একগুচ্ছ একুশের কবিতা
০১.
একুশের আগুন
শব্দগুলো ছিল মাটির নিচে চাপা,
শিকল পরানো ব্যাকরণের গলায়।
তবু কি শব্দ মরে যায়?
না, নদীর মতো সে পথ খোঁজে,
পাথরের বুকে আঁচড় কেটে বেরিয়ে আসে,
একুশের রক্তাক্ত ভোর হয়ে।
সেদিন বাতাস ছিল লাল,
প্রভাতফেরির শিউলির গন্ধ মিশে গিয়েছিল রক্তের সাথে।
বুলেটের শব্দে কেঁপে উঠেছিল অক্ষর,
তবু কি থেমেছিল ভাষার মুখ?
না, ওরা ঝরেছিল ধুলোয়,
কিন্তু শব্দেরা বেঁচে ছিল শপথের মতো!
সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার—
তোমাদের নাম উচ্চারণ মানেই
ভাষার শিরদাঁড়া সোজা করা।
তোমাদের রক্ত ছিল ভাষার প্রথম কবিতা,
একুশ তার প্রতিটি ছত্রে জ্বলন্ত উপমা হয়ে রইল।
০২.
শহীদ মিনারের ভাষা
শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো উঁচু হয়ে তাকিয়ে থাকে,
কথা বলে না, তবু সব বলে দেয়।
তার গায়ে লেগে আছে রক্তের দাগ,
তার পায়ের কাছে জমে আছে অশ্রু-স্রোত।
ফুলেরা আসে, পায়ের ধুলোয় মিশে যায়,
ভাষা এখানে বসন্ত হয়ে জাগে,
প্রতিটি শিরায় শিরায় চেতনার শপথ হয়ে ওঠে।
এই মিনারের ছায়ায় দাঁড়ালে
কানে ভেসে আসে সেই স্লোগান,
"রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!"
মাটির নিচে শুয়ে থাকা শব্দেরা জেগে ওঠে,
গোলাপের গায়ে লেগে থাকা রক্ত
ফাগুনের বাতাসে কথা বলে—
"আমরা মরিনি, আমরা শব্দ হয়ে আছি!"
একুশ আসে প্রতিবছর,
কিন্তু একুশ তো রয়ে গেছে রক্তে,
ভাষার প্রতিটি ব্যাকরণে,
বুকের প্রতিটি স্পন্দনে,
অক্ষরের প্রতিটি শিরায়।
০৩.
একুশের শপথ
শব্দগুলো রোদে শুকোতে দিয়েছিল তারা,
সেখানে ছিল বুকের ভাষা,
মায়ের কোল থেকে পাওয়া প্রথম ডাক।
কিন্তু শিকল পরানো শব্দ কি চুপ থাকে?
না, সে ছিন্নভিন্ন করে দেয়
সব নিঃশব্দের দেওয়াল।
একুশ এল গর্জে ওঠা বজ্র হয়ে,
রফিকের কপালে লেগে রইল বুলেটের চিহ্ন,
বরকতের ছেঁড়া জামা হয়ে উঠল ব্যানার,
জব্বারের রক্তে রাঙা হলো পথ,
সালামের নিঃশ্বাসে জ্বলে উঠল আগুন!
তারা জানত—
ভাষা মানে অস্তিত্ব,
ভাষা মানে জীবনের শপথ।
তাই তারা বুক পেতে দিয়েছিল
তাদের শব্দের জন্য,
তাদের ভালোবাসার জন্য,
তাদের মায়ের মুখের ভাষার জন্য।
০৪.
প্রভাতফেরির পায়ে রক্ত
পায়ে পায়ে আসে একুশ,
প্রভাতের বাতাসে ফোটে কান্না,
শহীদ মিনারের শ্বেতশুভ্র স্তম্ভে
লেগে থাকে দগদগে ক্ষত।
ফুলের গায়ে লেগে থাকে রক্ত,
ফুলের গন্ধে মিশে থাকে শোক,
তবু এই শোক কখনো দুর্বলতা নয়—
এ শোক জ্বলে ওঠে লাল পতাকা হয়ে।
একদিন তারা বুক চিরে রেখেছিল
ভাষার জন্য,
আজ তাদের নাম লেখা আছে
প্রতিটি শিরায়, প্রতিটি ছন্দে,
প্রতিটি উচ্চারিত বর্ণে।
০৫.
ভাষার বিজয়
তাদের থামিয়ে দিতে চেয়েছিল বন্দুক,
তারা ভেবেছিল,
ভাষা এক টুকরো কাগজ,
যে ছিঁড়ে ফেললেই নিঃশেষ হয়!
কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল—
ভাষা হলো আগুন,
যে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
একুশ মানে শুধু রক্তের দাগ নয়,
একুশ মানে বুকের গভীরে
জ্বলে থাকা দীপশিখা।
এই ভাষা আজ নদীর মতন বহমান,
এই ভাষা আজ আকাশের মতন বিস্তৃত,
এই ভাষা আজ সব বাধা পেরিয়ে
অপরাজিত বিজয়ের নাম।
০৬.
একুশের কান্না
বুকের ভেতর জমে থাকা শব্দেরা
সেদিন ফুটে উঠেছিল রক্ত হয়ে,
ফাগুনের বাতাসে মিশে গিয়েছিল
একেকটি নিঃশ্বাস—
সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার…
তাদের নাম ছিল একটি করে ভাষার অক্ষর।
তারা চেয়েছিল বলতে,
তারা চেয়েছিল বাঁচাতে,
কিন্তু ভাষার কণ্ঠরোধ করা যায় না,
ভাষা তো নদীর মতন—
কোনো বাঁধ তাকে আটকে রাখতে পারে না!
রাস্তায় গড়িয়ে পড়েছিল
তাদের দগদগে প্রাণ,
বুলেটের শব্দে থমকে গিয়েছিল আকাশ,
তবু শব্দেরা চুপ করেনি,
তারা হয়ে উঠল স্লোগান,
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি—
আমি কি ভুলিতে পারি?"
০৭.
শহীদ মিনারের ভাষা
সাদা পাথরের স্তম্ভগুলো
এখনো নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে,
তাদের শরীরে লেগে আছে
অতীতের রক্তের দাগ,
যা ধুয়ে যায় না,
মুছে ফেলা যায় না।
প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি
সকালের শিশিরের সাথে
ফুটে ওঠে কান্নার মতো ফুল,
জোড়হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড়ে
এখনো শোনা যায় শপথের ধ্বনি—
"ভাষা আমাদের অধিকার,
ভাষা আমাদের অস্তিত্ব!"
০৮.
একুশ মানে জ্বলে থাকা প্রদীপ
তারা এসেছিল বুকে আগুন নিয়ে,
তারা চেয়েছিল বলতে—
আমরা আছি, আমাদের ভাষা আছে,
আমাদের শিকড়, আমাদের প্রাণ আছে!
কিন্তু বন্দুকরা জানত না,
বন্দুকের শব্দ ক্ষণস্থায়ী,
কিন্তু ভাষার ধ্বনি চিরকালীন।
তাদের রক্ত মিশে গেল মাটির সাথে,
সেই মাটি জন্ম দিল নতুন প্রভাতের।
আজ একুশ আসে
কেবল শোক হয়ে নয়,
একুশ আসে শপথ হয়ে,
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
জ্বলতে থাকা প্রদীপ হয়ে।
০৯.
ভাষার জন্য শহীদ
একটি বর্ণ মানে একটি জীবন,
একটি বাক্য মানে একটি শপথ।
সেদিন যারা ঝরেছিল,
তারা আসলে ঝরেনি,
তারা ছড়িয়ে পড়েছে
প্রতিটি ভাষার কোষে কোষে।
তাদের রক্ত লাল কালিতে লেখা,
তাদের স্বপ্ন স্বাধীন বাতাসে ভাসে,
তারা আজো বেঁচে আছে,
ভাষার প্রতিটি উচ্চারণে,
আমাদের প্রতিটি কথায়,
আমাদের প্রতিটি কবিতায়।
একুশের অমর রক্ত
রক্ত কি মাটিতে মিশে যায়?
না, রক্ত শিকড় হয়ে উঠে আসে—
পাতায়, ফুলে, বাতাসের গোপন সুরে,
শিশুর কণ্ঠে প্রথম উচ্চারিত শব্দে।
সেদিন গুলির শব্দে নীরব হয়েছিল রাজপথ,
তবু শব্দেরা থামেনি,
তারা মিশে গিয়েছিল শহীদের শিরায়,
তারা বেঁচে গিয়েছিল ব্যাকরণের শরীরে।
ভাষা কি বন্দুকের মুখে থামে?
না, ভাষা মৃত্যুর ওপারে আলো হয়ে জ্বলে,
একুশের রক্ত কখনো শুকায় না,
ওটা চিরকাল লাল, চিরকাল জাগ্রত।
১০.
শহীদের ঠোঁটের শেষ কথা
সেদিন বরকতের ঠোঁটে লেগে ছিল
একটি অসমাপ্ত বাক্য,
বুলেটের ঝাঁক তাকে শেষ করতে পারেনি,
শুধু স্তব্ধ করেছিল এক মুহূর্তের জন্য।
রফিকের চোখে তখন
একটি স্বাধীন ভাষার পূর্ণিমা ফুটছিল,
সালামের আঙুল তখনো
লিপি আঁকছিল বাতাসে।
তাদের ঠোঁটের শেষ কথা
আজো প্রতিটি কণ্ঠে বেজে ওঠে,
তারা কিছু বলেনি,
তবু তাদের নীরবতা ছিল
সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ।
১১.
ভাষার শবযাত্রা
একটি মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল,
কাঁধে ছিল শহীদের লাশ,
রক্ত মেখে হাঁটছিল
কিছু আহত প্রতিজ্ঞা।
ভাষা কি মৃতদের সাথে চলে যায়?
না, ভাষা জন্ম নেয় লাশের স্তূপ থেকে,
প্রভাতের শিশিরের মতো গড়িয়ে পড়ে
শত শত প্রতীক্ষার রোদে।
তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়েছিল,
কিন্তু তাদের ভাষা হয়েছিল অমর,
যারা একুশের রক্তে পা রেখেছিল,
তাদের কেউ দাস হতে পারেনি।
১২.
একুশের গোপন শপথ
সেদিন যে রাস্তায় রক্ত পড়েছিল,
সেখানে আজো শব্দেরা জন্মায়,
পাতার ফাঁকে বাতাসে ঘুমিয়ে থাকে
একটি দীর্ঘশ্বাসের গান।
একুশের রক্তে ছিল শপথ,
কোনো রাজ্য সেটিকে থামাতে পারেনি,
কারণ ভাষা বন্দুকের চেয়ে প্রবল,
ভাষা লাশের ওপরে দাঁড়িয়ে হাসে।
তাদের শপথ আজো বাতাসে ভাসে,
"যদি আবার কেউ ভাষার শিকড় কাটতে আসে,
তবে এই রক্ত আবারো বয়ে যাবে,
এখানে একুশ বারবার জন্ম নেবে!"
দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।