একগুচ্ছ একুশের কবিতা
০১.
একুশের অগ্নিশিখা
-বিচিত্র কুমার
চুপচাপ রাতের অন্ধকার চিরে,
একদিন কেঁদেছিল আকাশ,
নীরবতার ছিন্ন মেঘে জমেছিল—
আত্মত্যাগের রক্তিম ইতিহাস।
গোলাপের পাপড়ির মতো লাল হয়ে উঠেছিল পথ,
সেই রক্তভেজা ধুলোয়,
জন্ম নিয়েছিল একুশের প্রতিজ্ঞা—
"আমরা ভাষার মর্যাদা রাখব, রাখব চিরকাল।"
তখন কাঁপছিল শব্দেরা,
সীমান্ত পেরিয়ে কাঁপছিল পৃথিবী,
একটি মায়ের কোল শূন্য হলো,
একটি সন্তানের বুক হলো রক্তাক্ত ধূলি।
কিন্তু থামেনি তারা,
প্রাণ দিয়ে লিখে গেছে ভাষার নাম,
এখানে কোনো পরাজয় নেই,
এখানে কেবল বিজয়ের অভিমান।
০২.
শহীদের শপথ
-বিচিত্র কুমার
তোমরা কি শুনতে পাও?
ভাষার পবিত্র ধ্বনি ভেসে আসে বাতাসে,
যেখানে একটি অক্ষরও বাঁধা ছিল শিকলে,
সেখানে আজ উচ্চারিত হয় মুক্তির গান।
তোমরা কি দেখতে পাও?
শহীদ মিনারের স্তম্ভে
নক্ষত্র হয়ে জ্বলছে রফিক, সালাম, বরকত,
তাদের ছায়া মিশে আছে প্রতিটি প্রতিশ্রুতিতে।
আমরা যে ভাষায় স্বপ্ন দেখি,
আমরা যে ভাষায় ভালবাসি,
সেই ভাষার প্রতিটি শব্দে জ্বলছে—
তাদের আত্মত্যাগের শিখা।
তোমরা কি অনুভব করো?
শব্দেরা আর কাঁদে না,
তারা আজো গেয়ে চলে—
একটি জাতির আত্মপরিচয়ের জয়গান!
০৩.
ভাষার শেকড়
-বিচিত্র কুমার
এই মাটির গন্ধে মিশে আছে
একটি জাতির পরিচয়,
যারা ভাষার জন্য বুক পেতে দিয়েছিল,
তারা নেই, কিন্তু তাদের ভাষা বেঁচে আছে।
একটি শিশুর প্রথম উচ্চারণে,
একটি কবির কবিতার ছন্দে,
একটি মায়ের গভীর আহ্বানে,
একটি শিক্ষকের কালো বোর্ডে লেখা বাক্যে।
ভাষা কেবল কথা নয়,
ভাষা কেবল শব্দ নয়,
ভাষা হলো হৃদয়ের পরিচয়,
ভাষা হলো স্বাধীনতার অঙ্গীকার।
আমরা কি সেই প্রতিজ্ঞা ধরে রেখেছি?
আমরা কি ভাষাকে রক্ষা করেছি?
তাদের রক্তের ঋণ কি শোধ করতে পেরেছি?
এই প্রশ্ন বয়ে চলে প্রতিটি ফাগুনে।
০৪.
একুশের সূর্যোদয়
-বিচিত্র কুমার
রক্তে লেখা অক্ষরের পাশে
জেগে উঠছে নতুন সূর্য,
একুশ মানে শুধু শোক নয়,
একুশ মানে লড়াইয়ের প্রজ্জ্বলিত শিখা।
যতদিন রক্তে রবে স্বপ্ন,
যতদিন কণ্ঠে রবে ভাষা,
ততদিন এই ভাষা থাকবে,
এখানে ইতিহাস থামবে না।
তোমরা যারা শহীদ হলে,
তোমরা যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিলে,
তোমাদের সেই অক্ষর-অগ্নি
আজো জ্বলছে আমাদের চোখের তারায়।
আমরা বলব, আমরা লিখব,
আমরা স্বপ্ন আঁকব বাংলায়,
আমাদের কণ্ঠ কখনো স্তব্ধ হবে না—
তোমাদের রেখে যাওয়া ভাষায়!
০৫.
শব্দেরা কাঁদে শব্দেরা জাগে
-বিচিত্র কুমার
রাতের নিস্তব্ধতার গভীরে,
আঁধারের বুক চিরে উঠে এসেছিল এক ধ্বনি—
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি!"
সে কি শুধু স্লোগান?
না, তা এক জাতির আর্তনাদ,
একটি মায়ের চুল ছেঁড়া বিলাপ,
একটি সন্তানের ছিন্ন বুক,
একটি অক্ষরের জন্য ফেটে পড়া কান্না।
কিন্তু শব্দেরা কি মরে?
না, তারা পুড়ে উঠে নতুন ভাষার আলোয়,
তারা ঝরে গিয়ে গাঁথে বিজয়ের মালা,
তারা শিকল ভেঙে ফোটায় স্বাধীনতার ফুল।
কিন্তু তবু প্রশ্ন রয়ে যায়—
শব্দেরা কাঁদে কেন?
কারণ, এখনো কিছু স্বরব্যঞ্জন রয়ে গেছে শৃঙ্খলে,
এখনো কিছু ভাষা হারিয়ে যায় নীরব মৃত্যুর কুয়াশায়,
এখনো কিছু স্বপ্ন চাপা পড়ে ইতিহাসের ধুলোয়।
০৬.
শহীদ মিনারের ছায়া
-বিচিত্র কুমার
রক্তাক্ত পথের উপর দাঁড়িয়ে আছে মিনার,
তার ছায়া দীর্ঘ, তার ছায়া নীরব,
তার ছায়ায় পড়ে রফিকের রক্তের ছোপ,
তার ছায়ায় ঝরে সালামের শেষ নিশ্বাস।
মিনারের স্তম্ভ কি জানে?
সে কি অনুভব করে সেই দিনের শীতল রক্ত?
সে কি শুনতে পায় সেই গুলির শব্দ?
সে কি স্বপ্ন দেখে রক্তাক্ত হাতের শপথ?
হয়তো তাই, প্রতি ফাগুনে সে কাঁদে,
তার বুকের পাথরে ভেসে আসে এক পুরোনো গান—
"আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।"
সে গান কি শুধু গান?
না, তা এক শপথ,
যে ভাষার জন্য জীবন যায়,
সে ভাষা কখনো পরাজিত হয় না।
০৭.
বর্ণমালার বিদ্রোহ
-বিচিত্র কুমার
একটি ‘ক’ একটি ‘খ’ একটি ‘গ’
এই অক্ষরগুলো কি জানে তাদের মূল্য?
তারা কি জানে তাদের জন্মদাতা কারা?
তারা কি জানে, তাদের জন্য কেউ বুক পেতে দিয়েছিল?
বর্ণমালারা আজো লড়াই করে,
যখন তারা পুঁথির পাতায় বাঁধা পড়ে যায়,
যখন তারা ভুল উচ্চারণে বিকৃত হয়ে যায়,
যখন তারা অপমানিত হয় ভিনদেশি শব্দের ভারে।
তারা কি ভেবেছিল,
স্বাধীনতার পরও তাদের যুদ্ধ থাকবে?
তারা কি জানত,
যে ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিল মানুষ,
সে ভাষাকেই অবহেলা করবে তাদেরই উত্তরসূরি?
বর্ণমালা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে,
তারা ঝড় হয়ে গর্জে ওঠে,
তারা কাগজে-কলমে-বুকের রক্তে লেখে—
"একুশ মানে লড়াই, একুশ মানে জয়।"
০৮.
একুশ সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়
-বিচিত্র কুমার
একুশ একটি ফাগুনের গল্প,
যেখানে বুলেট আর রক্ত মিলেমিশে আঁকেছিল—
একটি ভাষার মানচিত্র।
একুশ মানে শুধু স্মরণ নয়,
একুশ মানে প্রতিজ্ঞা,
একুশ মানে প্রতিটি শিশুর কণ্ঠে বাংলার জয়গান।
যতদিন একটি কণ্ঠ উচ্চারণ করবে "মা",
যতদিন কেউ লিখবে "ভালোবাসা",
ততদিন শহীদদের আত্মা জেগে থাকবে।
তারা রক্ত নয়, তারা অক্ষর,
তারা কান্না নয়, তারা আগুন,
তারা হারিয়ে যাওয়া অতীত নয়,
তারা আমাদের অস্তিত্বের শেকড়।
তোমরা যারা শহীদ হলে,
তোমরা যারা বুকের রক্ত দিয়ে লিখলে ইতিহাস,
দেখো, বাংলা এখনো বেঁচে আছে!
দেখো, তোমাদের ভাষা এখনো জ্বলে,
সূর্যের মতো, ধ্রুবতারার মতো,
একুশের চিরন্তন শিখা হয়ে!
নামঃ বিচিত্র কুমার
গ্রামঃ খিহালী পশ্চিম পাড়া
পোস্টঃ আলতাফনগর
থানাঃ দুপচাঁচিয়া
জেলাঃ বগুড়া
দেশঃ বাংলাদেশ
মোবাইলঃ 01739872753
https://www.facebook.com/profile.php?id=100014642137028&mibextid=ZbWKwL