বাবা আমি বড় হবো কবে?
বয়েস তো দু'কুড়ি পার করেছি তাও বছর তিনেক হবে। কিন্তু -
আমি যে হামাগুড়ি দিয়ে চলি এখনো।
আমি যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিনি এখনো!
নিজের হাতে তুলে খেতে পারিনা কিছু।
তাই বলে কি বাবা,
তোমরা আমার মুখে তুলে দাও খাবার?
মা দেখি সারাক্ষণ আমার পাশে পাশে থাকে অন্যকোনো কাজে মন নেই!
মা'কে খুব করে বকে দিও তো বাবা!
সারাক্ষণ যে বাছা বলে ডাকে!
আমি না বড় হচ্ছি!
বড় ছেলেকে কি কেউ বাছা বলে ডাকে?


আমাদের আম গাছের মগডালে ঝুলে থাকা আম দেখে দিদিকে বলেছিলাম!
আমি ওই মগডালে চড়ে আমখানা পেড়ে খাবো!
দিদি বলেছিল - বড় হও ভাই আমার,
তা নাহলে কেমন করে গাছে চড়বে?
আচ্ছা বাবা! আমি বড় হবো কবে?
পা দুটো যে জড়সড় অসাড় হুইল চেয়ারে সারাক্ষণ
ভালো কি থাকা যায় বলো?


সারাদিনের অবসন্নে ভাবি উঠোনের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ঝাপ করি,
হেঁটে গিয়ে দাঁড়াই শানবাঁধানো পুকুরপাড়ে। পদ্মপুকুরে ঝাপ দিয়ে সাঁতরে তুলে আনি পদ্ম।
মানুষ তো প্রতিদিনই একটু একটু করে বড় হয়!
ফুলু, বিপুল,শিমুল সবাই তো বড় হচ্ছে,
এমনকি উঠোনের পাশঘেষা ছোট্ট আম গাছটি চোখের সামনে একটু একটু করে বড় হলো। অথচ বাবা!
আমি কেন হচ্ছি না?


দলছোঁকরা'রা জলের রঙে এটা সেটা করে মাঠে দৌড়ায় রুপোলি গোলক নিয়ে।
আমি কিনা বসে দেখি নিথর চোখে,
চোখের কার্নিশ বেয়ে জলটলমল করে।
পা আমার ছটফট করে বিদ্যুৎএর মতো
কিন্তু একচুলও নড়াতে পারিনা।
একটুখানি নড়লে চড়লে পারদের মতো গড়িয়ে পড়ি।
আচ্ছা বাবা - আমি বড় হবো কবে?


হুইল চেয়ারের বন্ধুবিষাদে আটকে আছি কত যুগ!
ইচ্ছেছিল হাঁটবো তোমার আঙুল ছুঁয়ে
তোমার সাথে অকুন্ঠমনে।
দৌড়ে এসে পড়বো তোমার বুকের উপর
তুমি যখন দরজাখুলে ডাকবে আমায়।
চোখ এখন তাই দূরবীন হয়ে থাকে
কখন বাবা আসবে আমার কাছে!
আমি কেন যেতে পারিনা?


আমি যে চোখের ভারে নুজ হয়ে থাকি,
বড় হতে যে, ভীষণ ইচ্ছে করে আমার।
ইচ্ছেছিল, আমি তোমার ঢাল হবো !
তোমার পাশে দাঁড়াবো খুঁটি হয়ে।
আচ্ছা বাবা, গাছপালাঘেরা নির্জনেও এখন
শব্দ খুঁজতে গিয়ে তোমার পায়ের আওয়াজ পাইনা !
আমার কি তবে শ্রবণও আটকে গেছে হুইল চেয়ারে?


সবাই কত হাসে, চিৎকার করে, গান করে, হুল্লোর করে, আমি কিনা আড়মোড়া হয়ে পড়ে থাকি, দেখি নিরালা শব্দে ভরে যায় চারপাশটাতে।
আমারও যে ইচ্ছে করে চিৎকার করে মা'কে ডাকি, দিদির মতো মা'কে জাপটে ধরি!
যদি বড় হতাম, তবে কি তাই হতো?
আচ্ছা বাবা!!
আমি বড় হবো কবে?


যখন হাটতে শিখেছিলাম, পাশের বাড়ির ফুলুকে দেখতাম চার চাকার ছোট খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলতো।
আমিও তোমার কাছে আবদার রেখেছিলাম -
আমারও ফুলুর মতো গাড়ি চাই,
আমিও খেলবো ঘরের মেঝেতে।
সেই তো অবাক করে কিনে দিলে আমায় গাড়ি সেটা যে আমার সারাজীবনের সঙ্গি হয়ে যাবে
তা যদি বুঝতে পারতাম, কোনোদিন তোমার কাছে তা চাইতাম না!


মা'কে দেখি সারাক্ষণ নিজের ভিতর আড়ষ্ট ভাবে আটকে আছে,
ঠিক শামুকের মতো
বাইরে থেকে কঠিন আবৃত আর ভেতরে ভেতরে
উঁইপোকার মতো কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে।
চোখের পাশঘেষে যেনো বহতা নদী, জলে টলমল।
নিজের দিকে তাকানোর সময়টুকুও যেন
আমার হুইল চেয়ারে আটকে আছে।
চোখের নীচের কালোদাগ, দেখলে মনেহয়
জলের তোড়ে ক্ষয়ে যাওয়া মাটি।
জানো বাবা?
এসব দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় মায়ের চোখটা মুছে দিই, কিন্তু -
আমার হাতও যে অসাড়,
কিছুতেই যে আমার হাত মায়ের চোখ পর্যন্ত পৌছায় না!
আমি যদি বড় হতাম! মায়ের ছায়া হতাম ।
আচ্ছা বাবা!
আমি বড় হবো কবে?


এখন যে আমার শরীরের ভিতরেই শুকনো নদী। সাঁতরে পাড় করতে পারিনা সমস্ত দেহ,
ভিজে একাকার হই।
গোধূলি ভাসে অস্ত যাওয়া সূর্যবরণে,
পাতাহারা গাছের মতো ঠাঁয় বসে থাকি।
আমারও যে পাতাকুড়োতে মন চায়,
হাওয়াই ভাসতে মন চায়,
ঘুড়ি হতে ইচ্ছে করে।
এখন শুধু নিজেকে মনে হয়,
আকাশে পাখা মেলে উড়া ঘুড়ির সূতো,
এই বুঝি ছিঁড়ে গেলো আর আমি ভোকাট্টা।
আচ্ছা বাবা !
আমার কি উড়ে যাবার সময় হয়েছে?
তুমি বলো -
আমি কী তাহলে আর বড় হবোনা ?
আমার কি তবে মা'কে আদর করে জড়িয়ে ধরা আর হবে না?
তোমার হাত ধরে পথ পেরোনো হবেনা?
মগডালে চড়ে আমটিও পাড়া হবেনা!
আমার বোধয় ছুটি ডাকছে! লম্বা ছুটি!
আর বোধয় বড় হওয়া হলোনা।