হৃদয়ের কথা প্রকাশে বাড়তি কোনো রঙের প্রয়োজন হয় না। প্রকৃতি ওতে এমনিতেই রঙের সমারোহ ঘটায়। তাই নিঃসংকোচে  বাংলা কবিতা আন্তর্জাতিক কাব্য বাসর ও কবি সম্মিলন-২০২৩ নিয়ে আবেগী আমি আমার হৃদয়ের সব আবেগ প্রকাশে হলাম তৎপর। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কেরানীগিরি আর সংসারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব পালনের পর যেটুকু সময় মেলে তা আত্মার শুদ্ধির জন্যে খরচ করি। কবিতা এবং সাহিত্য রচনার জন্যে যে যোগ্যতা লাগে তা অর্জনের সুযোগ এই কেরানীর নেই বললেই চলে। তবুও সৃষ্টিকর্তা মাঝে মাঝে দু চারটে লাইন মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেন আর আমি টপ করে তা লিখে ফেলি। সৃষ্টিকর্তার এই বিশেষ কৃপায় পরিচিতি পেলাম কবি হিসেবে! আর কবি পরিচিতির উসিলায় পেয়ে গেলাম আত্মার কাছের কিছু মানুষ। এই মানুষগুলোর মধ্যে আছেন পরিতোষ ভৌমিক আর বিশ্বজিৎ শাসমল। যাদের দিদি ডাকে মনে হয় জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক আমাদের।


পরিতোষ দা আর বিশ্বজিৎ এর "দিদি এবার কিন্তু আসতেই হবে" আহবানকে উপেক্ষা করার শক্তি আমার ছিলো না। যথারীতি যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সদলবলে ১১ আগস্ট রওয়ানা দিলাম। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে উপলব্ধি করলাম পরিতোষ দার হৃদয়ের মমতার অনুরণন এপার বাংলায় শ্যামলী পরিবহণে এসে আমাদের ছুঁয়ে দিয়েছে। এজন্যই সবাই এত আনন্দমুখর ছিলাম।  


কাঁটা তারের বেড়া টপকে ওপারে পৌঁছাতেই পরিতোষ দার আনন্দ বাহিনী নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানানোটা ছিলো উৎসব শুরুর ঢাকে বাড়ি পড়ার মতো। এখান থেকেই শুরু হয়  বাংলা কবিতা আন্তর্জাতিক কাব্য বাসর ও কবি সম্মিলন-২০২৩ এর উৎসব আমেজ। অভ্যর্থনা শেষে আমাদের বহন করার জন্যে অপেক্ষারত গাড়ীতে উঠে চলে এলাম হোটেলে। সেখানে অপেক্ষা করছিল কবি আভা সরকারসহ আরো অনেকে। উষ্ণ আলিঙ্গনে বরণ করে নিলো কবি আভা সরকার যে আমার আভা দি হয়ে গেছে অনেক আগেই।


আমি একটু বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছি এ কারণে, কবি পরিতোষ দা প্রতি পলে পলে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, শিখিয়ে দিয়েছেন একটি সফল আয়োজন কিভাবে করতে হয়।


আবার কবি সম্মিল্লনে ফিরে আসি। হোটেলে পৌঁছে যার যার রুম বুঝিয়ে দেন পরিতোষ দা নিজে উপস্থিত থেকে। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হতে না হতেই চলে আসে ওয়েলকাম ড্রিংক। আমার সাথে থাকা কবি রুনা লায়লা রীতিমতো বিস্মিত! পুরোপুরি ফ্রেশ হওয়ার পর চলে আসে চা বিস্কুট। অতিথি নারায়ণ, কথাটির সত্যতা উপলব্ধি করছিলাম কবি পরিতোষ দার আন্তরিকতায়। ইমিগ্রেশনে অনাকাঙ্খিত এক পরিস্থিতির কারণে আমাদের পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় দুপুরের খাবারের সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। স্বভাবতই পেট তার প্রাপ্যতার অধিকার  জানান দিচ্ছিলো। হোটেলে খেতে যেতে হবে এমন ধারণাই ছিলো আমার। কিন্তু কেউ একজন জানালো খাবার রুমেই চলে আসবে। পরিতোষ দার এত দিকে খেয়াল! একটি ছেলে এসে আমার পাসপোর্টের কপি চাইলে আমি আগে খেতে চাই। সে মিষ্টি হেসে বলে, খাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। খাবার না খাওয়া অবধি আমি কিছুই দেবো না বলে আমার স্বভাবগত দুষ্টুমী শুরু করি। ছেলেটি তার মিষ্টি হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলো আমার দুষ্টুমীটাকে সে উপভোগ করছে। মনে হলো ও আমার খুব আপনজন। জিজ্ঞাসা করলাম কি নাম আপনার? বললো, শুভম ভৌমিক। তারপর জানালো পরিতোষ দার ছোট ভাই সে। বুঝলাম এজন্যই ও এত সুন্দর করে হাসতে পারে! আবার কিছুটা বিস্মিত হলাম পরিতোষ দার সাথে তার পুরো পরিবার এই আয়োজনে সক্রিয়!


কিছু সময় পর খাবার রুমে পৌঁছে গেলো। মেন্যু সিলেকশনেও পরিতোষ দা তার আতিথেয়তায় ছিলেন উদার। পেট পুরে খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে আভা দি আমাকে আর কবি রুনা লায়লাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবেন। সেখানেও পরিতোষ দার সজাগ দৃষ্টি। চয়নিতা বলে একটি মেয়েকে পরিতোষ দা আগেই বলে রেখেছেন আমাদের সাথে সে যেন থাকে এবং সব ঘুরিয়ে দেখায় বিশেষ করে কেনাকাটার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। চয়নিতাও দেখি কম যায় না। এত মিষ্টি আর আন্তরিক! মনে হচ্ছিল এও আমার আপনজন।


১২ আগস্ট আভা দির সাথে ঘুরতে বেরিয়ে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির, নীরমহল এবং রাজবাড়ী দেখলাম। দুপুরে খেলাম নিরামিষ ভাত। নিরামিষ হতে পারে এত পদের এবং স্বাদের তা সত্যি জানা ছিলো না।  দিন কাবার করে ফিরলাম আমরা।


১৩ আগস্ট  সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! রাতেই কে কি পরবো সব গুছিয়ে রেখে ঘুমুতে যাই। সকালে সবার সাজগোজ আর অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়ার তাগিদে সেই শৈশব কৈশোরে ঈদের আনন্দকে ফিরে পেলাম। অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে দেখি সেখানেও নিপূণ হাতের ছোঁয়া সুস্পষ্ট। পরিতোষ দা যথার্থই বলেছেন, অনেক দিনের পুঞ্জীভূত মেঘ আজ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে! আর সেই আনন্দের বৃষ্টিতে অবগাহন করছিলাম আমরা সবাই। ত্রিপুরার ঐতিহ্যবাহী রিশাকে উত্তরীয় হিসেবে প্রদানে পরিতোষ দাসহ তার পুরো টীমের সুরুচির পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। পরিতোষ দা অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার পর যখন সঞ্চালনার দায়িত্ব পালনের জন্যে কবি সৌমেন বন্দোপাধ্যায়ের নাম ঘোষণা করেন তখন পরিতোষ দার বিচক্ষণতার পরিচয় পেলাম। তিনি সত্যিকারের একজন সংগঠক। কোনো প্রকার স্বজনপ্রীতি, কিংবা আবেগ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে যিনি যে কাজে দক্ষ তাকেই মনোনীত করেছেন। আবার সৌমেন দা যখন বিভূতি দাকে সঞ্চালনার দায়িত্ব দিয়ে মঞ্চ ছাড়লেন তখন মনে হলো মণি মানিক্যের কি চমৎকার সমারোহ! পুরো আয়োজনে একটি বিষয় লক্ষণীয় এবং শিক্ষণীয় সেটি হলো দক্ষ একটি টীম স্বাধীনভাবে কাজ করলে সাফল্য সেখানে আসবেই।


কবিতার আসর মানে বিশৃঙ্খলা, কবিতার আসর মানে সময় না মানা, কবিতার আসর মানে হৈ চৈ হট্টগোল এই কনসেপ্টকে যারা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় কবি পরিতোষ ভৌমিক তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন সময়ানুবর্তিতায় এবং সুশৃঙ্খলায় একটি কবিতার আসর সফলভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে। রিসিপশন থেকে কবিতা পাঠ, উত্তরীয়সহ মেমেন্টো প্রদান, আপ্যায়ন পর্ব কোথাও ছিলো না এতটুকু অনিয়মের ছাপ। ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক ৪টায় অনুষ্ঠানের সমাপ্তির মাধ্যমে বার্তা রেখে গেলেন কবির জীবন যেমন চলবে তাল আর ছন্দের সমন্বয়ে তেমনি কবিতা কেন্দ্রীক সকল আয়োজনেও থাকা উচিৎ তাল এবং ছন্দের সমন্বয়।


উপস্থিত কবিদের বিশুদ্ধ বাংলা গানের সাথে রাতের আহার পর্ব ছিলো অত্যন্ত উপভোগ্য।


দ্বিতীয় দিন আইএলএস হাসপাতাল পরিদর্শন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সকল কবিদের সাদরে গ্রহণ, পুরো হাসপাতাল ঘুরিয়ে দেখানো, অনুভূতি শেয়ার এবং আপ্যায়ণ কবি সম্মিলনের আয়োজনে বহুমাত্রিকতা যোগ করেছে।


কবি সম্মিলনে পরিতোষ দা যেন পণ করেছিলেন তিনি চমকের উপর চমক উপহার দেবেন, গড়বেন ইতিহাস যা থেকে আগামীর আয়োজকেরা পথ চলতে শিখবেন।  নব প্রান্তিক আশ্রমে গমণ এবং সেখানকার দেব শিশুদের সাথে দুপুরের খাবার গ্রহণ পর্ব ছিলো সম্মিলনে আগত কবিদের জন্য এক বিশেষ পবিত্র পাওয়া। বারবার একটি কথা আমি বলছি পরিতোষ দার এ আয়োজন শুধুমাত্র বিনোদনে সীমাবদ্ধ ছিলো না, ছিলো না শুধুমাত্র কবিদের সম্মিলিত হওয়ায়, আয়োজনটি ছিলো সেবা এবং মানবিকতার সাথে পথ চলার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।


বিকেল চারটে থেকে রাত দশটা অবধি ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বৈচিত্র্যতার ডালি কবি সম্মিলনে যোগ করেছে এক ব্যতিক্রমী জৌলুশ। উপস্থিত কবিগণ আকন্ঠ ডুবে ছিলেন জৌলুশময় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায়।


সাংস্কৃতিক পর্ব শেষে পরিতোষ দার ত্রিপুরার ঐতিহ্য বাঁশের তৈরী কারুশিল্প উপহার প্রাপ্তি ছিলো শেষ হয়েও হচ্ছে না শেষ এর মতো।  


পরিশেষে মিলন মেলার সমাপ্তি ঘোষণা করতে গিয়েও শেষ করতে দিলেন না পরিতোষ দা।  তিনি আয়োজনের ভুল ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়েই বাঁধালেন বিপত্তি। যিনি আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনকে কবি সম্মিলনে রুপ দিলেন, যার আয়োজন থেকে আগামীর আয়োজকেরা পথ চলতে শিখবেন তিনি ক্ষমা চাইলে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে যায় সর্বসম্মুখে স্বীকার করে নেয়া যে, আমরা শুধু মন প্রাণ জুড়িয়ে উপভোগ করি নি, সাথে আগামীর আয়োজনের পথ চিনে গেলাম। আর তাই নিয়ম ভেঙে বাধ্য হয়েই মঞ্চে উঠতে হলো আমাদের।


এতবড় আলোচনা পড়ার পর পাঠকের মনে হতেই পারে শুধু পরিতোষ দার গুনগান গেয়ে গেলাম। এই বিশাল আয়োজন কি পরিতোষ দা একাই করেছেন?  এই প্রশ্নের জবাবে বলছি, না এটি কোনভাবেই পরিতোষ দার একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। পরিতোষ দার সাথে ছিলো একটি সুদক্ষ টীম যাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার সুফল আমরা উপভোগ করেছি।


তবে একটি কারণে পরিতোষ দার এত গুনগান আর তা হলো তার বিচক্ষণতা।  কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন-
একা ব্যক্তি, সঙ্ঘ শক্তি।


জয় হোক বাংলা কবিতার, জয় হোক সঙ্ঘের, জয় হোক পরিতোষ দার।