আজ আমি খুশি মুক্ত পাখির মতো
আমার অন্তর আত্মা যেন মুক্তি পেলো
বহুদিনের জমানো আত্মগ্লানি থেকে।
দেড়দশক বড়ো ক্লান্ত অবসন্ন লাগে
নীরবে অন্যায় ব্যবহার সহ্য করে করে
আজ বড়ো শান্তি যোগ্য উওর দিয়ে।
বাবা,তুমি বলতে সেবা পরম পূণ্যকর্ম
নিঃস্বার্থ ভাবে ধৈর্য্য ধরে সেবা করবে
আমি তো সারা জীবন তাই করলাম।
প্রয়োজন হলেই সবাই ডেকে পাঠায়
মিষ্টকথায় বলে এই কাজটা করে দেবে
কাজ ফুরোলেই সবাই মিলে বলে.....
মনে রেখো তুমি আমাদের জন্য করলে
কিন্তু আমরা কোনদিন তোমাদের জন্য
কিছু করতে পারবো না।মনে রেখো!
ঘৃণা আসে নিজের সরলতার প্রতি।


2 থেকে 4এপ্রিল বাবার বন্ধুর বাড়িতে রাত থেকে জেঠিমার সেবা করে এলাম। নিজের খাবার বাড়িতে খেয়ে রাত নয়টায় রোজ জেঠিমার খাবার নিয়ে পৌঁছলাম। রোজ সকালে তাকে চা করে জলখাবার করে তাকে খাইয়ে চোখে ওষুধ দিয়ে নিজে অভুক্ত থেকে খানিকটা পথ হেঁটে গিয়ে টাটকা মাছ রোজ কিনে জেঠিমার ঘরে রেখে ফিরে এলাম বাড়ি। এই চোদ্দ দিন ছানি অপারেশন হয়েছে। ছেলে বৌ রাজস্থান যাচ্ছে
ছেলের পড়াশোনার জন্য। জেঠিমার তিন মেয়ের সময় নেই মায়ের কাছে থাকার।তাই আমাকে তিন রাত থেকে খাবার করে দেওয়া আর মোট আটবার চোখে ড্রপ দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেল। সারা দিনরাত থেকে দুপুরের রান্না করে দিতে বলল ওরা। আমি দুপুরে রান্নার দায়িত্ব নিইনি।বললাম কাজ আছে আমার। জলখাবার খাইয়ে বাড়ি চলে যাবো। ওরা রান্নার লোক রেখে যাক সে ভাত করে দেবে। ওদের পছন্দ হচ্ছিল না। আমি দুপুরের খাবারের দায়িত্ব নিচ্ছি না। আসলে আমি ওদের বাড়িতে থেকে ওদের অর্থে খাবার  খেতে চাইনি।
প্রথম দিন গিয়ে দেখি আমার জন্য রাতে মশারীর ব্যবস্হা নেই।বিছানার চাদরে ধুলোবালি, কতদিন বদল হয়নি কে জানে। রাতের বেলা জেঠিমার ঘরে ফ্যান বন্ধ থাকবে তবে মশারি পাবো। তাই মাথার বালিশ মশারি ছাড়া ফ্যান চালিয়ে রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত জেগে কাটালো অন্য ঘরে প্রচুর মশার কামড়ে। ভোরে ঘুম ভাঙতেই দেখি জেঠিমা কখন নয় ওয়াটের পাওয়ার সেভার নিভিয়ে দিয়ে গেছে।এককিলোমিটারের মধ্যে মহকুমা হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড আছে। তবুও এই অমানবিক ব্যবহার তিন দিন ধরে। নিজেরা এসিতে থাকে। তবুও ঘর অন্ধকার করে আরো বেশি মশার কামড়ে রেখে গেল আমাকে। আগের বছরেরর অভিজ্ঞতা হল রাতে খাবো বলে নিজের চারটে রুটি তরকারি  নিয়ে গিয়েছিলাম সাথে জেঠিমার জন্য নিজের অর্থে খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম।বলে তুমি পাগল হয়েছো?চারটে রুটি খাবে?একটা রুটি তুলে রাখছি। কাল আমার কাজের মেয়ে চা রুটি খাবে।তাই এবার বাড়ি থেকে খেয়ে গিয়েছিলাম, জেঠিমার সামনে খাবো না বলে। সকালে আগের বার নিজের খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম এবার ‌বাড়ি এসে খেয়েছি। ওদের কাছে ওদের রান্না ঘর থেকে চা পর্যন্ত খেতে না বলেছি।
সকালে এক ব্যক্তি এল। ওদের বাড়িতে মন্দিরে নিয়মিত আসে।দশ বছর ধরে পূজোর দিনে পূজো দিতে গিয়ে দেখতে পাই ওনাকে।কোন দিন কথা হয়নি আগে। হঠাৎ বলে উঠলেন...
তুমি এবাড়িতে থাকো?
ওনার বুড়ি মা আর বৌয়ের জন্য দিনরাতের ঝি কাজের লোক খুঁজছেন।
আমি অবাক চোখে জ্যাঠিমার দিকে তাকিয়ে রইলাম। চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইল জেঠিমা।


বুঝলাম গত পনের বছর ধরে আমি যতো নিঃস্বার্থ ভাবে ওদের জন্য করেছি, আমার বাবা (কেমিস্ট্রি এর প্রফেসর) তার বন্ধুর ছেলেকে গ্রেজুয়েশনে বিনামূল্যে পড়িয়েছে, আমার দিদি জেঠুর নাতিকে ছোট থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত ইংলিশ মিডিয়ামের ইংলিশ গ্রামার যত্ন করে শিখিয়েছে বিনামূল্যে...
সব কিছুর শেষে আজ ওরা আমাকে অর্থের বিনিময়ে কাজের লোক দিবারাত্রির ঝি বা আয়া বলে সমাজে পরিচয় দিয়ে থাকে।


4 তারিখ চলে আসার সময় বলে এলাম
"এই শেষ বারের মতো আমি আপনাদের জন্য করে গেলাম।আর কখনো আপনাদের জন্য করতে আসবো না।"।ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ


এই কথাটা শোনার পর জেঠিমা বলছে...
তুমি আমার মেয়ের মতো। আমি যতোদিন বেঁচে আছি আমার খোঁজ নিয়ে যেও। নাতি এখন সাত বছর বাইরে থেকে পড়াশোনা করবে। আমাকে এখন এভাবে একা থাকতে হবে অনেক দিন।তোমাকে আমাদের দরকার।


আমি হাসি মুখে উওর দিলাম...
আমি আপনাদের কেউ না।
জেঠু সত্যি আমাদের খুব ভালোবাসতো।বলতো "তুই সব অন্যায় সহ্য কর আমার জন্য আমি যতো দিন বেঁচে আছি।করেছি নীরবে সহ্য। জেঠু আজ স্বর্গবাসী। এবার আমি চললাম।


জেঠিমা মাটির দিকে তাকিয়ে বসে রইলো।


আমি মিথ্যে সম্পর্কের বাঁধন ছিঁড়ে মুক্তি পেলাম।নীল আকাশ সোনালী রোদ্দুর আর
একরাশ আত্মতৃপ্তি বুকে নিয়ে ফিরে এলাম।


মাতৃপিতৃহীন মেয়েদের আপন কেউ হয়না...
জীবনের সারকথা এটাই!