চিঠি /
    প্রিয়ন্তী
    ✍-উজ্জ্বল সরদার আর্য


প্রাণের প্রিয়ন্তী, প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললো এসেছি
খুলনায়। দীর্ঘ-দিনের সুপরিচিত এক বন্ধুর আমন্ত্রণে তার
বাসায় আছি। আজ সন্ধ্যায় তোমার দেখা করার কথা
ছিল ‘বই মেলায়’। কিন্তু তুমি দেখা করলে না।
কাল সকালে ফিরে যাবো বাড়িতে। পিসিমা খবর পাঠিয়েছে
মায়ের শরীর ভালো নেই। তুমিতো জানো, ঠিক মত ওষুধ
খেতে চায় না। শুধু বাহানা তার একমাত্র পুত্রবধূকে দেখবে।
নিজ গহনায় সাজিয়ে ‘শ্রী লক্ষ্মীকে’ নিজ হাতে বরণ করে ঘরে
তোলার এক মাত্র ইচ্ছে।


আজ এই নীরব-নিশুতি রাতে, কেন জানি বড্ড তোমার কথা
মনে পড়ছে! মনে পড়ছে সকল স্মৃতি। সেই কবে কখন
আমাদের দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল, কবে থেকে শুরু
হয়েছিল আমাদের একসাথে পথ চলা ইত্যাদি কত কি।
আজ শুধু জানতে ইচ্ছা করে, কেন চলে গেলে? কেন সেই
কলেজের নবীন বরণ উৎসবে প্রথম তোমায় দেখে চোখ
সরাতে পারিনি? কেন এই অবুঝ মনে তোমার প্রতি প্রেম,
সমর্পণ, আত্মনিবেদন সৃষ্টি হলো? কেন, কেন আমি আমার
সবকিছু দিয়ে তোমায় এভাবে উন্মাদ হয়ে ভালোবাসি?


আজ এসব হাজারো প্রশ্নের কোন উত্তর নেই, নেই কোন
মীমাংসা। স্মৃতিবিজড়িত পথে আকুল প্রাণে করি অপেক্ষা।
যেখানে প্রজাপতিরা রোঁদ মাখে ডানা মেলে, যেখানে বসন্ত
রং ঝরায় হরিণী চোখে। ঠিক এরূপ স্থানে দাঁড়িয়ে আমার
হাতের উপর হাত রেখে একদিন স্মিত মুখে বলেছিলে,
তুমি ফুল ভালোবাসো তাই না? আমি উত্তরে হ্যাঁ বলতেই,
তুমি বলেছিলে তোমার বাগানে কখনো ফুলের অভাব হবে না। 


অবুঝ কণ্ঠে বলেছিলুম, যেমন? নব যৌবনের তেজ যেভাবে
তোমার চোখে-মুখে-শরীরে ঝকঝক করছে,আর কবিত্বের যশ
খ্যাতি দিন-দিন যেভাবে আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে,
তাতেতো তোমার মত সঙ্গী কেই খুঁজে নেবে সুন্দরী মেয়েরা।
আমি স্মিত হেসে বলেছিলুম মন্দ বলনি, রাহুর দশায়
সঙ্গিনীর অভাব,আর যাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি
সেইতো আমায় বোঝে না।  


প্রিয়ন্তী, আমি জানি সেদিন কেন তুমি এভাবে বলেছিলে।
আমার হাতটি ধরে পথ চলতে তোমার ভয় বা লজ্জা
করলেও হৃদয় তো চায় আমার এমন ভালোবাসা পেতে।
আর মহামায়া শক্তিতে আমাকে বেঁধে রাখতে।
যদিও সম্মুখে কোনদিন তোমার অন্তরে এক বিন্দু ঈর্ষা
জাগাতে পারিনি। সমালোচনায়, প্রশংসায় উঠে এসেছে কত
মেয়ের নাম। তবুও তুমি একাগ্র চিত্তে দিন কাটিয়েছ আমার
মঙ্গল কামনায় ঈশ্বরের পূজায়।


ধনী এবং ভদ্র পরিবারের সুশিক্ষিত মেয়ে তুমি। বংশের
আদর্শ লঙ্ঘন করতে চাওনি কখনো।হয়তো তাই আমায়
দিয়ে চলে গেছো পূর্ণ স্বাধীনতা। আর আজ মা খোঁজে পুত্রবধূ,
আমি খুঁজি আমার প্রিয়ন্তী কে।
হয়তো এই অপূর্ণতা অন্তরে নিয়ে, চলে যেতে হবে পৃথিবী
ছেড়ে আমায় একদিন। তাই-অনেক দিন পর না পাওয়া
বেদনা বুকে নিয়ে,অশ্রু ঝরাতে-ঝরাতে আজ কলম ধরলুম
হাতে। অতি সৌভাগ্যবান হওয়ায় দেখা হলোনা,তাই শেষ
চিঠিতে জানিয়ে  গেলাম আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে
তোমার প্রতি শত শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।


আজ অন্তত অভিমান করে থেকো না লক্ষ্মীটি। জানি, চিঠি
খানি হাতে পেলে কান্নায় তুমিও ভেঙে পড়বে। অন্তরালের
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সারাটি জীবন মুখ চেপে হেসে-কেঁদে
আমাকে বিদায় দিয়েছো।
কিন্তু,কি এমন খুঁজে পেলে আমাকে কষ্ট দিয়ে? আর-কেন বা
নিজে-নিজের অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করে সারাটি জীবন রক্ত
ঝরালে?


তুমি বলতে, আমাকে নতুন পথের নির্ভীক সৈনিক করে গড়ে
তোলার মাঝেই নাকি তোমার আনন্দ। আর তা তখনি সম্ভব,
যখনি দেশ জুড়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে, ছড়িয়ে পড়বে
অসংখ্য কবিতা সকলের মনে। আর সঙ্গে থাকলে তা
কখনোই সম্ভব নয়। কেননা ফুল যতই পদদলিত হয়,
ততই সুগন্ধ বিকাশিত করে বিশ্বে।


এমন কঠিন যশ খ্যাতি প্রাপ্ত করে আমি কি করবো? কি হবে
বা তা দিয়ে? যদি কিনা তুমিই না থাকো পাশে।প্রভাতি পুষ্প
আর অশ্রু জলে যে পূজারী তোমার চরণে দিবারাত্রি মাথা
ঠোকায়, সে-কি ভাবে তোমায় ছাড়া বাঁচবে বলতে পারো
প্রিয়ন্তী? প্রেম নাকি কবিদের শক্তি হয়, আর আমার প্রেম
নামক সত্তা কেড়ে নিয়ে, কেন-কেন শক্তিহীন করে দিলে?


আজ অপেক্ষার প্রহর গুনতে-গুনতে আমি ক্লান্ত। মন বলে এই
তুমি আসবে, তুমি ফিরে আসবে'ই-আসবে। কিন্তু, আর
কোনদিন তুমি ফিরে এলে না দেখা দিলে না। তবে কি তুমি
আমাকে একেবারে ভুলে গিয়েছ?
ওগো আজও তুমি আছো আমার কল্পনায়, গোধূলি গগনের
ধ্রুবতারার আলোয়। আমার সাধনা, আমার যাতনা,
আমার অভিমানের অশ্রু ধারায় মিশে।


প্রিয়ন্তী, তোমার স্মৃতি বুকে নিয়ে আর কতদিন ওই প্রাচীন
বাড়িতে পড়ে থাকবো? যার সর্ব স্তরে কেবল ফাটল আর
ফাটলে পরিপূর্ণ। আজও পড়ে আছে রুমে শত-শত কবিতার
বই,এবং ধুলা বালুতে ঢেকে গেছে আমার লেখা জীবনের
ফেলা আশা অতীত গল্পের পাতা গুলি। আজ নিজেকে মনে
হয় আমি মৃত্যু! আমার একটি মাত্র ছায়া-প্রত্যাশার জাল বুনে
ছুটছে পথে পথে।


সত্যি বলতে আজ আমাকে  দেখে তুমি অবাকই হবে, কেননা
কত নির্ভীক প্রেমিক হয়ে গিয়েছি স্বল্প দিনেই তোমার এই
পৃথিবীতে। যে লোহিত রক্তাক্ত অধরে, চুমু-চুম্বন করে, একের
পর এক জ্বলন্ত সিগারেট কে করছি ভস্ম।
এখনো দিন শেষে’ কবির বেশে’ ঘর ছেড়ে যখনি বেরিয়ে
পড়ি, তোমার স্মৃতি গুলি ধরা দেয় আমার অশ্রু সিক্ত চোখে।
দুয়ারে থাকা শারী শারী নানা রকম ফুল গাছ গুলিতে আজও
অফুরন্ত ফুল ফোটে। কিন্তু, তারা আজ নিজেরাই নিজেদের
মত করে ঝরে পড়ে যায়।
আমি মালা গাঁথা ভুলে গিয়ে এদের কুড়িয়ে নিয়ে, তোমার
নামে নদীর জলে ভাসিয়ে দেই। তারপর খুঁজতে থাকি
আকাশে, বাতাসে, তোমার সুগন্ধ। অন্তরালে থাকা প্রকৃতির-
প্রতিরূপ সজ্জিত তোমার 'মুখ ।


এখন ইচ্ছা করে চলে যাই বহুদূরে ‘মৃত্যু লোকে’। যেন
অপূর্ণতা প্রেমের আগুন নিভে যায় তৃষিত অন্তরে। আমি যে
আর পারছিনা। তবে সত্যি যেদিন চলে যাবো, সেদিন আমার
নামে শ্মশানের দহন দগ্ধ দেহে দুফোটা অশ্রু দিও। যোগ্য
হীন জীবনের আশা যদিও সব মূল্যহীন।
পাওয়া, না পাওয়ার অতৃপ্ততা অন্তর কে বিহ্বল করে দেয়।
আর তুমি দিয়েছো একে প্রেম আক্ষা? আজ সঙ্গ দান নেই,
শুধু স্মৃতি সন্নিধানে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করে প্রেমিক হওয়ার
ইচ্ছা আমার রয়ে গেছে।


তাই  অবহেলা এবং অপমান ভুলে গিয়ে আমি শুধু তোমায়
ভালোবাসি। তোমার গন্ধ, তোমার রূপ, তোমার সুন্দরতাই
আমার অহংকার।
জানি, ভুল করে কেউ যদি ভালোবাসে ফুল তুলতে যায়, তবে
অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত তাকে রক্ত দিয়ে করতে হয়।
কিন্তু প্রিয়ন্তী, আমি তো তোমার অন্তরে প্রেমের পদ্ম ফোটাতে
চেয়েছিলাম,ফুলকে ছিঁড়ে বিনষ্ট করতে চাইনি কখনো। তবে
আমাকে কেন দিলে যাবজ্জীবন বিরহ দণ্ড?


আর আসবো না তোমার খোঁজে তোমার শহরে কোনদিন,
 তুমি আছো আমার অন্তরে, আঁখির জলে,এবং বিরহবিধুর
বুকের রক্তে। জানিনা, তোমার স্বপ্ন কতটুকু পূর্ণ হয়েছে।
কিন্তু, শুধু এটুকু জানি দলিত পুষ্প কখনো কারো পূজার
যোগ্য হয়ে উঠতে পারে না।
তাই তাকে মনের সকল আশা ভুলে, পরলোক পথে যাত্রা
করতে হয়।
হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না, কথা হবেনা,
এভাবে অশ্রু আর কলমের কালি এক করে শেষ হবে প্রতিটা রাত।
তবুও তোমার জন্য আছে আমার অফুরন্ত ভালোবাসা,অনেক-
অনেক ভালো থেকো।
  


                         ইতি তোমার ভালোবাসার কবি।


✍-উজ্জ্বল সরদার আর্য
রচনাকাল ২০ জানুয়ারি ২০১৯ সাল
বাংলা ৬ মাঘ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ (রবিবার)
দাকোপ খুলনা, বাংলাদেশ।