রক্ত ঝরার দিনগুলি মোর
------
রমেন মজুমদার, ১৮/১২/২৩


ফাল্গুনের নিশিরাত,
আকাশভরা তারারা খেলছিল আনমনে;
সিঁদকাটা চোরের আর এক যন্ত্রণা!
ত্রাহিমন হটাৎ ভাঙ্গালো ঘুম
ঠাস ঠাস কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দে বাঁশঝাড়ের বাদুড়ের দল কিচিরমিচির করে ওঠল।
বুঝলাম,চতুর্দিকে বিপদের বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে।


সেদিনই বুঝেছিলাম, মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণের পরিণতি কী হতে পারে!
গতকাল স্বপনের চায়ের দোকানে বসে দুজন পুলিশের সাথে আমাদের সেই ভাষণ নিয়ে আলোচনা।
পুলিশের কাছে আগাম বার্তা থাকে,বুঝলাম।
ওরা বলল, তোমরা তরুণ তুর্কি মুজিবের ডাকে সাড়া দিও।
পারলে সদর ছেড়ে অন্দরে গা ঢাকা দাও।
বুঝলাম সেদিন,রাতে গোলাগুলির আওয়াজ ওরাও কান পেতে শুনেছে,সে বিপদের লক্ষ্মণ !


ভোরের হাম্বা ডাকে ছটফট করছে আতালের গোরুগুলি।
ওরাও আমাদের পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
ভোরের মাঠ  সুনসান,কোন কৃষক যায়নি মাঠে;
ওরাও ছিলুমে টান দিয়ে বলছে,দ্যাস কি স্বাধীন হবে ?
শেখের ব্যাটা একলাই একশ।
আমাগোও পরাধীনের হাত থেকে বাঁচতে হবে।
সার-ওষুধের দাম বেড়ে গেছে।
মাঠে চাষাবাদ করে লাভ হয়না।
পাক সরকার বেবাক কিছুর দাম বাড়াইয়া দিছে।


মাঠে আধাপাকা ইরিধান,
একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে জোরে ছিলুমে টান মারল নরেন।
দলে দলে মানুষ ছুটছে গ্রামছেড়ে,শহর ছেড়ে।
খবর এলো ঢাকা-চিটাগাং যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
মুজিবরে বন্দি করছে পাকিস্তানের সেনারা!
তখন বুঝলাম, পুলিশ দুটি ঠিক বলেছিল।
নারায়ণ এসে বলল, জানিস;
থানায় রাতেই ক্যাম্প বানিয়েছে পাক হানাদার।
কী জানি,কখন পিসকমিটির নেতা আমাদের যুবকদের তালিকাভুক্ত করে
আর্মি ক্যাম্পে জমা দিয়েছে।
মুক্তিদলে ভিড়তে পারি বলে সেইতালিকা।
তিননম্বরে আমার নাম আছে তাতে।
এমন সাতজন যুবককে ধরার নির্দেশ
থানা থেকে এলো।


নরেন আবারও বলল, দেখলি ?- তোদের উপরেই আসবে মৃত্যুর পরোয়ানা!
পায়ের তলারমাটি ক্ষয়ে যেতে শুরু করল।
এবার দিরিম দিরিম কয়েক রাউন্ড গুলিরখোসা মাথার উপরে গাছের পাতা ভেদ করে গেল।
গ্রামের ও'পাড়ায় আগুনের ফুলকি দেখতে পেলাম গাছের মাথায়!....
ততক্ষণে কয়েকজনকে ওরা বুলেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে।
সকল খবর পেয়ে পালাবার চেষ্টা করলাম।
গ্রুপের তিনজনকে ওরা দেখামাত্রই গুলিকরে লাশ মাটিতে ফেলে দিল।
অদূরে জঙ্গলের পাশে দাঁড়িয়ে সব নিজ চোখে দেখলাম।
কিন্তু আমাদের হাতে কিছু নেই। সবে ট্রেনিং যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম।


গ্রামের অর্ধেক বাড়িঘর ওরা জ্বালিয়ে দিল। অগুনতি মানুষ হত্যা করল একটা দুপুর গড়িয়ে যাবার আগেই...
আমাকে দেখে প্রায় ছয়সাতজন মিলিটারি শতশত গুলি ছুঁড়ে এগিয়ে আসছে সামনে।
আমি তখন প্রায় মৃত অবস্থায় দিশেহারা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বেতঝাড়ের নালার মধ্যে!!
হুশ জ্ঞান নেই, মৃত অবস্থায় পড়ে রইলাম
নালার অনেক গভীরে।
ওরা ভাবল,শালা মুক্তিকো মারদিয়া !!


দুপুর গড়িয়ে গেছে কখন বুঝতে পারিনি। নালায় যে ঘোর অন্ধকার!
দিনের সূর্যের তাপ প্রবেশ করেনা সেখানে।
হুশ ফিরে পেলাম যখন,তখন সমস্ত শরীর,মাথা রক্তে ভেসে গেছে।
কী যে যন্ত্রণা!-- সেটা বলে বোঝানো যাবে না।
সমস্ত শরীরে বড় বড় কালো মশা যেন মৌচাকের ভিড় জমেছে।
অন্ধকারে বেতকাটার জঙ্গল বিলি কেটে কেটে বেরিয়ে এলাম দিনের আলোতে।
তখন সন্ধ্যা নামে নামে ভাব।
কোথাও কোনো লোকের সাড়াশব্দ পেলাম না।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটি মুসলিম বাড়িতে গিয়ে ওঠলাম,তারপর আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লাম।
বিখ্যাত জারিগানের শিল্পী চানমিয়া ভাইয়ের বাড়ি এটা।
ওরাই আমাকে সেবাশুশ্রূষা করে জ্ঞান ফিরালো।
পরনের কাপড় পাল্টে দিয়ে শরীর-মাথার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেতকাঁটা তুলে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।
আলেয়াভাবি সন্ধ্যার অনেক পরে জোড়করে দুটি ভাত খাওয়ালেন।
ওদের কাছে শুনলাম, তোমাদের গ্রাম প্রায় জনশূন্য!
কত মানুষ যে মিলিটারি মেরে গেছে তার হিসেব নেই।
সেদিন গভীর রাতে ওরা আমাকে নিয়ে এলো গ্রামে।
মৃত মানুষের তল্লাশি করতে।
এক এক করে প্রায় উনিশ জনের লাশ খুঁজে সেই রাতেই মাটি চাপা দিয়ে ঘরে ফিরলাম।
ঘর নেই। পোড়াবাড়ির কয়েকটি টিন পরে আছে।
সেই টিনের তলায় হামাগুড়ি দিয়ে রাত রাতকাটালাম।
সকাল হলো।
নির্জন শ্মশান পুড়ি !!
চোখের জল শুঁকিয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে রওনা হলাম পশ্চিম দিকে।
কয়েকজনের সাথে দেখা পেয়ে ছুটলাম ভারতের উদ্দেশ্যে।
অসমাপ্ত ----