আমার লজ্জা নয় গো
হচ্ছে গর্ববোধ;
তোমার শোকেতে শোকাতুর আমি
দেব তার প্রতিশোধ।


তোমার প্রয়াণে মানুষ ব্যথিত
অকাল প্রয়াণ তাই;
ছেলে মেয়ে নিয়ে আমি উদবিগ্ন
উদবিগ্ন সব্বাই।
কীভাবে তাদের জীবন কাটিবে
কী আছে ভবিষ্যৎ
আমি তো যাব কর্মের দেশে
কীভাবে সময় পথ!
(৮)
বাড়ি জুড়ে শুধু কান্নার ঢেউ
ডুকরে ডুকরে উঠে;
কেউ বুঝি এল! কী জানি কি বলে!
মেয়ে দেখে ছুটে ছুটে।
ছেলেটি কখন খেলাতেই মেতে
কখন ভাবেতে থাকে;
কখন আবার কান্নার সাথে
আম্মা আম্মা ডাকে।


আর পারি নাই! সইতে গো প্রিয়
এই ব্যথা ভরা দিন;
কী সে যাতনায় সময় কাটিছে
কেটে যায় প্রতিদিন।
কত যন্ত্রণা, কত হতাশায়
আমারে ঘিরিয়া ডাকে;
তোমার মতন গুছিয়ে গুছিয়ে
কে গো বলো সব রাখে!


কিছুদিন আগে ঘুরিয়া এসেছি
সেই হাজারদুয়ারি;
সেইখানে তোলা কিছু ছবি আছে
তোমার সাথে আমারই।
কত হাসিখুশি, কত মজাদার
কতই ছান্দসিক;
তোমার সাথেতে পথচলা প্রিয়
থেমে গেছে সব দিক।


ঘরেতে হঠাৎ নজরে পড়িল
তোমার সে ছবিখানি;
কাঁদিলাম প্রিয়! জলে ভাসিলাম!
ছবিটি কাছেতে আনি।
হাত বুলালাম ছবিটির 'পরে
বলিতে চেয়েছি কথা;
তুমি যেন আজ হেসেই আকুল
মোরে ভুলে অন্যথা।
(৯)
তোমার মায়ের কান্না কি গো!
কান্না থামাবে কে?
কত কথা বলে কেঁদেই চলেছে
হারিয়ে তাহার মেয়ে।
তার মনে ওই শিশুবেলাকার
সুফিয়ার কত কথা;
সুফিয়া নিভিল, যাতনা আসিল
অন্তর ভরা ব্যথা।


বাসে উঠে মেয়ে ফোন করেছিল-
করতে বলেছে রান্না;
এভাবেই রোজ মা'র কাছে আসে
থামেনা মুখের কান্না।
রোজকার মতো টিফিন গুছিয়ে
রেখেছি কৌটা বাঁধা;
মেয়ে যে এলো না, আজ সকালেতে
আমি অভাগি মাকসুদা।


কেঁদেছে তোমার সব পরিজন
যে যেখানে প্রিয় থাকে;
সবাই এসেছে আজ দুর্দিনে
এসেছে আমার ডাকে।
তোমার কথায় সবাকার মুখে
আজ ওঠে দিকে দিকে;
সুফিয়া যে তুমি, বুল্টি যে তুমি
এভাবেই রাখি লিখে।


তুমি যে পড়াতে যেই ইস্কুলে
সেই ভালোবাসা থাক;
তোমার শিশুরা খবর শুনিয়া
নির্ভয়ে নির্বাক!
তোমার বন্ধু সহপাঠী যারা
সুজন শিক্ষককূল;
সুফিয়া বিহনে ভাবতে পারিনে
ভেঙে গেছে সব ভুল।
(১০)
সবাই এসেছে, খোঁজ নিয়ে গেছে
বলেছে তোমার বাণী;
তুমি কত ভালো! কত প্রিয়জন!
সেই কথা আজ মানি।
তোমারে ভুলিয়া, তোমাকে ছাড়িয়া
প্রিয়, এই কয়দিনে;
মানুষের রূপ জেনে গেছি আমি
মানুষ গিয়েছি চিনে।


ভুলি না কখন, ভুলব না প্রিয়
যেখানে থাকবে তুমি;
আগলে রাখিব, যতনে রাখিব
তোমার আপন ভূমি;
আমার ঘরেতে তোমার এ বাস
তোমার গলার হার;
সকল রাখিব যতনেতে তুলে
করছি অঙ্গিকার!


আজ বসন্ত! ফাগুনের মাস
আমার জন্মদিন;
শুভেচ্ছা তুমি প্রথমে জানাতে
ভালোবেসে অমলিন।
এই যে প্রথম জন্মদিনেতে
তুমি নেই প্রিয়ে কাছে;
কতেক পুষ্প ব্যঙ্গ করিছে
মোর উঠানের গাছে।


আজকে আমার সেই ভালোবাসা
আমার জন্মদিন;
তোমার বিদায়ে শেষ হল জানি
শায়িত সে চিরদিন।
আবার আসবে ফাগুনের দিন
আমার জন্মবেলা;
শুধু সে হারাই তোমার মুখের
হাসি মুক্তার খেলা।
    (১১)
মুখেতে তোমার দীপ্তজ্যোতি
কণ্ঠ সমুজ্জ্বল;
লড়াইয়ের কাছে হার মানো নাই
জীবন যে অবিচল।
তোমার চলন, তোমার কথন
তোমার ভাবনা মন;
তোমাতেই যেন লুকিয়েই ছিল
আগামীর দর্শন।


তোমার ছেলেটি তোমার মেয়েটি
ভুলবে না কোনোদিন;
আজীবন শুধু মনেতে রাখিবে
তোমার স্মৃতির ঋণ।
মৃত্যু খবর শুনিবে গো যত
পথের দুর্ঘটনা;
বুকের ভিতর কাঁপিয়া ঊঠিবে
বজ্রপাত মেঘ বিনা।


'সলিলসমাধি' জানতে এখনও
অনেকটা পথ দেরি;
শব্দের সাথে স্মৃতিটা ওদের
হবেই নিত্য ফেরি।
যতবার যাবে এ ব্রিজের পথে-
'বালিঘাট' পাড়ি দেবে;
ধড়ফড় করে কেঁপে ওঠে ওরা
আবার কেঁদে উঠবে।


এখন আমরা বেঁচে আছি প্রিয়
সকল কিছু হারিয়ে;
খেতে হয় খাই, শ্বাস নিতে হয়!
বিরহ-কান্না ছাড়িয়ে।
মন ভালো নেই, বাড়ে মনোপীড়া
ফিরে ফিরে আসে দুখ;
তোমার মাঝেতে ডুবিয়া থাকি যে
যদি কিছু পাই সুখ।


(১২)
ভালো থেকো প্রিয়! চিন্তা কোরো না
আমরা আছি তো সখী;
চিরনিদ্রায় শায়িত যে তুমি
ভোলাইয়া রেখেছ আঁখি।
তোমার কর্ম, তোমার স্বপন
পূরণ করার প্রয়াস;
জীবন থাকিতে রেখেছি যে জারি
এই করি অভিলাষ!


তুমি আজ নেই কাছেতে আমার-
দেবে না ডাকেতে সাড়া;
দিবানিশি এসে চোখে দিয়ে যেও
শুধু দুঃখ বারিধারা।
তোমার স্বপ্ন তোমার সাধনা
পূরণ করব প্রিয়;
দূর থেকে শুধু এই অভাগারে
শুধুই আশিস দিও।


মহান প্রভু, মহান আল্লাহ!
পরম ক্ষমতাবান;
তার চোখে তাই ভালোমন্দ মিশে
সব কিছু মহীয়ান।
এই বুঝি তাঁর এ প্রসন্নতা
তোমাতে করেছে আনি;
আল্লাহ্‌ আজ মার্জনা কোরো
সকল গোনাহ গুনি।


দোয়া করি প্রিয়, দোয়া করি মনে
ভালো থাক মোর সখী!
স্মৃতি ঝরনায় থেমে যাব আমি
যতনে তাহার রাখি।
তোমার ভাবনা, তোমার স্বপন
তোমার সকল হাসি;
মহান আল্লাহ্‌ করিবে তোমায়
করিবে জান্নাতবাসী!
    -----------