ঢাকার মেয়ে চন্দনাকে


চন্দনা, বিমানের পেটে চড়ে ক্যাঙারুছানার মতো
বহুত তো ঘুরলাম আমরা,
ওমর খৈয়ামের পারস্য, শেক্সপিয়ারের ইংল্যান্ড,
অটোমানদের টার্কি
আর অ্যাবরিজিনালদের অস্ট্রেলিয়ায়-
ঘোরাফেরা তো কম হলো না আমাদের।


যদি রাজি থাকো-তোমাকে নিয়ে এবার বেড়াতে যাবো-
বাইরে নয়,--দেশের ভেতরেই
যেখানে যেতে প্রয়োজন হবে না-
মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট
যেখানে যেতে প্রয়োজন নেই-
ভিসার জন্য ভিখারির মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা
যেখানে নেই-
ইমিগ্রেশন বিভাগের লোকজনের সন্দেহের সার্বভৌম উৎপাত;
ভাবছো কোথাকার কথা বলছি?
আমি বলছি নবাবগঞ্জের কথা।
না চন্দনা, রাজধানীর হস্তক্ষেপে অতিষ্ঠ ঢাকার নবাবগঞ্জ নয়,
দেশের পশ্চিমে-
ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়ের পাতা জুড়ে’
জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা- চাঁপাইনবাবগঞ্জের কথা বলছি আমি।


যদি যাও- চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছার আগেই তুমি পৌঁছে যাবে
যেখানে ছিল রাজা বিজয় সেনের রাজধানী বিজয়নগর-
যেখানে অক্সিজেন ওয়েলকাম জানাতে
দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা ও মহানন্দার মোহনা;
চাঁপাইয়ের মাটিতে পৌঁছেই তোমার চোখ হয়ে উঠবে বিস্ফারিত-
‘আহা হাতের নাগালে এত আম!
গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলী, আশ্বিনা!
আর এত ছায়া, এত অক্সিজেন!
একি আমাদের মাটির ভূগোল,
নাকি জান্নাতের কোনো পার্থিব সংস্করণ?’
আম খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে যদি শুয়ে পড়ো-
যদি কান পাতো ক্ষীণস্রোতা মহানন্দার জলে-
শুনবে- চম্পকনগরের বিজনেস ম্যাগনেট
চাঁদ সওদাগর বেয়ে চলেছেন
তার সপ্তমধুকর ডিঙ্গা
জাহাজের ভেতর হতে ভেসে আসে নর্তকীর গলা, নূপুরের তাল;


আর যদি মহানন্দার ব্রীজ পার হয়ে পৌঁছে যাও কানসাট,
দেখবে-সেখানে দাঁড়িয়ে আজো
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সোনালিযুগের সাক্ষী
ছোটো সোনামসজিদ;
সে মসজিদের স্বর্গশাসিত ছায়ায় শুয়ে
সেনাপতি-কবিয়াল-অলি
শুয়ে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরসহ আরও কত মুক্তিযোদ্ধা;
কানসাটের মাটিতে স্তব্ধ জোছনায় কান পাতলে
শুনতে পাবে
গৌড়সভায় বেজে চলেছে কবিয়াল নরেশ শীলের গান
অথবা
পরাগল খাঁকে পাশে বসিয়ে মহামতি সুলতান শুনে যাচ্ছেন
কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারত-
“তাঁহান আদেশে মালা মস্তকে ধরিলা
কবীন্দ্র পরম যত্নে পাঁচালী রচিলা।।’’


আর যদি ধেয়ে আসা পদ্মা পার হয়ে চলে যাও চরে-
চরনারায়ণপুর, পাকা অথবা ভূতের দিয়াড়,
সেখানের কিষাণীরা ভাবীর আদরে খাওয়াবে তোমাকে
পোড়াবেগুনের ভর্তা আর আমের আচারের চাটনি দিয়ে
মাসকালইয়ের রুটি
আহা উহু করে খেতে খেতে নেশা ধরে যাবে তোমার
রাতের ডিনারে ভাতের বদলে চাইবে তুমি
ভর্তা আর মাসকালাইয়ের রুটি।
আসার সময় চরের কাশবন প্রিয়সখির হাতে
তোমার খোঁপায় গুঁজে দেবে
শাদা শাদা কাশফুলেরর মালা।


আর যদি আসতে ইচ্ছা না করে
আর যদি রাতখানা থেকেই যাও সেই চরে
দেখবে আলো অথবা অন্ধকারের পরিপূর্ণ রূপ
পুটু সরকারে দল এসে
রাতভর তোমাকে শুনিয়ে যাবে আলকাপের গান
ছোকরার নাচ আর কাঁইপার রসিকতা দেখে
হাসতে হাসতে
কখন যে হজম হয়ে যাবে মাসকালাইয়ের রুটি-
তুমি টেরও পাবে না।
যদি তাড়া থাকে,
যদি নাচোলের রানীর বিধ্বস্ত ভিটা দেখার সময় না হয়,
ফিরে এসো তুমি
ফেরার সময় চাঁপাইয়ের মেয়েরা তোমার হাতে তুলে দেবে
একদা রানী এলিজাবেথের চোখ ঝলসানো-
নকশিকাঁথা----- সুজনী
তোমার বাদামি অঙ্গে জড়িয়ে দেবে
মসলিনের বিকল্প উত্তরসূরী ঝলমলে শিবগঞ্জসিল্কের শাড়ি
তোমার ভাবনার ভাঁজে ভাঁজে
তরু-তুফানেরা গুঁজে দেবে--
ইতিহাসের সোনালি দিন ও রাত।


যাবে চন্দনা, যাবে আমার সাথে
নানানাতির গম্ভীরা গানে মুখরিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ?