ঠিক ফেব্রুয়ারিটা এলেই যেন আমাদের বাংলাভাষা চর্চার প্রাবল্য, উৎসাহ আর অনেকটাই বুঝি দেখানেপনার রমরমা প্রচারণা, ব্যবসা ইত্যাকার নানা প্রপঞ্চ ও প্রবণতা চোখে পড়বেই কি পড়বে। অনেক পুরুষেরও মানসিক স্তনবৃন্ত টনটন করে উঠবে বাংলা ভাষা, এর বর্তমান, ভবিষ্যত ইত্যাদি নিয়ে আকুল হয়ে কিছু বলার ইচ্ছেয়, কিছু লেখার তাড়নায়, কিছু প্রকাশের বেদনায়। মর্দে মুমিনেরা উর্দুর জন্যে হাহাকার করেন না বোধহয়, কারণ পালের গোদাটিকে অনেকদিন ধরেই 'ভাষাসৈনিক' বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বর্তমান। এবিষয়ে অফটপিক হলেও প্রয়াত শওকত ওসমানের একটা যুৎসই মন্তব্য স্মরণে না এনে পারি না, "বেশ্যাও একদা সতী থাকে!" মন্তব্যটি তাঁদেরই এক দ্বিনি ভাইয়ের কাছে করায় তাঁর মারমূর্তিও যথেষ্ট দর্শনীয় হয় বটে। যাগগে, দে গরুর গা ধুইয়ে।
যা বলছিলাম, মাতৃভূমির স্বাতন্ত্র্য, সম্মান আর স্বাধীনতা বজায় রাখতে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের কোন আপত্তি না থাকে, তবে, মাতৃভাষার শালীনতা বজায় রাখাও কি বাঞ্ছনীয় নয়? আমি উপভাষার বহুল প্রচলন নিয়ে এখন কিছু বলতে চাইছি না, বস্তুত, বাংলা চলিত রীতির বর্তমান উত্থান কিন্তু এক বা একাধিক বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত উপভাষার সম্মিলিত মিখষ্ক্রিয়া। তবে, যাঁরা অন্তত প্রমিত বাংলায় লেখেন, তাঁদের বাংলা বানানের কিছু নিয়মের কথা (যে-সংক্রান্ত ভুল প্রায়ই চোখে পড়ে এবং কিছু মানসিক কষ্টপ্রাপ্তি হয় অনুষঙ্গ) এবং কিছু ব্যাকরণমূলক নিয়মের কথা জানানো্ই আমার এই ব্রগের প্রথম প্রয়াসটির উদ্দেশ্য। আশা করি, নিয়মগুলো মানুন না মানুন, একটু চোখ বুলিয়ে জানলে ভাষার ভুল ব্যবহার সম্পর্কে অন্তত কিছুটা হলেও সচেতন হবেন।
১) বানান সংক্রান্ত দু'চার কথাঃ
ক) যুক্তাক্ষর সংক্রান্তঃ
- আধুনিক নিয়মানুসারে যুক্তবর্ণ যথাসম্ভব সরলভাবে লেখার কথা, অর্থাৎ, `রূ' বা 'শু'-এভাবে, অন্যরকমভাবে নয়। অন্য রূপের যুক্তবর্ণটি এখানে লেখা যাচ্ছে না, তাই দেখাতে পারছি না। তবে, ছোটবেলায় পড়া 'রূপকথা' বা 'শুয়োর' শব্দটি মনে করলে ভিন্নরূপটি চোখে ভাসবে। মানে, পাশের হাতলটি হবে বা মাথার প‌্যাচটা হবে না আর কি। এমনিভাবে, যথাসম্ভব।
- `হ্ন' এবং `হ্ণ' এদুটি যুক্তবর্ণ 'হ' বর্ণটির সাথে যথাক্রমে 'ন' এবং 'ণ'-এর যুক্তরূপ। তাই, ব্যবহারটিও সেরকম হওয়া বাঞ্ছনীয়। মূলত, ব্যবহারটি সংস্কৃত ব্যাকরণের ণ-ত্ব/ষ-ত্ব বিধানের সাথে সম্পৃক্ত বিধায় এবং সে-সংক্রান্ত আলোচনা অন্যত্র করার আশা রাখি বিধায় আপাতত শুধু এটুকুই জানাই-যেখানে 'র'/'রেফ' আছে, তার পরে এই যুক্তবর্ণটি মূলত 'হ+ণ' (হ্ণ) হবে। উদাহরণঃ প্রাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ, অপরাহ্ণ, কিন্তু, সায়াহ্ন, মধ্যাহ্ন ইত্যাদি।
- 'হু', এটির ভিন্ন রূপ লিখতেও অনেকে ভুল করেন, তবে দেখা যাচ্ছে, এখানে ভুল হবে না। বলতে চাইছিলাম মাথায় প্যাঁচ-বসানো 'হু'-এর কথা। ভাবুন 'বাহু' শব্দটি। ওটি অনেকে ভুল করে 'হ'-এর সাথে 'ূ'-কারের জায়গায় বসান। প্রসঙ্গত, এই ব্লগের বানানরীতি অনুসারে 'হ'-এর সাথে 'ঊ'-কার বসালে যে-রূপটি পাওয়া যাচ্ছে, সেটি সঠিক নয় মনে হচ্ছে। মডারেটরেরা নজর দেবেন কি?
- 'ল্ব'-এই যুক্তব্যঞ্জনটির উচ্চারণ 'ল্ল' (ll)। মানে, 'বিল্ব' শব্দটির উচ্চারণ হবে 'বিল্ লো' (billo)। আর তাই, কখনোই বাল্ ব (bulb) শব্দটি লেখা যাবে না, বাল্ব। এমনকি, এই ব্লগের বানানরীতিতেও এই একই ভুল দেখতে পাচ্ছি। তাই বাধ্য হয়ে ওপরের বানানে শেষ 'ব'-টি আলাদা রাখতে হয়েছে।
- 'ন' ও 'ণ'-এর সাথে অন্য শব্দের যুক্তবর্ণেও কিছু ভুল লক্ষ্যণীয়। সেসম্পর্কে অন্যত্র আলোচনা করতে চাই। শুধু এটুকু মনে রাখুন, স্রেফ তৎসম শব্দের ক্ষেত্রেই 'ণ' বসবে। এবং, এক্ষেত্রে যুক্তবর্ণটি ধারণ করবে অর্ধমাত্রা, পূর্ণমাত্রা নয়।


খ) ই, উ ঘটিত জটিলতাঃ
- ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত রম্যলেখক ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মজা করেই (বোধকরি) বলেছিলেন,
"দুটো ন, আর তিনটে স-এর দরকারই বা কি?
মিছেমিছি বাজে খরচ নয় কি দুটো ই?
ভেবে দেখ লিখতে চোখে আসে কি না জল,
পাষাণী, বিষাণ, উমা, শরৎ, শাসমল?" ইত্যাদি, ইত্যাদি..
মানে, ঝামেলাই ঝাসেলা। তবে যেহেতু ভাষার শুদ্ধ ব্যবহারটি বাংলার সুসন্তান হিসেবে কাম্য, তাই আশা করবো একটু কষ্ট হলেও নিয়মটি একটু না হয় জানলেনই।
প্রথমটি, অতৎসম যেকোন শব্দে হ্রস্ব-ই এবং হ্রস্ব-উ এবং এদের সংক্ষিপ্ত রূপ, বা 'কার ' ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া, তৎসম শব্দের ক্ষেত্রেও যে-বানানের দুটো রূপই চলে, সেখানে শুধু হ্রস্ব রূপটিই ব্যবহার করতে হবে, যেমন- তরণি (তরণী নয়), ধমনি (ধমনী নয়) ইত্যাদি। আর অতৎসম শব্দে তো দীর্ঘস্বর ব্যবহার করাই যাবে না। যেমনঃ ইমান (ঈমান নয়, আশাকরি কারোর ওটি কমজোর হয়ে পড়বে না), ধুলো (ধূলো নয়, তবে ধূলি হবে, সংস্কৃতমূলক বলে), বীয়ার নয়, বিয়ার (Beer, পানীয়বিশেষ), ঠিক বানান, তির, তীর নয়, খ্রিস্টাব্দ, নয় খ্রীন্টাব্দ। তবে, বাংলা একাডেমি (বানানরীতি প্রণেতা প্রতিষ্ঠান) নিজেরাই তাঁদের নাম লেখেন 'একাডেমী', যদিচ কিছু পরিবর্তন এখন চোখে পড়ে। লজ্জার কথা!
একটি মাত্র শব্দ এই পরিবর্তনের হাত থেকে বোধহয় বেঁচে যাচ্ছে। শব্দটি 'ঈদ', যার হওয়ার কথা ছিল 'ইদ' (কোথাও চোখে পড়েছে কি শব্দটি, আই মিন বানানটা?)। ব্রাহ্মণেরা বোধহয় 'গরু' বানানটিও কাটতে পারেন না, না?
যাহোক, অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেললাম। রাগ করবেন না আশা করি, কারণ 'আ মরি বাংলা ভাষা', 'আয় মারি বাংলা ভাষা' নয়। আশা করি, পরবর্তী কোন এক পর্ব নিয়ে আবারো দেখা হবে।
ততদিন, আরো আরো লিখতে থাকুন, ঠিকভাবে। বড়দিন ও নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা সবাইকে।
পুঃ জীবনের প্রথম ব্লগ, ভুল-টুল হলে ক্ষমা করবেন নিজগুণে।