একুশের প্রত্যাশা
আল আমিন স্বপন
রাষ্ট্রভাষা বাংলা, বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠা বায়ান্নের রক্তস্নাত আন্দোলনের বয়স তেষট্টি বছর। দেশ স্বাধীন,  ভাষা স্বাধীন, ভাষাদিবস, স্বাধীনতাদিবস, বিজয়দিবস, জন্মদিবস, মৃত্যুদিবস সবই সময় মত সরকারী বেসরকারী ভাবে পালন করা হচ্ছে। কিন্তু জনগণ কতটুকু স্বাধীন, কতটুকু নিরপেক্ষ ভাবে চলতে পারছে বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারছে। বাক স্বাধীনতার প্রতিফলন কতটুকু ? ক্ষমতার ভিতরে এবং ক্ষমতার বাইরে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখা বা বলা মানুষের অন্তরে অণুরণন হয়ে দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও সরকারী উচ্চ পর্যায় দাপ্তরিক ভাষা এবং সুউচ্চ আদালতের বিচারের রায়ে লিখিত ভাষা বাংলা কি স্বাধীন ? এই প্রশ্নের উত্তর চাইতে চাইতে আবার একষট্টি বছরে একুশ এসেছে রাষ্ট্রের কাছে।  মনে হচ্ছে অত্যাচার, জুলুম, নিপিড়ন সহ্য করে বাংলা ভাষা টিকে আছে লেখক,কবি, সাহিত্যেক, সাংস্কৃতিক কর্মী, পেপার-পত্রিকা আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আদলে। প্রকাশ্যে ইংরেজী আর গোপনে হিন্দি ভাষার উৎপাত চলছে বাংলা উপর। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন কতটুকু হয়েছে ? আদৌ কি হবে! এগারো মাস নিরুদ্ধেগ আর প্রায় ঘুমের মধ্যে থেকে ফেরুয়ারী এলেই ভাষার মাস ভেবে জেগে উঠি। যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে ভাষা ভিত্তিক সে রাষ্ট্র এখন হিন্দী ভাষার বেড়াজ্বালে প্রায় আবদ্ধ। ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক ডিশ্‌ লাইনের অপ্রতিরুদ্ধ সংযোগ যুক্ত হয়ে ঘরে ঘরে চলছে হিন্দী চ্যানেল। সিনেমা, সিরিয়াল আর কার্টুন ছবির সমারোহ। যা দেখে মানুষ শিখছে পরকিয়া প্রেম, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, আদব-লেহাজ ভুলে বেপরয়া বেলেহাজীপনা। অন্যদিকে বাচ্চারা কার্টুন দেখে বাংলায় কথা না বলে হিন্দীতে বলা শুরু করছে।  বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে প্রচার নিসিদ্ধ থাকা সত্যেও আমাদের টনক্‌ নড়ছে না। এই ভাবে চলতে থাকলে কোন একদিন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি নদী ভাংনের মত বেকায়দায় পরে অন্য দেশের ঢলে হাবু-ডুবু খাবে। এমনিতেই মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির মধ্যে কুয়েতে অবস্থাকারী বাংলাদেশের ছেলে মেয়েরা বাংলাদেশ স্কুল না থাকাতে এখানে ইন্ডিয়ান স্কুলে লেখাপড়া করছে। প্রত্যেকটি ছেলে মেয়ে ভারতীয় জাতিয় সঙ্গীত ভাল গায়। বাংলা না জানলেও ইংলীশ অক্ষরে বাংলা উচ্চারণ লিখে কোন রকম সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান চালিয়ে নেয়। তবে এখানকার ছেলে মেয়েরা ইংলীশে ভাল। এটাই তাদের স্মার্টনেস্‌ মনে করে থাকি। অন্যদিকে একুশে ফেব্রুয়ারী 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' এলেই আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার ইতিহাস, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে শহীদানদের রক্তের আবেক তুলে বক্তিতা দেই, দেশমাতৃকার প্রতি অগাধ ভালবাসার কথা বলি। ঘরে-বাইরে ছেলে মেয়েরা ইংলীশ বলতে পারলে আমরা বেশীর ভাগ মানুষ মেধাবী মনে করে থাকি। আসলে ইংলীশ একটি  আন্তর্জাতিক ভাষা, এটা শিখার যতটুকু দরকার তার চেয়ে বেশী প্রয়োজন মায়ের ভাষা, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা শেখা এবং গবেষণা করে ভাষার উৎকর্ষ সাধন করা।
আমাদের জাতীয় জীবনেও বাংলা ভাষা অবেহেলিত। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার শপথ থাকলেও উচ্চ আদালত, উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞানশিক্ষা এমন কি প্রশসনের উচ্চ পর্যায় বাংলা ভাষার প্রচলন এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের মধ্যে ধনিক শ্রেনীর ছেলে মেয়েরা ইংরেজী মাধ্যমে পড়া লেখা করে বাংলা ভাষায় কথক কথনের সময় ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করছে। প্রয়োজন না থাকলেও ইংরজী বলতে এতটুকু সংকোয করে না। আমাদের উচিৎ প্রতিটি ছেলে মেয়েদের অন্তরে বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা ও তাদের  অনুভূতিতে মাতৃভাষার বীজ গেঁথে দেওয়া। প্রয়োজনের খাতিরে অন্যের ভাষা জানা থকলেও যেন আপন ভাষা সংস্কৃতি চিরজীবন লালন করতে পারে। অমর একুশের গুরুত্ব যেন তাদের কাছে বিনির্মাণ হয়ে থাকে। অবহেলে যেন হারিয়ে না যায়  মুরুব্বিদের আত্ম ত্যাগের ইতিহাস।
আমাদের এখন অনেক টিভি চ্যানেল। নাটক, সিনেমা, টক্‌শো, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, দেশীয় গান, নাচ-গানের প্রতিযোগিতা এবং অন্যান্য। মঞ্চস্থ্য অনেক গানের আসরে দেশের গান পরিবেশনের প্রচলন থাকলেও ব্যন্ডসঙ্গীতের অসংখ্য গান ইংলীশের মত উচ্চারণ করে গায়লে প্রকৃত বাংলা গানের সূর মৌলিকত্ব হারিয়ে একটা সাময়িক করতালীর কলোরব সৃষ্টি করছে। এর কোন স্থায়ী ভিত্তি নাই। তবে কিছু কিছু ফোগ গান আছে যা ব্যন্ড সঙ্গিতের মাধ্যমে দেশের অস্তিত্ত্বকে পুনঃ নির্মাণ করছে।
নিজে জেগে উঠো অন্যকে জাগাও, স্বদইচ্ছার অভাবটাকে দূরে ফেলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করাই এখন আমাদের ঐতিয্য রক্ষা করার সময় এসে গেছে। *
ফেব্রুয়ারী মাস এলেই আমাদের ভাষার চেতনা জাগ্রত হয়। একুশের বই মেলায় বই প্রকাশ, প্রবন্ধ, নিবন্ধন, শিশুসাহিত্য, কবিতার বই, আবৃতি আর গানের ঝংকারে ভরে উঠে বাংলা একাডেমীর প্রঙ্গন। আমাদের প্রানের মেলা এই বই মেলা। বইয়ের রঙীন মলাট'র ইমেজ আর বইয়ের পাতার গন্ধ সম্মোহিত  করে তুলে পাঠক কে। লেখক, পাঠক আর প্রকাশকের সাক্ষাতে ভরে উঠে ঐতিয্যবাহী মিলন মেলা।
একুশের চেতনায় আবেগ আপ্লুত হয়ে বায়ান্নের স্মৃতি স্মরণ করি, শহীদানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি এবং ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাই। সেই চেতনার আত্মত্যাগ আমাদের ভাষা আন্দোলনের অবদমিত সংগ্রাম সারা বিশ্বের কাছে একুশ আজ প্রতিষ্ঠিত।
ইংরেজী ভাষা হচ্ছে পুঁজীবাদের ভাষা। হাইহিল আর টাইড্‌ ফিটিং ফ্যাশন শো নারী পন্যের বাজারে গৃহদাহ বাঙলী সংস্কৃতি, নিতান্তাই আলবেলা। জন্মদিন, বিয়ে-স্বাদীর দাওয়াত পত্রে এমনকি দোকান-পাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে রং চং দিয়ে ইংলীশে নাম পরিচয় লিখা, মর্যাদাবোধ করা হয়। এই সমস্ত মন মানসিকতা দিন বা দিন বেড়ে যাচ্ছে বিধায় বাংলা ভাষার প্রকৃত অবস্থান থেকে আমরা সরে যাচ্ছি। ইংলীশ শিখার জন্য আমরা বেশী মাইনে (টাকা) দিয়ে শিক্ষক রাখি কিন্তু বাংলা শিখার প্রতি গুরুত্ব দেই না। অথচ বর্তমান ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় বাংলায় খবর, উপস্থাপনা ও যে কনো অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য বাংলা উচ্চচারণ, শব্দ ধারণ, বাক্য চারণ ইত্যাদির প্রয়োজনিয়তা অনেক। যারা গল্প-উপন্যাস,কবিতা,প্রবন্ধ,নাটক, বিজ্ঞাপন এবং গানের লিড়িক লিখেন বা লিখতে অভ্যাস করছেন, তাদের জন্য বাংলা ভাষা, শব্দ, প্রতিশব্দ অনুশীলন করা অত্যাবশকীয়। ভাল লিখতে পারলে এবং বাংলা ভাল বলতে পারলে আজ কাল যে কনো মিডিয়াতে নিজের কাজ করলে অর্থ সম্পদ ও নাম  যস্‌-খ্যাতি সর্বস্ব ছড়িঁয়ে পরবে। এ যুগের ইয়াং ছেলে মেয়েরা যে কনো মিডিয়াতে কাজ করার  জন্য অত্যান্ত আগ্রহী। তাই বাংলা ভাষা ভাল ভাবে আতস্ত করে এবং নিজেকে তৈরী করতে পারলে সময় মত অবশ্যই তা মর্যাদা লাভ করবে। তাই বাংলা পড়ুন এবং নিজের শন্তানকে ভাল ভাবে বাংলা শিক্ষা দিন। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন আমাদের মায়ের ভাষা, মাতৃভাষা বাংলার চর্চা করুন। দূরদেশ দূরপ্রবাসে কর্মবস্ততার মাঝেও যারা আত্মচেতনায় নিজের আত্ম উপলব্ধিতে আপন ভাষায় কবিতা চর্চা, প্রবন্ধ, উপন্যাস এবং সাংবাদিকতায় অবদান রেখে যাচ্ছেন তারা কনো পদক পাওয়া জন্য লিখছেন না। তাদের লেখা-লেখির অবদান স্বদেশের অনুভব, একুশের স্মরণিয় আবেগ। প্রবাসী বাঙালী বিভিন্ন ভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠন করে দেশের শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার উৎকর্ষ সাধনে যথেষ্ট অবদান রেখে যাচ্ছেন।
একুশ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা থেকেই আমাদের আজকের বাংলাদেশ। রক্তিম একুশের বুলন্দাজ আওয়াজ থেকেই ১৯৫৬ সালে প্রণিত সংবিধাণে তৎকালিন পাকিস্তান সরকার বাংলাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। ভাষা আন্দোলন আমাদের কাছে অত্যান্ত গুরুত্ব এক অধ্যায়, যার পটভূমি উদ্ভাবিত স্বাধীকার চেতানা অঙ্কুরিত হয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল। আমাদের স্বপার্জিত স্বাধীনতা ও আমাদের একটি মাত্র ভাষা বাংলা। সেই একুশের ইতিহাস কথা বলতে বলতে এখন জাতিসংঘ ইউনেস্কো কতৃক ঘোষিত  এই পৃথিবীর সকল জাতি সকল মানুষের মুখের ভাষা আজ একুশে ফেব্রুয়ারী "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'' হিসেবে স্বীকৃত। তাই একুশের প্রত্যাশা আজ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার দাবী।
© আল আমিন স্বপন
     ০৫/০২/২০১৫