শব্দের কারিগর
শব্দের অনু-পরমাণুর বাতিঘর
শব্দের যাদুকর
শঙ্খ চিলের কবি
গ্রামবাংলার মাটি ও মানুষের কবি জীবনানন্দ দাশ
আকাশের শুদ্ধনীল শুভ্র মেঘের মতো
শব্দেরা অবিরাম অন্তহীন খেলে যেতো
বাংলার নির্জনতম ও শুদ্ধতম কবি
জীবনানন্দের মেধায় ও মননে


ধানসিঁড়িটির তীরে
কুয়াশার বুকে ভেসে
কাঁঠাল ছায়ায়
কিশোরীর ঘুঙুর
কলমীর গন্ধ ভরা জল
নদী মাঠ ক্ষেত
লক্ষ্মীপেচা শিমুলের ডাল
বাবলার আধার গলি
হিজলের ফাঁক
সোনালী ডানার চিল
শঙ্খ চিল শালিকের বেশে
রূপসার ঘোলা জল
ভোরের কাক হয়ে কার্তিকের
নবান্নের দেশে
এ সব ই তো তার শব্দের খেলা
যাদুর বাঁশীর সুরে আঘাত করেছে
প্রকৃতির শব্দভান্ডারে


শব্দের বেড়াজালে বন্দী কবি জীবনানন্দ দাশ
শব্দ নিয়ে খেলেছেন যাদুকরের মতো
ইচ্ছেমতো
শব্দ নিয়ে শুধু খেলতেন আর খেলতেন
খেলে যেতেন নীরবে নির্জনে নির্জলা একেবারে
'পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে'
এই তো কবি জীবনানন্দ দাশ


৯ মে ১৯৩০ ইডেন কলেজের লাবণ্য গুপ্তের সাথে
ঘর বাধেন প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ
কবি ও তার প্রেমিকা শোভনার হৃদয়ে উঠে
এক সমুদ্র ঢেউ আর ঝড়
কাঁপছিলো তাদের বুক থরথর
কম্পমান হৃদয়ের অগ্নি বারতা নিয়ে
বিয়েতে হাজির হয় কবি প্রেমিকা শোভনা ও
কিন্তু কবি ব্যাথা বেদনার ক্ষতে
প্রলেপ দিতে পারে নি
বলতে পারেনি কাউকে তার প্রেয়সীর কথা
শুধু লিখে গেছে লিখে গেছে
পান্ডুলিপির পাতায় পাতায়
এঁকেছেন নিজের অজান্তেই বিষাদের সব ছবি
এ নিভৃতচারী কবি


ক্ষণজন্মা এই কবি ১৮ ফেব্রুয়ারী ১৮৯৯ সালে
মা কুসুমকুমারী দাশ ও বাবা সত্যানন্দ দাশের
ঘর আলোকিত করে এলেন কাব্যাকাশে
উঁকি দিলেন এক ধুমকেতু হয়ে
জললেন আকাশে জ্বলজ্বল করে চাঁদ হয়ে
ইচ্ছেমতো বরিশাল শহরে
সকলের প্রিয় মিলু নামে


ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী এ কবি
ছেড়েছেন স্ত্রী ঘর সংসার
ত্যাজেছেন সব
কবিতার বিরহ তাকে দেয় উম্মাদনা উজাড় উড়াল দেবার
শুধু কবিতা কে ভালোবেসে
শুধু কবিতার অমরত্ব লাভের জন্য
সৃজন করেছেন অমর কাব্য
রচিত হয়েছে ঢের ঢের তার হাত ধরে
ঝরা পালক
ধূসর পান্ডুলিপি আর
বনলতা সেনের মতো বিখ্যাত সব কবিতা
আর প্রেমিকার মনোলোভা সব কাব্য
ভরে দিলেন ভিজিয়ে দিলেন
প্রেমিকার তৃষিত হৃদয়ের মাটি
ফলালেন ইচ্ছে মতো সবুজ শস্য কণা
প্রেমিকা শোভনের দেহ ধুয়ে
সাগরের নীল জলের ঢেউয়ের মতো
বাণ ডেকে আনলেন কাব্যাকাশে
ফুটালেন নবীন কবিতার ফুল
তার বাগানে


বাংলার মাঠ,ঘাট,ক্ষেত ভালো বেসে
আবারও আসার ইচ্ছে জাগে কবি হৃদয়ের সবুজ মনে
বুনেছিলো স্বপ্নের জাল
বাংলার মাঠ ঘাট আর জলের কবি
কিন্তু হায় এসেছিলেন যদি ও
হয়নি আর থাকা
তবুও নিছক অনাবাদি অকেজো দূর্বল ভূমির মতো
রয়ে গেলো তার এ হৃদয়ের পিপাসা আর যতো গান
মিটলো না তার কোনো সাধ আর জীবনের


অভাব অনটন আর দারিদ্র্য তাকে গ্রাস করে
অক্টোপাসের মতো
আঁকড়ে ধরেছে বারবার
কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে তাকে পিপড়ের ঢিবির মতো
দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত রক্তাক্ত
ক্ষত হৃদয়ের কাছে
পিপাসা মিটিয়ে ফেলার অসহায় হরিণের মতো
আত্মসমর্পণ কে আজও কষ্ট দেয়
কাঁদায় সব কবি প্রেমিকদের


চাকুরী খুজতে খুজতে চটির সুকতলা
ক্ষয়ে গেছে তার তবুও পায়নি
কোনো ঠাই আশ্রয় কোথাও
আধুনিক বাংলা কবিতার এ শুদ্ধতম কবি
বারবার চাকুরী খুঁজে পেতেই হিমশিম খেতে খেতে
কপালে ঘামের টিপ পরতে হয় চরম অনিচ্ছায়
মুষড়ে পড়ে সে
যুদ্ধক্ষেত্রে অসহায় সৈনিকের মতো
জীবনের শেষ ক'টি বছর চরম অর্থ কষ্টের
সাগরে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন কবি
আলিঙ্গন করে ইতিহাসের চরম দারিদ্র্যকে
প্রকৃতির নির্জনতম এ কবিকে
হারাতে হয় একটার পর একটা চাকুরী আর
বরন করতে হয় নিষ্ঠুরতম অসহায়ত্বকে


কোলকাতার
১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন স্ট্রিট
ছিলো কবির সামান্য মাথা গোজার ঠাই
কাব্য জগতে বিচরণের আপন ঠিকানা তো নয়
ভাড়া করা বাড়ি
সামর্থ্য ছিলো না ভাড়া দেবার
বাংলার নির্জনতম এ কবি
আর্থিক করুণ অবস্থার কারণে
এক নর্তকীকে তার ভাড়াকরা
বাড়িতে সাবলেট দিয়ে হেনস্তা হয় কিছুকাল
যেতে হয় তাকে উকিলের কাছে
চেয়ে তার আইনী প্রতিকার


অভাবের প্রেষনায় প্রিয়তমা স্ত্রী লাবন্য ও
বিচ্ছেদের সুর তুলে বিউগলে গান গেয়ে
বিদায় জানালো কবিকে
ঠেলে দিয়ে তিমির থেকে আরও হাজারো তিমিরে
চলে গেল সে চলে গেলো
একেবারে টালিগঞ্জে সিনেমার জগতে
তাকালো না ফিরে আর কবির দিকে
অন্ধকার বিভীষিকার মতো ঘিরে ধরে কবিকে
তলিয়ে যায় অন্ধকারের কানাগলিতে অতল গহ্বরে


বাঁচতে চেয়েছে কবি বারবার
একটু আশ্রয়ের জন্য নিরন্তর ছিলো তার ছুটেচলা
কবিবন্ধুদের কাছে
পত্রিকা অফিসে চাকুরির জন্য
করুণ আর্তি জানিয়ে চিঠি লিখে
ঝরিয়েছে নীরব নিস্তব্ধতা আর চাপা কান্নার সুর
ফুটিয়ে তুলেছেন বারবার তার বেদনার ক্ষত আর আর্তি
কিন্তু হয়নি কোনো ফল
ফোটেনি কোনো ফুল
তার হাহাকার আর শূন্যতার শব্দের বাগানে


কোথাও যাওয়ার ছিলো না কবির
পাওয়ার ছিলো না কিছু
কবি বড়ো অসহায়
সবাই এ অসহায় কবিকে ঐ দূর নক্ষত্রের কাছে
সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছে ঠেলে দেয় বারবার


ক্ষুধার্ত নির্বাক কবির বাঁচার মতো
নুড়ি আঁকড়ে ধরার এতোটুকু চেষ্টাও সফল হয়নি
পায়নি কোনো ঠাই কোথাও
আসেনি এগিয়ে কেউ তার পাশে


নির্জনতম ও নিভৃত জগতের কবি
জীবনানন্দ দাশকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়
তার শব্দের বাগানে ফুটন্ত ঝরা পালক কাব্য নিয়ে
আনা হয় অশ্লীলতার অভিযোগ
আর হারাতে হয় কবিকে
কোলকাতা সিটি কলেজের চাকুরী ১৯২৭ সালে
ধার কর্জ করে
চরম বিষাদের চিহ্ন মাখামুখে
বাড়ি বাড়ি ঘুরে টিউশনি করে
ইন্সুইরেন্স কোম্পানীর দালালী করে
মোমবাতির মতো টিমটিমে জীবন ধারণ
করতে হয় বনলতা সেনের
ইতিহাসের এ শুদ্ধতম কবিকে


জলাঙ্গীর ঢেউয়ের এ কবি তখন
বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণুদের চেয়ে বয়সে বড়ো
অথচ তার কবিতা ছাপা হতো না
ফিরে আসতো দিশেহারা
এক ঝাঁক বালিহাঁসের হতাশা হয়ে
পত্রিকা অফিস থেকে
তার লেখা কবিতা
কোনো পত্রিকা ছাপতে রাজি হয়নি
বাড়ায়নি কেউ সাহায্যের হাত
দাড়ায়নি কেউ তার পাশে


ঝরা পালক
ধূসর পান্ডুলিপি
বনলতা সেন
এর মতো ঝলমলে কাব্য
অথচ
ছাপতে রাজি হয়নি কেউ
তার এসব কবিতা
বিষাদ ছুঁয়েছে বারবার কবি ও তার কাব্যকে
প্রকাশক খুঁজে পেতেই
হিমশিম খেতে হয় তাকে বারবার
এরই মধ্যে ধ্রুবতারার মতো
এসে হাজির হয় কবি বুদ্ধদেব বসু
তার পাশে এসে দাঁড়ায় দ্বিধাহীন চিত্তে
মানবের মতো
উড়িয়ে দিলেন আলোর নিশানা
তার কবিতা ছাপানোর জন্য
ফোটালেন মুখে তার হাসি
দূরীভূত হয় তার বেদনার বাঁশী
কাব্য জগতে প্রচারবিমুখ
কবি জীবনানন্দ আবির্ভূত হয়
একখন্ড উল্কাপিণ্ডের মতো
খুঁজে পান তার জীবদ্দশায়
অসাধারণ কবির ঠিকানা
তবে পায়নি খ্যাতির শিখরে
সুড়সুড় করে উঠে যাবার সিড়ি
অবশেষে
মৃত্যুর পরে লাভ করেন
আধুনিক কবিতার পথিকৃৎ এর স্বীকৃতি ও অমরত্ব


জীবন সংগ্রামের নিঃসহায়তা
কবিকে দারুণ একটা ঝাঁকুনি দেয়
দিশেহারা হয়ে পড়েন কবি
তাকে মানসিক ভাবে কাবু করে ফেলে
একেবারে
বিপর্যস্ত হন কবি
এরই মাঝে ২২ অক্টোবর
১৯৫৪ সালে কবি বালিগঞ্জে
কোলকাতা ট্রাম দূর্ঘটনায়
বাংলার সব কবি,পাঠক ও শুভানুধায়ীদের
শোক সাগরে ভাসিয়ে
চিরতরে পাড়ি জমান অজানার উদ্দেশ্যে।