আজ বহুদিন পরে নিতুকে কাঁদতে দেখলাম
কাঁদতে ওকে ভুলিয়ে দিয়েছিলাম। বহুদিনের প্রগাঢ় ভালবাসায়।
শুধু বুকে মুখ লুকিয়ে
মাঝে মধ্যে অভিমান করত। মিছেমিছি।
নিঃশব্দে এককোণে চুপচাপ ও কেঁদেই যাচ্ছে
অথচ আজ ওঁকে একটুও থামতে বলতে পারছি না।
ইচ্ছে করছে গালে দু’হাত দিয়ে মুখটা টেনে
মৃদু একটা ধমক কষে বলি “ধুর পাগলি”!
এভাবে কাঁদে? জানো না?
কাঁদলে ধুয়ে যায় চোখের কাজল?  
লোকে বলত, কুখবর বাতাসের আগে নাকি ছোটে
হয়তো সত্যিই।
মৃত্যুদূতের সাথে আমার প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ
চাক্ষুস করতে কত মানুষ এসেছেন।
ওপাড়ার হরেন কাকা, অফিসের বড় সাহেব।
পাড়ার মুদী দোকানদারও বাদ পড়েনি।
আমার কাছে তিনি সাতাত্তরটি টাকা পেতেন। মুদি সওদা বাবদ
আমি এত গলা ছেড়ে বলতে চাইলাম সবাইকে
পরপারের যাত্রী এই আমার ঋন শুধতে।
কেউ আমার নিঃশব্দ আহবান শুনতেই পাচ্ছে না।
অথচ বেঁচে থাকতে.............
সময় কত দ্রুত বদলে যায়, না?
মতির মা, আমার উপাধি ’লাশ’ হবার পরে
কী সুন্দর ঘুরে ঘুরে সবাইকে আমার
শেষ সময়ের বাঁচার আকুতির গল্প
বেদনাবিহীন শোকাশ্রু নিয়ে বারবার সোৎসাহে বলে যাচ্ছে।
একটুও ক্লান্তি নেই তার আজ।
”জানেন, একটুও নেয়নি ইশ্বরের নাম.........”
অথচ বেঁচে থাকতে.............
বাসার ঘুলঘুলিতে দুটো চড়ুই বাসা বেঁধে থাকত
ওদেরও আজ একটু বিব্রত দেখলাম।
যা কখনোই হয়নি তারা। রাতে বা দিনে যখন তখন সোহাগ বিনিময়কালে।
মাত্রই সংসারে নতুন অতিথি এসেছে ওদের
অথচ তাদের আশ্রয়দাতার আজ শেষ বিদায়
উত্তরাধিকার আগমনের কিচিরমিচিরটা
তারা প্রাণখুলে উপভোগ করতে পারছে না।
ওইতো বড়ই পাতা এসে গেল। ”তাড়াতাড়ি দাও”-হাঁকে কে যেন
ফিসফিস করে সবাই আমাকে পূতপবিত্র করে
শেষ বিদায় দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
চিরকাল কুসুম গরম পানি ছাড়া
চান করতে পারতাম না। যাক
শেষ বেলায়ও আমার পছন্দটুকুর মূল্য দিচ্ছে তাহলে সবাই।
দুর ছাই এসব ভাবছি কী?
পছন্দ অপছন্দের অনেক উর্দ্ধে চলে যায় যারা
তাদের আবার এসব ভাবনায় কাজ কী?
তবু জানেন? আমাকে নিয়ে সবার এই ত্রস্ত ব্যস্ততায় কিন্তু
বেশ গর্বই হচ্ছে একটু একটু। নিজেকে
বেশ গুরুত্বপূর্ণ কেউ একটা ভাবতে পারছি।
বেঁচে থাকতে যা ছিল শুধুই বেঁচে থাকা।
দিনের পিঠে দিন রাতের পর রাত। একঘেঁয়ে পড়ে থাকা।
আরতো মোটে কয়েকটা মুহূর্ত
জল বাতাসের এই রঙ্গমেলায়। তারপরই দু’চোখের পাতা এক করে
চিরনিদ্রায় হারাব পরম নির্ভরতায়। তবে আর কিসের অপেক্ষা?
শুধু নিতুকে কাঁদতে মানা করা হল না।
আর ওকে বলে যেতে পারলাম না, ভালবেসেছিলাম তোমায়
পাগলের মতো। আজও বাসি।
মৃতেরাও ভালবাসতে পারে।
হয়তো জীবিতদের চেয়েও বেশি।
তবু এখনো ভালবাসি।