জলফু মাঝির নাম শুনেছ?
অনেক বড় মাঝি,
তার নায়েতে যাইতো গাঁয়ের
নেতা-মোড়ল-কাজী,
নাও ছিলো তার জীবন-তরী
নাও ছিলো তার সুখ,
দুখের মাঝেও নায়ের গানে
ভুলতো মাঝি দুখ,
ঘর ছিলোনা জলফু মাঝির
কাপড়ও নেই গায়ে,
সারা জনম ভরেই মাঝি
থাকতো খালি পায়ে,
লুঙ্গিতে তার শত তালী
কোন রকম চলে,
নাইতো খাবার শুধুই রুটি
পাটাতনের তলে,
শুকনো রুটির সাথে নদীর
মিষ্টি পানি খেয়ে,
সারাটা দিন কাটতো মাঝির
বেসুরো গান গেয়ে,
শত-হাজার দুঃখ এসে
বেঁধে রাখতো তা'য়,
সে দুখ যেন সুখের হয়ে
ফুটতো ঠোঁটের বায়,
হাজার শত দুখের মাঝেও
ভাটিয়ালীর সুরে,
নৌকা নিয়ে ছুটতো মাঝি
ঐ দুর-বহুদূরে।


গাঁয়ের নেতা-মোড়ল-কাজী
সব মানুষই তারে
কেমন যেন শ্রদ্ধা করে
বলতে পারছি নারে,
কারণ জান? বর্ষাকালে
যখন গভীর রাতে
ঝড়-বৃষ্টির ভয়ে সবাই
ঘুমের দুনিয়াতে,
সেই সে কঠিন রাতেও যদি
অসুস্থ হয় কেউ,
উতলে ওঠে জলফু মাঝির
ভালবাসার ঢেউ,
নাও নি' আসে ঘরের দ্বোরে
নাওয়ে তুলে তা'য়,
রাতের আঁধার ভেদ করে সে
রোগী নিয়ে যায়,
কোথায় আছেন হেকিম সাহেব
কই ডাক্তার-ই খানা
এসব থাকে জলফু মাঝির
ভালো করেই জানা,
শুধু রোগ নয় যেই আপদ আর
যেই বিপদই আসে,
ঝাঁপিয়ে পড়ে জলফু মাঝি
বিপদ-সর্বনাশে,
বুক দিয়ে সে ঠেকায় বিপদ
ঠেকায় দুঃখ-জ্বালা,
তাইতো জলফু 'মাঝি'হলেও
গাঁয়ের প্রদীপালা
অন্য সবার দুঃখ মাঝি
নিজের উপর লয়,
বুঝেনা কেউ জলফু মাঝির
জীবন তরীর ক্ষয়।


শীতের রাতে জলফু মাঝি
ডাঙায় বেঁধে নাও,
পাটাতনেই থাকে শুয়ে
উদোম সারা গাও,
শীতের রাতেও নেই তো রে শীত
হয়তো দুখের ভারে,
শীত ও গরম বুঝার শক্তি
দেয়নি বিঁধি তারে,
গান ধরে সে রাত বিরাতে
সে কি দুঃখের সুর!
সে সুর যেন হৃদয় ফেড়ে
যায় যে অনেক দূর
কিসের দুখে গান ধরে সে
তা জানেনা কেউ,
হাসির মাঝেও অন্তরে তার
উঠে দুখের ঢেউ,
দেখেনা সেই দুঃখ কেহ
বুঝেনা তার মন,
জলফু মাঝি জলফু মাঝি
নয়তো সাধারণ।


সেদিন গায়ের মোড়ল বাড়ি
ডাকাত এলো রাতে,
খবর পেয়েই জলফু মাঝি
ছুটলো সাথে সাথে,
ভয়-ভীতি সব দাফন করে
হাক ছেড়ে কয় "ওরে,
রঘু ডাকাত এ কাজ করতে
বারণ করেছি তোরে?
তারপরও তুই! আরো আবার
আমার মোড়ল বাড়ি!"
হাক ছেড়ে কয় "গায়ের সবাই
জাগো তাড়াতাড়ি,
দেখ দেখ রঘু ডাকাত
যায় পালিয়ে ঐ"
গায়ের ক'জন জেগে বলে
'রঘু ডাকাত কই?'
দৌড়ে পালায় রঘু ডাকাত
পিছে বৈঠা হাতে,
জলফু মাঝি যায় মিশে যায়
অন্ধকারের সাথে
সকাল হতেই খবর ছড়ায়
জলফু মাঝির ভয়ে,
রঘু ডাকাত পালিয়ে গেছে
আপন জীবন লয়ে।


এমনি ভাবে রাত বিরাতে
সর্ব কাজেই মাঝি,
সকল বিপদ বুকে নিতে
এমনে হতো রাজী,
ধীরে ধীরে মরণ সাগর
গ্রাস করিল তা'য়
হারিয়ে গেলো জলফু মাঝি
নিঝুম নিরালায়।


আজ...
জলফু মাঝির নৌকা দেখি
ঘাটের সাথে বাঁধা,
ভেঙ্গে গেছে সেই পাটাতন
লেগে আছে কাদা,
সেই হাতিয়ার বৈঠা খানি
ভেঙে যেন শেষ,
নেই তো সে বীর জলফু মাঝি
হইছে নিরুদ্দেশ,
জলফু মাঝি নেই বলে আজ
গ্রামটিও নেই ভাল,
তার মতো আর পারেনা কেউ
জ্বালতে সত্য-আলো,
চোর-বাটপারে ভরে গেছে.
বাড়ছে গাঁয়ের দুখ,
জলফু মাঝি আবার আসো
আনতে গায়ের সুখ।