বৈষ্ণবী
      ✍ উজ্জ্বল সরদার আর্য


হৈমন্তিক’ হিমেল-হাওয়ায় ধান ফুলের গন্ধ মেখে,
খোলা চুলে যে উদাসিনী-
উষা কালে চঞ্চলা হরিণী রূপে হেটে ছিল,
শিশিরে ভেজা আমার বুকে প্রেম উল্লাসে;
সে আজ ললাটে চন্দনে তিলক একে, বৈষ্ণবী বেশে-
বনবিহারী'র নাম কীর্তনে যজ্ঞ ভূমিতে মত্ত-হারা।


অনন্ত যৌবনা’ তিলোত্তমা’ সম-সুন্দরী, পর্বত কন্যা-
কৈলাস ছেড়েছে যে অহেতুক অভিমানে;
তার বিষক্রিয়ায় বিরহবিধুর বাঁশি বেজে ওঠে
আজ আমার বুকে।


শম্ভু চক্রের কেন্দ্রাংশ হতে, সৃষ্টি যে রাগ-
রাগিণী'র সুর প্রাণে’ প্রেমের-পদ্ম স্ফুটিত করে
প্রহরে-প্রহরে যখন তার অন্তরে,
ক্রোধী'ত চিত্ত’ মায়াময়ী হয়ে অমৃত সাগরে মেশায় অশ্রু ধারা।


সে যে ঈশ্বর বিশ্বাসী, প্রেমে-প্রেয়সী,সুন্দরী শ্রেষ্ঠা আমার উর্বশী।
যাজ্ঞসেনী, পূর্ণ-প্রভা,তেজস্বী হয়ে সকালের ভৈরবী সঙ্গীতে-সুর মিলিয়ে,
বৈষ্ণব-বেদব্যাস ভূমিকায় লিখছে প্রেম গীত।


কিন্তু, কবি হয়ে ওঠা তার হইনি।
কবিতার কল্পনায় উঠে এলো, নিজ স্মৃতিচারণের অমর লীলামমৃত।
কারণ তখন আমি বিরহের-বহিরাবরণ বেশে,
নাস্তিকের পলকহীন নয়নে’ তার রূপ-লাবণ্য দর্শন করে চলেছি।


চিনতে পারলেও, সে বৈষ্ণবী'র মুখে কোন কথা নেই।
আর এমনিতেই ধার্মিকের কথা ফুরিয়ে আসে,
নাস্তিকের উপস্থিতি'তে।
তাই একটু গায়ে পড়া হয়ে  জিজ্ঞেস করলুম,
হে- বৈষ্ণবী’ কেমন আছো?


অন্তরের’ অপূর্ণতার’ অবগুণ্ঠনে ঢাকা,
বিরহ নত মুখে তুমি বললে...  "হয়তো ভাল'ই আছি "
কিন্তু, তুমি এখানে?


কেন তোমাদের যজ্ঞ ভূমিতে আমি বুঝি আসতে পারি না?
এখানেও কি জাত-পাত আর যোগ্যতা'র প্রমাণ দিতে হয়?


না মানে... তা নয়, কিন্তু.....


কিন্তু কি?  আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী নই,
তবে ঈশ্বরের  যজ্ঞে কেন এই তো?
পরম্পরা’  বা সামাজিকতা'র নিয়ম, দায়বদ্ধতা, বন্ধন, এসব আমি মানি না সত্যি;
আবার কোন কিছু না মানার মাঝেও,  একধরনের মানার ঊর্ধ্বে বসবাস করি!
সে তুমি ভালো করেই জানো।


সে কারণেই বুঝি প্রেমের’পূজারী ছেড়ে,
নাস্তিক ধর্ম নিয়েছ?


হ্যাঁ,আজ আমি নাস্তিক!
আর এটা বলতে আমার কোন লজ্জা,বা ভয়,
এর কোনটাই নেই।
যে দেশে লক্ষ-লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় অনাহারে,
আর জাত-পাতের ঘৃণা লেগে থাকে মনে,
সে-দেশে পূজা,যজ্ঞ, আর ধর্ম অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে,
মরে যাওয়া ভালো।


ধর্ম কি? ওরা জানেনা।
আজ ধর্ম ঘিরে চলছে যত, সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি যুক্ত বিনোদন..... বা ব্যবসা।


তাই যারা ঈশ্বরের নামে চাঁদা তুলে, রঙ্গমঞ্চে নারী নাচিয়ে ধর্ম করছে;
তাদের মুখে "থু" মেরে,
আমি নিজ রাজ বংশ ফেলে ঈশ্বর ভুলেছি।


কিন্তু,  নাস্তিকের মানবধর্ম অনুসারে, তোমায় ভালোবাসে’তোমার দুয়ারে,
আজও ভিক্ষারী বেশে আমায় যে আসতে হয়।


ইস! কি লজ্জা,
এভাবে বলে আমায় ছোটো করোনা গো।
ভিক্ষারী তুমি নও, আর ভিক্ষার কথা বা বলছো কেন?
তুমি তো কবি, অন্যরা তোমায় না চিনলেও আমি তো চিনি।
তুমি যে কখনো নিজ মোহে ভুল করতেই পারো না।


তাই আজ কে কোন দুর্দশায় ভুগছে শুনি?
যার মঙ্গলার্থে এসেছো ছুটে তোমার বৈষ্ণবীর স্মরণে।


সকলে আজ ভালোই আছে, ভালো নেই শুধু আমি!!
অভাব, দারুণ অভাব আছে আমার।


কেন, কবির মনে বুঝি শুধু দারিদ্র'তা থাকে?
আর যে কবিতা’ দারিদ্র'তা বহন করে জীর্ণ, শীর্ণ আজ,
তার জন্য বুঝি কোন মুক্তির পথ খোলা হয়নি?


তুমি মুক্তি চাও আজ হে বৈষ্ণবী?
আমার হৃদয়ের সকল ভালোবাসা যে চরণে সমর্পিত,
যা কে ভালোবেসে আজ আমি জ্ঞানের আলো দেখেছি,
যাকে দেবী রূপে পূজা করে, পূজারী হয়ে আত্মনিবেদনে অমর হতে চেয়েছি,
সে আমার থেকে মুক্তি চায়?
এ কথা শোনাও যে আমার পাপ।


তাহলে এখানে এসেছো কেন?  
যাও ফুল, জল, নৈবিদ্য, বুকের রক্ত, অশ্রু এক করে লেখ কবিতা;
আর ছুটে যাও সুন্দরী-সুন্দরী মেয়েদের উপহার দিতে।


আচ্ছা’ তোমার লজ্জা করে না বাড়িঘর, পরিবার, পরিত্যাগ করে,
কাজ কর্ম ভুলে, পথে-পথে ঘুরে কবিতা লিখতে?


লজ্জা? লজ্জা ভুলেছি অনেক আগেই!
যেখানে প্রেম দিলে প্রেম পাওয়া যায় না,
যেখানে নিয়ম নিতি'তে বসবাস,
সেখানে লজ্জায় মুখে অবগুণ্ঠন টেনে তুমিই বসে থাকো।
কবিতা আজ একমাত্র আমার সঙ্গী, আমার মনের খোরাক,
আমার নাস্তিক সমাজের দলিল।


হে কবি, তুমি আজ ভালো'ই বলেছো ।
ঠিক তাই-
আমি  আজ  এই সমাজের বদ্ধ ঘরে বন্দি হওয়া এক অসহায় নারী।


পিক হয়ে ভোরের  মুক্ত আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখার আগেই, ডানা হারিয়েছি।
এখন বিরহ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে, শুধু ঈশ্বর নিয়েই  বেচে আছি।


তবুও পরিচিত সব বন্ধু’বান্ধবী’ আড়ালে তোমায় উপহাস করে, আর হাসে।
আমার খুব রাগ হয়।


ওরা হাসে? হাসবে'ই তো ---
পুঁথিগত মুখস্থ বিদ্যায় নিমজ্জিত পণ্ডিত গোন,
কি করে বুঝবে?  
সৃষ্টিশীল এই  মার্ক শূন্য পরীক্ষায়, শ্রেষ্ঠত্ব কি করে  অর্জন করতে হয়।


তবুও বলছি তুমি এসব ছাড়ো, অনেক হয়েছে....


তবে আমার সম্মান, যশ,খ্যাতির কি হবে? কি হবে আমার নাস্তিক তার?


ওসব আমি বুঝি না, তুমি শুধু আমার’ আর আমার কবি হয়েই থাকবে।


হে বৈষ্ণবী! কবি কখনো কারো একার হয় না।
কবির মনে সকলের বাস, আর সকলের মন  কবির উল্লাসে উল্লাস।


তাহলে এখানে এসেছো কেন?  যাও সকলের কাছে।
পথে-পথে পান্থ সাজে খোঁজো তোমার সম্মান।


যেতে আমার হবেই,
তোমাদের এই তথাকথিত সামাজিকতা নামক অসামাজিকতার দেশ ছেড়ে।
যেখানে প্রেম নেই, যেখানে মানুষে’মানুষে’ দিনরাত হানাহানি, যুদ্ধ, সংগ্রাম জাত-পাতে দ্বন্দ্ব, সেখানে আমি আর  থাকতে চাই না।
শুধু আছি তোমায় ভালোবেসে,
তোমার পূজারী বেশে।


আর আছো এখানে কিছু চাইতে এলে ফিরা'বে না,
এই তো .........?


হা,হা,হা, তা তুমি মন্দ  বলনি।
মানবধর্মী দারিদ্রতায় পড়ে ভিক্ষারী যখনি হয়েছি,
তখন তো তোমার কাছে আসতেই হবে হে বৈষ্ণবী।


কিন্তু, আমি যে আজ নিরুপায়।
হে কবি! তোমাকে দেবার মত নতুন করে,
আমার যে কিছুই নেই ।


দান দিতে গিয়ে হৃদয় কম্পিত হলে,লাভ দানেরি হয়।
দান দাতা কারি'র নয়।


কিন্তু আমি তো দানের প্রত্রি মোহ রাখিনি কোনদিন।


তবে কেন  পারো না আমায় বিবাহ করতে?
চিরকাল শুধু ঋণী করে রেখেছো আমায়.....।
জানিনা, কবে এই ঋণ শোধ করবো নিজ দেহের রক্ত বিন্দু দিয়ে।


চুপ করো, তুমি চুপ করো,
আমায় কিছুই দিতে হবে না।
শুধু চাই ঈশ্বর  যেন তোমায় ভালো রাখে।


এসব মিথ্যা আশা!
তোমার ঈশ্বর আমায় বোঝে না হে বৈষ্ণবী,
তা যদি বুঝতো তবে আমার থেকে তোমায় এভাবে কেড়ে নিতো না।


স্মৃতি চারণ ছাড়ো।
শুধু জানি, এই হৃদয়ে তুমি আছো আর থাকবে চিরকাল।


তবে চলো দুজনে বিবাহ করি,
বিবাহ'র কথা শুনে নীরব হয়ে গেলে ... হে আমার বৈষ্ণবী?
আমি জানতুম পারবে না।
আমার মত বেকার, অসভ্য, আর সংস্কার হীন নাস্তি কে তুমি কেন বা বিবাহ করবে?
এরচেয়ে  যে আশায় এসেছি, তুমি তা দিয়ে আমায় বিদায় দাও হে বৈষ্ণবী।


কাছে তেমন কোন অর্থ,বা অলংকার নেই।
তবুও কিঞ্চিত প্রচেষ্টা করে দেখছি,
কারণ তোমাকে দান দেবার মাঝেই যে আমার আনন্দ।
আর সে আনন্দে দহন দগ্ধ হৃদয়, শান্ত হয়ে যায়, হে আমার কবি।
তুমি অপেক্ষা করো......


অষ্ট প্রহরের’ চতুর্থ প্রহার’ একটু একটু করে শেষ হয়ে গেলো।
দিন ফুরিয়ে এলো রজনী....।
আলোক সজ্জায় ঝলমল করে উঠলো যজ্ঞ ভূমি।
তাই ঈশ্বর বিশ্বাসী পণ্ডিত গনের নেমে এলো ঢল।


আমার বৈষ্ণবীও  সেখানে হলো উপস্থিত।
এখন সে বৈষ্ণবী বেশে নয়,দেবী বেশে এসেছে.....আমার অনুরোধে।


জীবনে এই প্রথম সরস্বতী'র প্রতি রূপে তাকে দেখলাম,
স্বর্ণ অলংকারে ভূষিত হয়ে সজ্জিত শাড়ী'তে সে যেন তিলোত্তমা।


এখন  তার আকুল নয়ন শুধু আমায় খুজচ্ছে।
কোথায়, কোথায় হে আমার কবি?
দেখা দাও,দেখা দাও হে আমার নাস্তিক রূপে দেবতা।


ওগো তোমার প্রেম, এই ব্যাকুলতা, আমাকে বিহ্বল করে দেয় ।
হৃদয় আমারো ক্ষত হচ্ছে,রক্তের বন্যা বইছে, চোখে জল ঝরছে,
তবু আমি যে আর  মায়ায় বাধতে চাই না হে বৈষ্ণবী।


হয়তো ভাবছো আমি স্বার্থবাদী, এসেছিলেম কিছু দানের আসায়,.....


দানের আসায় এসেছিলেম বটে!
কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমায় ছেড়ে যেতে চাইনি আমি।


নপুংসক শোষকের সমাজে তোমার আমার জন্ম,
এখানে কেউ মেনে নেবেনা আমাদের প্রেম, সম্পর্ক।
তুমি যেমন পিতার সম্মান, বংশ মর্যাদা, উলঙ্গন করতে চাও না;
তেমনি আমিও যে আমার নাস্তিক ধর্ম ত্যাগ করে, মানুষের থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারিনা।


তাই অভিমান ভরা মনে শত কষ্ট বুকে ধরে,
আজ চলে যাচ্ছি মানুষকে ভালোবাসে মানুষের কাছে কবি হতে।


তুমি কেঁদনা হে আমার বৈষ্ণবী, আমি তোমার।
চিরকাল তোমাকে বুকে নিয়ে, নির্ভীক সাহসিকতায় দূর দিগন্ত থেকে-
দিগন্তে দেবো পাড়ি।


যে দেশে হানাহানি যুদ্ধ নেই, অপসংস্কৃতি নেই, যে দেশে জাত পাত ভেদাভেদ নেই,
আছে কবি ও কবিতার সম্মান-শ্রদ্ধা ;
আমি সেখানেই যাবো,  তোমাকে নতুন করে খুঁজে পাবার অভিলাষে।


কষ্ট পেওনা আমার লক্ষ্মীটি,
আমি আবার আসবো ফিরে তোমার দ্বারে কোন একদিন।
সেদিন দান নিতে নয়,
স্বয়ং  দান হয়ে ঝরে পড়তে তোমার চরণে।


আমার কবিত্যের খ্যাতি,  
আর পুরষ্কার সরূপ সুন্দর সমাজ তোমার চরণে যে দিন অর্পণ করতে পারবো;
সেদিন আমি তোমার হাত ধরে, পায়ে পা মিলিয়ে, বেলা শেষের পথ ধরে হারিয়ে যাবো ধ্রুব তারার দেশে।



✍-উজ্জ্বল সরদার আর্য
রচনাকাল ২৪ নভেম্বর ২০১৯ সাল
বাংলা ৭ অগ্রহায়ণ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ (রবিবার)
সকাল ১০ . ১০ মিনিটে
দাকোপ খুলনা বাংলাদেশ।