কোকিলা
    ✍-উজ্জ্বল সরদার আর্য


সনাতন-শাস্ত্রীয় নিয়ম নীতির প্রতি শ্রদ্ধা শীল, গতানুগতিক, বৈদিক-ব্রাহ্মণ বংশের মেয়ে আমি।
জন্মের পর পিসিমা নাম রেখেছিলেন "পিক"।
তাই অনেকে আনন্দ করে,
মাঝে মধ্যে কোকিলা বলেও ডাকে।
কিন্তু কেন জানি, শুনতে বেশ ভাল'ই লাগতো।
শুধু হাসতুম, আর এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভাবতুম;
সত্যি যদি কোকিলা হয়ে কুহু- কুহু সুরে,
গান গেয়ে  উড়ে যেতে পারতুম ওই দুর-দিগন্তে নীল অন্তরীক্ষে।


কিন্তু শাস্ত্রে আছে বেশি আশা, নিরাশার একমাত্র কারণ।
ঠিক তেমনি আমারো জীবনে ছিলনা একবিন্দু স্বাধীনতা।
নানাবিধ শাস্ত্র পাঠ,পূজা অর্চনা,
এমন কি বিদ্যালয় ছুটির পর
কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হত সর্বদা।
কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারো চোখে চোখ রেখে
কথা বলার সাহস পাইনি ।
কখনো বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা, আড্ডা,
ঘুরতে যাওয়ার সৌভাগ্য হইনি।
হাসি-খুশি, সরল,সাদা-সিধে,নম্র-ভদ্র, সুন্দরী একটা মেয়ে আমি।
একাকীত্ব যন্ত্রণায় তিলে-তিলে ক্ষত হই,
তবুও কখনো স্বাধীনতার সংগ্রাম করতেই পারিনি
নিজ পরিবারের মাঝে।


আমার ধনী পিতা এবং ভ্রাতা
কেবল খুঁজে চলেছে সমাজের বুকে অগাধ সম্মান,
এবং ধনসম্পত্তি।
বৈদিক-ব্রাহ্মণ অনুসারে  সমাজে পাণ্ডিত্য খ্যাতি,যশ বেশ আকাশ ছোঁয়া।
কিন্তু শাস্ত্রে আছে অত্যধিক জয় কখনো-কখনো জীবনে   এনে দেয় অহংকার,
আর অহংকারে আবদ্ধ ব্যক্তি দুর্বল দের প্রতি নিষ্ঠুর শাসন -শোষণ, অত্যাচার করেও
নিজেকে সবচেয়ে জ্ঞানী এবং ক্ষমতা বান মনে করে।


আর তার উদাহরণে আমার প্রিয়জনদের প্রাণে,
প্রেম বিকাশিত হইনি কোনদিন।
রক্তিম সূর্য পৃথিবীর আঁধার সরিয়ে স্নিগ্ধ সুন্দর সকাল এনে দিতে পারলেও,
তথাকথিত সামাজিকতা নামক অসামাজিকতায় জড়িত হিংস্র মানসিকতা মানুষের  মনের অন্ধকার কোনদিন সরাতে পারেনা।
তাই শত কষ্টে বাড়ির ভিতরে নিজেকে খুঁজে নিতে হয়েছে, নিজের ভালোলাগা।
সকলের আদেশ অক্ষুন্ন রেখে, নির্যাতিত হতে-হতে যৌবনের প্রারম্ভে ভুলে গিয়েছিলাম, আমার একটা জীবন আছে।


সকল বেদনা একত্রিত হয়ে কখনো কখনো প্রতিবাদী প্রশ্ন ঝড় তোলে আমার শোষিত-নিপীড়িত প্রাণে।
কিন্তু, বলার সাহস না থাকায় বলতে পারিনি কোনদিন।


তবু আজ উত্তর চাই, বলো, বলো হে পণ্ডিতগণ ---


তোমরা  মন্দিরে নারীর প্রতিমা গড়ে,
              পূজা করে,
পুরোহিত সম্মান এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বলে, এতই যদি অহংকার করো;
তবে নিজ ঘরের জীবিত  দেবীদের এমন অবস্থা করে রাখতে,
তোমাদের লজ্জা এবং জ্ঞানের হানি হয় না?


নিজে-নিজেকে পূজারী গণ্য করে
বাস্তবে তোমারা যে মহাশক্তি-মহামায়া'র পূজা করো,
এ-কেবল তোমাদের  মিথ্যা আচার নিষ্ঠা, আর ধর্ম অন্ধ যত সব ভণ্ডামি।
বাস্তবে তোমরা পূজারী কোনদিন হয়েই ওঠোনি,
তাই পূজা'র প্রসঙ্গ তুলে ধরাও বৃথা।


মৃত স্বামী দগ্ধ শ্মশানে জীবিত স্ত্রীর পুড়িয়ে মারার মত জঘন্য কাজ,
একমাত্র তোমাদেরি সাজে।
কারণ জীবন, সংসার এবং ধর্ম যে একটা বোধের বিষয়,
বা উপলব্ধির দরকার,
তা তোমাদের জ্ঞানে পৌঁছায়নি এখনো।


তোমাদের হৃদয়ে করুণা নেই, কারো আর্তনাদ শুনতে পাওনা তোমরা।
নিষ্ঠুর হৃদয়ে সমাজের নামে  নতুন-নতুন শাসন , শোষণ
আইন ব্যবস্থা তৈরি করতে শুধু ব্যস্ত।  


কিন্তু মনে রাখা উচিত  সমর্পণ, আত্মনিবেদন, শ্রদ্ধা ,ভক্তি পরিপূর্ণ  ব্যক্তি'ই কেবল হয়ে ওঠে বাস্তবে প্রেমের পূজারী।


তাই যে সমাজে এদের মত মানুষ করে বসবাস,
সেখানে আমার মত ধীর-স্থির একটা মেয়ে কে বেশি দিন বেচে থাকার কথা নয়।


সত্যি কি আমি বেচে আছি?


যে জীবনে স্বাধীনতা নেই, প্রেম নেই, আনন্দ নেই,
আছে আঘাত, আর নিষ্ঠুর অবহেলা ---
সে কি করে জীবিত থাকতে পারে?


হয়তো তোমাদের চোখে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চলা আমি এক জীবিত মানবী।
জেনেছ মুক্তি চাই,তবু মৃত্যু নেই ;
যত করছো পরম্পরা সামাজিক দায়িত্ব পালন, তত হচ্ছে  এই সমাজে নারী নির্যাতন।


তাই বসন্ত যখন তোরণ দ্বারে প্রবেশের অপেক্ষায়,
ঠিক তখনি প্রেমহীন প্রাণে বিবাহ'র ফুল ফোটাতে বাধ্য  করলো শীতের জীর্ণ-শীর্ণ অটবী শাখায়।


তবু ভাবতে বসি অবুঝ বালিকা বেলায় নির্জনতায়,
হয়তো  স্বামী মানে সঙ্গী।
গোধূলি বেলায় যে পথে একা হেটে যাই,
সে পথে কারো  পায়ে পা মিলিয়ে হাটতে পারাটা'ই
জীবনের সার্থকতা।


তাই অন্তরালে অধরের স্মিত হাসি যে কাউকে বলে দেয় আমি খুঁজে পেয়েছি প্রাণের পরিপূর্ণতা।
অন্ধকার নির্জন ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে নিজ রূপ সজ্জিত করা,
আর কল্পনায় দেব কুমার কে প্রাণে বসিয়ে গল্প করা
সকলকে বুঝিয়ে দেয় আমি আনন্দিত।


ভেবেছিলুম এবার জীবন থেকে কমবে হয়তো একটু
শাসন-শোষণ, দায়িত্ববোধ।
এবং খুঁজে পাবো নতুন গৃহে  একটু বেচে থাকার স্বাধীনতা।


কিন্তু কল্পনায়  কেবল সবকিছু সুন্দর,
বাস্তবে কেউ আমায় বোঝেনা কোনদিন,
হয়তো কেউ আর বুঝবে না।
কারণ পুরুষ শাসিত এই সমাজে চিরকাল অবহেলিত হলো নারী।


হতে পারি আজ আমি শাখা, সিন্দূর,শাড়ি  পরিধানে এক সুন্দরী বধূ- এই সমাজের।
কিন্তু বাস্তবে পেলাম না বধূর মর্যাদা।
চেনা যানা হীন এক পুরুষকে পরিবারের নির্দেশে আপন করে নিয়েও
বাসরঘর থেকেই হয়ে গেছি তার দাসী।
স্বপ্ন ভঙ্গ জীবনে আরো নেমে এলো অন্ধকার, আরো একাকীত্ব, আরো নির্যাতন, এমন কি ধর্ষণ ।


তবু আমি জীবন ভালোবাসি, জনম কে আঁকড়ে ধরে।
প্রকৃতির প্রতিরূপ ভেবে খুঁজি নারী জনমের সার্থকতা।


তাই শত যাতনার মাঝেও নিজের ভালো থাকা খুঁজেছি নিজের মাঝে।
বাঁচিয়ে রেখেছি জীবন, গ্রহণ করছি শিক্ষা।
ফুল যতোই দলিত হয়, ততই সুগন্ধ বিকাশিত করে বিশ্বে;
এই বিশ্বাস টুকু আমাকে শক্ত হতে শেখায়, সংগ্রাম করতে হৃদয়ে বিদ্রোহ জাগায়।


কারণ আমি চাই আধুনিক সমাজ গড়তে,
মানুষকে ভালোবেসে নতুন কিছু করতে।
অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে,
তাদের মাঝে বেচে থাকার আশা জাগাতে।
আর তা তখনি সম্ভব,
যখনি শিক্ষার আলো ঝরে পড়বে এই সমাজের কোনে কোনে।


তাই জীবনের সবকিছু থেমে গেলেও,
থামিয়ে রাখিনি নিজ মেধা।
সব বাধা উপেক্ষা করে, সময় মত কলেজে ছুটে গেছি বিদ্যা লাভের আশায়।
কারণ জ্ঞান জীবনকে কেবল সঠিক পথ দেখায় তা নয়, আত্মতৃপ্তি ও করে।


একদিন হলো কি রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলুম একা।
পিছন থেকে একটা বখাটে বাজে ছেলে আমার শাড়ীর আঁচল ধরে টান দিয়ে পালাতে যাবে,
ঠিক এমন সময় সুতীর্থ ওর হাতটি ধরে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় দিয়ে বললো মাপ চা, মাপ চা বলছি.......


আমি সংকোচ হয়ে বললুম, কি করছো সুতীর্থ?
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সব মানুষেরা দেখছে
ছেড়ে দাও ওকে ছেড়ে দাও বলছি।


না, না, না, তুমি চুপ করো.....


এই সব ছেলেদের শাসন  না করাতে,
দিনদিন এদের  অত্যাচারে আমাদের মা বোনেরা অকালে মরছে লজ্জায়।
নিজেকেও পুরুষ ভাবতে লজ্জা করে আজ আমার,
লজ্জা করা উচিত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যারা দ্যাখে অসহায় নারীর ক্রন্দন।


তবু বলছি তুমি এবার ওকে ছেড়ে দাও......


আচ্ছা বেশ তাই দিলুম।


কিন্তু তোকে এরকম দুষ্টুমি করতে যেন আর না দেখি....


ক্ষমা করে দিবেন দিদি আর ভুল হবে না....


তারপর শুরু হলো কিছুক্ষণ নীরবে দুজনের পথ চলা।
সহসা সুতীর্থ বলে উঠলো...
আচ্ছা "পিক" তুমি নির্জনতায় নিঃসঙ্গ সেজে শাস্তি দাও কেন নিজ অন্তর কে  সবসময়?
আর একাই বা হেটে যাও কেন এই নীরব পথে অনন্ত যৌবনা উর্বশী বেশে?


নিঃসঙ্গ ফুল অকালে ঝরে যায়, ঝরে যাবো আমিও কোন এক মায়া হীন গোধূলি তে,
নির্জন পথে তাই হেটে যাই বিদায়ের আমন্ত্রণে।


নিঃসঙ্গ?  না,না,না, তুমি নিঃসঙ্গ নও....
অটবী'র শাখায় ফোটা ফুলেরা কখনো নিঃসঙ্গ হতে পারে না।
রূপের সৌন্দর্যে কেড়েছো পৃথিবীর মন, সুগন্ধ ছড়িয়ে তন্দ্রিত অন্তরে কামনার অমৃত ছড়িয়ে যাও  বসন্ত বায়ুতে মিসে।
তাই তো ছুটে যায় ওরা,করে হরণ ;
আমি করি বধূ বরণ..... এক পূজারী বেশে।


নারীকে করো তুমি শ্রদ্ধা, প্রণাম? এই প্রথম দেখলাম কোন এক সুদর্শন সুশিক্ষিত পুরুষ!!
ওগো তুমি পূজারী নও, আমার সত্যিকারের দেবতা।
এই সমাজ প্রকৃতি কে করছে বহুরূপী, সকল নিন্দা, অবহেলা, লাঞ্ছনা, অপমান, কলঙ্কিনী সাজিয়ে তোলে সমালোচনায়।


অদ্ভুত! তুমি অদ্ভুত!
এত সুন্দর যার চিন্তা চেতনা, আর সে কেন যে নীরব হয়ে থাকে এবার বুঝলুম।
এই সমাজ এই সংস্কার তোমার জন্য নয়।
এখানে প্রত্যেক'টা নারী প্রকৃতির প্রতিরূপ হওয়া শর্তে ও সমাজীক সম্পর্কে পেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়,
আর দুষিত মানসিকতার কাছে   দলিত হয়ে হচ্ছে ক্ষয়;
হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্তর হতে শিক্ষা,প্রেম, পূজা।


ওগো বিষণ্ণতা বহ্নি'তে দগ্ধ হচ্ছে মন,
আমি নারী, আমার নয়নে অশ্রুতে হয় প্লাবন।


আচ্ছা সুতীর্থ তুমি বলতে পারো, নিজেকে আর কতটা গুটিয়ে রাখলে আমি সতী হয়ে উঠবো এই সমাজে?
অগ্নিপরীক্ষা শুধু কি আমাদের জন্য? আর কারো জন্য কি কোন পরীক্ষার দরকার হয় না এই সমাজে?
প্রকৃতির অংশ থেকে সৃষ্টি, আজ প্রকৃতি কে করছে গ্রাস..
তাই রাহু অমর; শুধু সতী দের হয় দেহত্যাগ এই সমাজে।
আজ এই অবহেলিত দাসী নির্লজ্জের মত আত্মহত্যা ভুলে কোন এক নাস্তিক দেবতা কে খুঁজছে।


নাস্তিক হতে চাই আমি!!
আমার না আছে জাত, পাত, ধর্ম,  আর না আছে মানুষের প্রতি ঘৃণা,
আমি ভালোবাসতে চাই নারীকে, হতে চাই মুক্ত প্রেমিক,
পূজা করতে চাই তোমায়।


কি বলছো, আমায় করবে তুমি পূজা?
তাহলে মন্দিরে সজ্জিত দেবী'রা যে অসহায় হয়ে পড়বে।
নৈবেদ্য, ধূপ,প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজারী সেজে পাণ্ডিত্য ফুলিয়ে সমাজে জ্ঞানীর আসনে বসবে তবে কারা?


আমি অভিনীত ব্রক্ষ্মা ব্রত পালন করার দলে নই!
হৃদয়ে লালসা, আর সমাজের বুকে ভদ্রতার বেশ -
ভণ্ড যত সব জ্ঞানহীন পরম্পরা পূজিত পুরুষ।
ওগো, কঠোর সাধনায় খুঁজে পেয়েছি আজ যে প্রেম,
তা থেকে আমায় বঞ্চিত করো না,
ফিরিয়ে দিও না হে কোকিলা.....


এই দেখো, কথা বলতে বলতে পরিচয় জানাতে ভুলে গিয়েছি।
ওর নাম "সুতীর্থ পাল চৌধুরী"
আমাদের ক্লাসে'র বন্ধু।
জ্ঞানী গুণী এবং বাস্তব বাধি একটা ছেলে।
কবিতা এবং সাহিত্যে বেশ সুনাম অর্জন করে নিয়েছে অল্প বয়স থেকেই।
জাত, পাত, ধর্ম উপেক্ষা করে,
নাস্তিক রূপে প্রকৃত মানুষ হতে চায় --
বাঁচতে চায় মানুষের প্রাণে।


অবসরে নীরবে পড়েছি ওর অনেক লেখা।  
আজ ভরা যৌবনের তেজস্বী মাখা কবি চেহারা নিয়ে,
ওর এই সাহসিকতা এবং প্রতিবাদে আমার আনন্দের সীমা নেই।
তাই ওর চোখ চোখ রেখে, হাতটি ধরে বলেছি আজ  আমি অনেক খুশি...


এরকম রূপবতী সতী প্রাণের দেবীরা তো চায় আমার মত পূজারী কে।
যার দ্বারা আজীবন মেলে সুরক্ষা।


কিন্তু কাল তো দেবী আবারো একা হেটে যাবে এই পথে।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কত কুশীল ছেলেরা অশ্লীল ভাষায় কত কিছু বলে যায়,  রূপ যৌবনের লালসায়।
তুমি পূজারী, কয়দিন  বা আর দেবে তোমার নারী দেবিকে সুরক্ষা?


আমার অতিত জীবনের গল্প এক এক করে শুনিয়ে চলেছি ওকে।
কাল থেকে আমাকে শেষ জীবন পর্যন্ত সুরক্ষা দেবার কথা দিয়েছে।
এবং কনিষ্ঠ ধরে  পায়ে পা মিলিয়ে, গোধূলির পথে হাটতে নিয়ে যাবে দূর দিগন্তে।
রাতের  অন্ধকার সরিয়ে জীবনে এনে দেবে ভালোবাসার মুক্ত  আলো।
আজ  জীবনে  প্রথম অনুভব করছি কারো প্রেম।
প্রথম আমার মনের আসনে কাউকে বসিয়েছি,
ভালো বেসেছি....


আমার প্রেয়সী, তুমি শুধু আমার।
অনন্ত পথে হাটতে-হাটতে দুজনে যখনি ক্লান্ত,
তখনি আমরা দুজন দুজনকে পেলাম আমাদের মরু প্রাণে।
আজ আমার তুমিই সব, নাস্তিকতায়  ঈশ্বর ভুলে-
আমি তোমাকে আমার হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছি।
তুমি আমার প্রেমিকা,আমার জননী, আমার দেবী,আমার শত সাধনার কবিতা।


ওগো তোমাকে এই রিক্ত বুকে পেয়ে  জীবন পেলো পূর্ণতা।
বিশ্বাস করো, কারো কনিষ্ঠ ধরে আজও পথ চলিনি কোনদিন।
ভালোবেসে  বুকের রক্তে রঞ্জিত করা হইনি কারো চরণ। নূপুর হয়ে কারো চরণ বেড়ি দিয়ে,
আপন মনে গীত গাইতে পারিনি কোনদিন এই চলার পথে।
কত  ফুল ফোটে,কত ফুল ঝরে যায়-
তবুও ফুল তুলে কাউকে পূজা করার মত সৌভাগ্য
আমার কোনদিন হইনি।
আজ তোমায় পেয়েছি আমার প্রাণে,
আর চিরকাল তোমায় মাধবী লতায় জড়িয়ে বাঁচতে চাই।


কিন্তু আমি তো কারো বিবাহিত বধূ,
তোমার মত পবিত্র নই যে এই সমাজে।
তবে কি সুন্দরের পূজারী আমায় গ্রহণ করবে?


অপবিত্র পবিত্র বলে কিছু বুঝি না আমি,
আমার জীবন সঁপেছি  তোমার চরণে,
এবার থেকে তোমার দর্শনে হবে আমার পূর্ণ।
তাই যে নিধুবনে তুমি থাকবে না, সে নিধুবন আমার জন্য নয়।
আমি তোমাকে চাই, শুধু তোমাকে।
আমার ঘুমন্ত যৌবন যার স্পর্শে জেগে উঠেছে
যার অধরে অমৃত জমানো আছে শুধু আমার জন্য,
তাকে আমি আমার সবকিছু দিয়ে ভালো বাসতে চাই।


কিন্তু আমি ব্রাহ্মণ  কন্না হয়ে কিছুতেই বংশ পরম্পরা উলঙ্গন করতে পারি না যে।
তবুও তোমার নাস্তিক ভালোবাসার কাছে হেরে যাতে আজ কেন এত বাধ্য  হচ্ছি?
আমিও ভগবান  ভুলে তোমাকে করেছি  আপন।
আমার প্রাণ দাতা প্রেমিক, আমার পূজারী, আমার প্রেম,আমার নাস্তিক  কবি,ওগো তুমিও  যে শুধু আমার।


তাহলে এসো হে এই নন্দন কাননে, সজ্জিত পায় ঝরা বকুলের মত ঝরে যাই প্রেম নিবেদনে....


সত্যিকারের প্রেম কেবল সঙ্গ দেয় না, নতুন জীবন ও দান করে।
শীতের স্পর্শে যে ফুল অকালে ঝরে গিয়েছিল, বসন্তের প্রারম্ভে নতুন হয়ে ফুটলো  আজ তোমার নন্দন কাননে।
এখন তোমার স্পর্শে আমি উজ্জীবিত ;
আলোকিত হয়ে উঠলো আমার অনন্ত যৌবন।
তোমার দেওয়া অধরে লালায়, চুমু চুম্বনের সাক্ষর তায় দাগ কেটে গেলো তৃপ্ত মনে।
শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়ে ফুল, জল, নৈবেদ্য সাজিয়ে সমর্পণ, আত্মনিবেদনে যে করে পূজা,
সে তো আমার প্রেমিক, আমার পূজারী, আমার আত্মার অংশ।


এত সম্মানীয় যে নয়, তাকে এত প্রশংসা করে ছোটো করো না গো।
সত্যি কারে সুন্দর এবং প্রেমের পূজারী, আমি আজও হতে পারিনি
এই সমাজে এখনো অসংখ্য নারী হয় নির্যাতিত, পীড়িত, ধর্ষিত.।
সংস্কার হীন মানুষেরা নারীকে করছে অপমান, জোর জুলুমে সুন্দর দেবী সজ্জিত দেহ কে করছে ক্ষত-বিক্ষত,..
আজ নিজেকে পুরুষ ভাবতেও লজ্জা করে।
বুকে রক্ত ঝরে, বিদ্রোহ জাগে,
তবুও পরাজিত হই বারবার ক্ষমতা শীল অসামাজিকতার কাছে।
তবে একদিন সকল বাঁধার ঊর্ধ্বে গিয়ে, তোমার হাতটি ধরে গড়বো আধুনিক সুন্দর নাস্তিক সমাজ।


তাহলে থেমে আছো কেন? এই সমাজের নিষ্ঠুর আইন ভেঙে আমাকে নিয়ে চলো তোমার সাথে।
মনে-প্রাণে, শরীরে এক হয়ে মিশে থাকবো অনন্ত কাল আমার নাস্তিক দেবতার কাছে।


যাবো, সত্যি একদিন জঘন্য এই সমাজ দলিত করে  ভালোবাসার হাত ধরে লিখবো অমর গীতাঞ্জলী।


তাহলে আজ বিদায় দাও,স্বাধীন সংগ্রামে উজ্জীবিত জীবন প্রেমের প্রদীপের আলোয় ছুটে চলুক নতুন পথে নির্ভীকতায়।


ওগো বিদায় কেন বলছো? প্রাণের সাথে প্রাণ মিশিয়ে প্রেমে ভেসে চলা সাগর জলে  বিদায়ের ঢেউ অন্তর কে ক্ষত করবে,
তাই বিদায় নয় বলো আসি  .....


তারপর থেকে বসন্তের অপেক্ষায় বুকে আশা বেধে বসে আছে কোকিলা।
ফুল ফুটবে, তুমি আসবে, আর তোমার হাতটি ধরে হারিয়ে যাবে
নতুন সমাজে, নতুন দেশের উদ্দেশে দুর-দিগন্তে।


কিন্তু হে কবি, দিন ফুরিয়ে এলো আজ কাল সন্ধ্যা,
তবুও তোমার কোন খবর মেলে না।
তবে কি ভুলে গেছো প্রেম?  ভুলে গেছো কাব্য? ভুলে গেছো লিখতে গীতাঞ্জলী?


তুমি বলেছিলে, মনের জীর্ণতা সরিয়ে তোমায় বাঁচতে হবে,   নিজেকে চিনতে হবে, জাগতে হবে শোষিত সমাজে।
যেদিন  নিজ দুঃখ ভুলে, সমাজের সকল মানুষের কষ্ট বুকে ধারণ করে নিজেকে যোদ্ধা রূপে প্রস্তুত করবে;
সেইদিন এই পূজারী মধ্য রাতে কান্না ভুলে যাবে,
অনুভব করবে নাস্তিক জীবনের সার্থকতা।


তবে কি আজও  তোমার নাস্তিক ধর্মের পূর্ণতা লাভ হইনি?
সারাটি জীবন নিজেকে ক্ষয়ে, সুন্দর সমাজ গড়ার প্রতিজ্ঞা বদ্ধ  হয়েও কি পারিনি তোমার মনের মত হতে?
তবে কেন জাগালে আমার ঘুমন্ত হৃদয়? কেন দেখালে মিথ্যা স্বপ্ন?
অনৃতভাষী তুমি,
আমার বিশ্বাস কে দলিত করে আজ হারিয়ে গেলে হে আমার প্রিয় নাথ।


হয়তো  তুমিও ওদের মত আজ ঈশ্বর বিশ্বাসী হয়ে গেছো,
কারণ তুমিও ও যে এই সমাজেরি পুরুষ।
তবে এটুকু জানি তুমিই সত্যিকারের পূজারী।


সমাজের  নপুংসক দের প্রতি অভিমান করে,
ওগো কেন গেলে আমাকে এভাবে একা ফলে?
আর কেন, কেন দিলে আমাকে বিরহ দণ্ড?
তোমার ভালোবাসায় যে কোকিলা কণ্ঠে প্রেমের  সুর  বেধেছিল,
যে নিধুবন তোমার আদরে ঝলমল করে উঠেছিল একদিন,
আজ সেখানে শুধু শূন্যতা।
অতৃপ্তার দহনে দগ্ধ হতে-হতে আমার নিষ্প্রাণ নয়নে আজ আঁধার নেমেছে।
তবে কেন করলে নাটকীয়তা?
আর কেন'ই বা কবিতায় আমাকে দেবী রূপে একে নতুন জীবন দিয়ে অমর করলে?


যে শূন্যতা বুকে নিয়ে রিক্ত পথে একা হাঁটছিলুম ,
সে পথে এসে আমার হাতটি ধরে অধরে, বুকে, ললাটে চুম্বন একে  প্রাণে প্রেম জাগিয়ে,
আজ কেন শ্মশানের দহনে আমাকে দগ্ধ করছো?
আর কত হবে এই সমাজে দেবী দলিত? আর কত হারাবো  বেঁচে থাকার আশা? আর কত থাকবো তোমার অপেক্ষায়?
আমি আমার অসহায়  জীবনের  অপূর্ণতা আর সহ্য করতে পারছিনা।
তাই তোমার বিশ্বাস ঘাতকতা, সমাজের অবহেলা,
এবং তোমায় ভালোবেসে সতী হীনা অপবাদ মাথায় নিয়ে, গোধূলি বেলায়  তোমায় বিদায় জানিয়ে,
আজ জীর্ণ ফুলের মত ঝরে যেতে প্রস্তুত হলাম কাল যাত্রায়.........



✍-উজ্জ্বল সরদার আর্য
রচনাকাল ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ সাল
বাংলা ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ (রবিবার)
সকাল ৬.৩০ মিনিট
দাকোপ খুলনা বাংলাদেশ।