১. শৈশব


সে অনেক অনেক আগের কথা, বিকেল বেলা,
তখন কায়ের গোটায় সুতো দিয়ে গাঁথতাম মালা।
সবুজ সবুজ, কালো কালো, পুথির মতো কায়ের গোটা,
একটুখানি লম্বা মতো দুপাশে তার সাদা ফোঁটা।
এমনই এক সোনালি বিকেলে প্রথম দেখেছি তাকে,
ঘামে ভেজা নাকের উপর চোখ যেন তার ছবি আঁকে।


ও পাড়ার সুন্দরী মেয়ে, বেড়াতে আসে এ পাড়ায়,
কদিন থাকে, হাসে খেলে একসাথে, ফের চলে যায়।
শীতকালের সোনালি বিকেলে পাটখড়ি আর গোবর দিয়ে,
লাকড়ি বানানোর ধুম পড়ে যায় দুই গ্রামে।
তখন লাউয়ের ডগায় খেলা করে ফড়িঙেরা দলে দলে,
সকালের রোদে খড়ের গাদায় হাসাহাসি করতাম আমরা সকলে।


ও পাড়ার সুন্দরী সে মেয়ে এসব দেখে লুটোপুটি খেত হেসে,
‘কেমন আছেন?’ হঠাৎ মেয়েটি বলত কাছে এসে।
আমার হাসি যেত সব থেমে; চোখমুখ যেত ঘেমে।
বন্ধ হয়ে যেত গলার স্বর; সারা মুখে লজ্জা আসত নেমে।
এমনি করে শৈশব যায় কেটে কায়ের গোটার কালো মালা হাতে;
ওই মেয়েটির গলায় পড়াব মালা, ভেবেই আমার ঘুম আসে না রাতে।


২. নব যৌবন


বসন্তে ডাকছে কোকিল, আমের বনে ভ্রমরের গুঞ্জন।
ও পাড়ার সুন্দরী ষোড়শী মেয়ে পেয়েছে নব যৌবন।
এ পাড়ার কথা গেছে কি সে ভুলে এতোদিনে?
শৈশবের স্মৃতি কাড়া নাড়ে কি তার যৌবনে?
সুন্দরী মেয়েটি আরও সুন্দরী হয়েছে, নাদুস নুদুস গাল,
থুতনির উপর ঠোঁট জোড়া তার গোলাপের ন্যায় লাল।


বাবার একটি মাত্র মেয়ে সে যে, আদরে হয়েছে বড়ো
আদরে আদরে আলস্য তার শরীরে হয়েছে জড়ো।
নানা গ্রাম হতে মেয়েটিকে নিতে , আসছে বিয়ের ঘর।
অবশেষে তাকে নিয়ে গেল এসে, অচিন গাঁয়ের বর।
মেয়েটিকে আমি কাঁদতে দেখেছি, জড়ায়ে বাবার বুক।
চলে গেল মেয়ে দূর কোনো গাঁয়ে, এ বুকেও ধুকপুক।


হয়তো সে সুখে আছে, নতুনের ঘরে নতুন করে।
এ পাড়ার কথা এখন কি তার একটুও মনে পড়ে?
কতোদিন হয় দেখি না তারে, কেমন আছে মনসখি।
এ মনের সব লুকানো যাতনা এ মনেই লুকিয়ে রাখি।
কত আশা ছিল মেয়েটিকে আমি, চুড়ি পড়াব দুই হাতে;
সেই হাত এখন অন্য কারো, আমার ঘুম আসে না রাতে।


৩. যৌবন যায়


অর্ধ যুগের পরে পেয়েছি খবর টেলিফোনে টেলিফোনে,
ও পাড়ার মেয়ের দিনকাটে একা ছোট্ট ঘরের কোণে।
ভোর হলে পর, তার সোনা বর, চলে যায় দূরে অফিসে,
রাত চলে যায় আধেক আধারে, তারপর আসে সে।
রোজ রোজ তার একই রুটিন, গঁদবাঁধা সংসার
সেই মেয়েটির মনের মাঝে, ধিকিধিকি জ্বলে অঙ্গার।


যৌবন যায়, ঘরে সুখ নাই। নিত্যদিনই আগুন জ্বলে বুকে।
একটি মেয়ে ঘরের কোণে নিত্যদিনই মরছে ধুঁকে ধুঁকে।
নারীর সুখ পূর্ণতা পায় মাতৃত্বের স্বাদ আস্বাদনে।
দেহের আগুন জ্বলছে জ্বলুক, মনের আগুন নিভবে কেমনে?
তার ছবি আঁকা চোখ অহর্নিশ সিক্ত থাকে একাকীত্বের বেদনায়।
পৃথিবীর বুকে একা সে নারী। কোথাও কেউ নাই, কেউ নাই।


সুন্দরীর চেহারা এখন হয়েছে মলিন, চোখের নিচে কালি;
রোজ রাতে পিঠের 'পর খায় কিল-ঘুসি, শুনে বিশ্রি কত গালি।
আমারই সব দোষ। কেন তাকে নব যৌবনে ‘ভালোবাসি’ বলিনি।
হয়তো তবে সব ফেলে দিয়ে আমার কাছে ছুটে আসত তখনি।
সোনার শরীর তার পেয়েছে কর্মকার, স্বর্ণকারের ন্যায় গহনা হবে কি তাতে?
আহা! তখন যদি বলতাম আমি, ‘ভালোবাসি’; ভেবে আমার ঘুম আসে না রাতে।