আকাশে উঠিলে চাঁদ শুনি একেলা,
দূর হতে সুর তুলে মোর সুরবালা।
উঠোনে পেতেছে চাটাই বসিছে তাতে,
সুরবালা গান গায় জোছনার রাতে।
হাতে তার কাঁকন জোড়া ওঠে দুলিয়া,
সুর শুনে প্রাণ মোর ওঠে কাপিয়া।
চারিধারে বালক-বালিকায় বাজাইছে কাঁসর,
তারি মাঝে সুরবালা পেতেছে আসর।
কোনোদিন যাই না আমি কাছে তার,
আমি কাছে গেলে নাকি গলা হয় ভার।
দূর হতে শুনি তাই সুরবালার গান,
তাই শুনে প্রাণখানি করে আনচান।


একদা বসিলে হাট কদমতলে,
সুরবালা ডাকে মোরে মনের ভুলে।
সেই ডাক শুনি আমি অধীর হয়ে,
ডাকিছে আমারে যেন সুর-তাল-লয়ে।
হাত দুটি ভরা তার কাসার কাঁকন
চোখ দুটি জোড়া তার ভয়াল কাঁদন।
সুরবালার ঘর ছিল ভাসা নৌকায়,
বাপ তার মরিয়াছে, নাই আর ঠাঁই।
মাও তারে ফেলিয়াছে নদীর ঘাটে,
পথ ভুলে আসিয়াছে অচেনা হাটে।


দায়া করে আমি তারে নিয়ে আসি বাড়ি,
তাহারে লালন করে মোর দাদি বুড়ি।
দাদি বুড়ি গত হয় বৈশাখ মাসে,
সুরবালা সুর তুলে আষাঢ়ে হাসে।
   'ওই হই, আইলো আইলো, আইলো দেওয়া,
    আসমান ভরিয়া,
    সুরবালা কয় তোমরা সবে, না থাইকো ডরিয়া;
    আল্লাহ আল্লাহ করো সবে, রসুলের নাম লও;
    দেওয়ার তরে তোমরা কেহ, খারাপ নাহি কও।'


আকাশে উঠিছে চাঁদ এখন চৈত্র মাস,
সুরবালা করেছে আমার মনের সর্বনাশ।
কাঁসরের তালে তালে তুলেছে ধ্বনি,
সেই ধ্বনি নিয়াছে কাড়ি মোর প্রাণখানি।
সুরবালার আসরে আমার যাওয়া মানা,
আমি নাকি গেলে তার গলায় পড়ে হানা।
অনুরোধের সকল গান সুরবালা গায়,
শত শত গানের মাঝে আমার গান নাই।
তবু তারে রাখিয়াছি হৃদয়ে সাজায়ে,
ডাকিয়াছি আজ রাতে বাশরি বাজায়ে।


আধেক রাত কাটিয়াছে গাঁওখানি ঘুম,
চাঁদটুকু আছে কেবল রাত্রি নিঝুম।
আসিয়াছে সুরবালা চুপিচুপি কাছে,
বসিয়াছি দুজন মোরা অশ্বত্থ গাছে।
শুধাই তারে— মোর মন মতো গান,
মোর জন্য একদিন গাইবি একখান?
বলে মোরে— তোর গান গাইতে গেলে,
পরাণ কাপে মোর, সুর যাই ভুলে।
বলিলাম— তোর সুর যে আমারে পাগল করে,
আমি হন্যে হই, থাকিতে পারিনে ঘরে।
সুরবালা নিশ্চুপ। বলে না কথা। চুপচাপ বসে।
আমাদের কথা শুনে আকাশের চাঁদটুকু হাসে।
বলিলাম আবার— তোর সুরে মোর হয় মরার ডর।
হিংসেও হয়। কোথা পেলি তুই এই সুর, এই স্বর?
হাসি মুখে বলে— এইটুকু মরা বাপের দান।
এই লয়ে বাঁচি আছি। এই মোর প্রাণ।


বলিলাম— চোখ বোজ সুরবালা, বস কাছে আসি।
এইটুকু খা তুই। তোরে আমি কতো ভালোবাসি।
এই বলে তার গালে দিলাম কুক পাতা,
কুক পাতা খেলে জানি নিভে যায় কথা।
স্বর তার উবে গেল কুক পাতা খেয়ে,
আজ হতে সুরবালা বোবা এক মেয়ে।
মোর লাগি নাহি যদি গায় সে, বোবা থাকা ভালো।
মোর প্রাণে না জ্বালিলে, না থাকুক তার আলো।
আকাশে উঠিছে চাঁদ, তারার মেলা,
সম্মুখে বসে আছে, মোর সুরবালা।
সুর নাই, স্বর নাই, গাঁও থমথমে।
এই বুকে মাথা রেখে সুরবালা ঘুমে।


এই করে দিন যায়, মাস যায় চলে।
চুপে কাঁদে সুরবালা, বোবা মেয়ে বলে।
বুক তার ফাঁটি যায়, রোজ পাই টের।
মৃত্যুও ভালো ছিল, এর চেয়ে ঢের।
অশ্বত্থের ডালে তারে আনিলাম আবার,
পেট ভরে খেতে দিলাম পছন্দের খাবার।
বলিলাম— চোখ বোজ সুরবালা, বস কাছে আসি।
এইটুকু বলে তার গলে দেই ফাঁসি।
অশ্বত্থের ডাল হতে নিচে দেই ফেলে,
সুরবালা ঝুলে আছে একদিকে হেলে।
পরদিন ভোর হলে গ্রামবাসী আসে;
সকলের সাথে মোর বুক কাঁদি ভাসে।
অশ্বত্থের তলে তারে দাফন করি,
দিন যায় রাত আসে বছর ঘুরি।
আকাশে উঠিছে চাঁদ আমি একেলা,
সম্মুখে শুয়ে আছে মোর সুরবালা।
গাঁওখানি মরে গেছে, কোথা নাই সুর।
সকলি ঘুমায় রাতে, কেবল মোর হয় ভোর।