পুরনো দিনের সকল গল্পেরই হইয়াছে ইতি
আমার মনঃকোণে সবই আজ স্মৃতি।
পার করিয়া আসিয়াছি কত দিন, কত বিকেল
ফেলিয়া আসিয়াছি ঘুড়ির লাটাই লাটিম আর মার্বেল।
ছোট ছিনু তখন বুঝিনি অতশত
বাবা আনিয়া দিয়েছিল ছড়ার বই কত।
ছড়ার বই, ছবির বই, কার্টুনের বই ছিল
একটি বই পড়িতে দুটি তার ছিড়িয়া গিয়েছিল।
পরদিন আবার জিদ, আরো বই চাই
কদিন পরে, সকাল হলে স্কুলেতে যাই।
সারাদিন দৌড়ঝাপ, ছুটোছুটি দিন কাটে খেলে
মাস্টার মশাই কহিত, ‘বড়ই দুষ্ট ছেলে’।
ছুটির ঘন্টা বাজিলে শুরু হয়, সে-কি চিতকার-চেচামেচি
জামা খুলে ছুড়ে মারে, আগে বেরোলে বাঁচি।
স্কুলে যাওয়া-আসা প্রতিদিন পড়াশোনা নাই
ক্লাসে পড়া ধরিলে স্যার, দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
সেদিনের সব মিষ্টি সাজা চিরজীবন চাই
আজিকের সব আদর যেন তৎসম নয় ।
বরই কত ধরিয়াছে বরই গাছের মাথে
ঢিল ছুড়ে মারে স্কুল যাবার পথে ।
পরের গাছের ফল খাওয়া, চুরি তবু নয়
গাছওয়ালা তাড়া করে দৌরানির হয়েছে সময় ।
ধান খাটা হল সারা ফাঁকা আমন এর মাঠ  
বিকেল পরিতেই কত বালক ঘুরির লাটাই হাতে ।
ঘুড়ি উড়ে চলে যায় আমরাও অনেক দুরে
বাড়ি ফিরিতে আকাশ খানি কালো রং ধরে।
গৃহের সামনে আসিতে মায়ের সে কি বকুনি
আগে আগে কলে গিয়ে  হাত মুখ ধুয়ে প্রস্তুত তখনি ।
বাতি জ্বালিয়ে দিলে মা, বই নিয়ে বসে একটুখানি
বইপনে চেয়ে,’সমস্তদিন কি করিয়াছি, কোনখানি’।  
রাত ভারি না হতেই ‘খবার দাও মা’
মা রেগে,’খেয়েদেয়ে এখনি বিছানায় শুতে যা’।
পরদিন সকাল হতেই ছেলেরা আসে খেলিতে
সকাল পেরিয়ে যায় ফুটবল, মার্বেই আর গুলিতে।
একটা ছেড়ে আরটা খেলা আছে খেলা কত!
ছেলে জমিবে আরো, বেলা বাড়িবে যত।
খেলিতে খেলিতে দুপুর হয়, খাইবার কথা নাই
তবু মনে প্রশ্ন হয়, এত তাড়াতাড়ি কেন দুপুর হয়?
খেলাশেষে দলবেঁধে গাঁয়ের শেষের পুকুরে
নাইতে গেলে সবাই মিলে, দুপুর যায় দুপুরে।
বাড়ি ফিরিতে পথের সামনে মা থেকে দাঁড়িয়ে
‘ছন্নছড়া, কোথায় গিয়েছিলি? দুপুর যায় গড়িয়ে’।
‘তোর বাবাকে বলে দিব’ এমনও শাসন করে
আরো বলে, এরপর ‘তোর হাত-পা বেধে রাখব ঘরে।
কোন বাধা মানে না যে বিকেল আবার হয়
‘সন্ধ্যে না হতেই ফিরব মা এবার যেতে দাও’।
আবার ফিরতে সন্ধ্যা হয়, মা’র বকুনি ভয়
কেমন করে ফিরব বাড়ি, পা যে কেটে গেছে আমার।
মা’র ভতে খেলে বেড়িয়ে কত কাটিয়েছি দিন
এমন স্মৃতি রইবে মনে যে কারো চিরদিন।
হঠাৎ আবার জিদ ওঠে ‘মা বেড়াতে যাব
কবে আবার নানাবাড়ির পথের সুবাস পাব।
দু-তিনদিন জিদ ধরে মা’র পিছু পিছু কান্না
রাগ করে মা বলে ‘কালই যাব এবার একটু থাম না!
শুনেও ভালো লাগে, নানাবাড়ি যাব  
আগে থেকেই চিন্তাভাবনা গিয়ে কি কি করব।
সারারাত ঘুম্নাই, সুয্যি কখন জাগে
মায়ের বাড়ির কথা শুনে মা’রও ভালো লাগে।
সকাল হতেই মনে গান নানাবাড়ি যাইরে
গিয়ে দেখি নানাভাই চেয়ার নিয়ে বসে থাকে বাইরে।
সালাম করে ভিতরে ঢুকি, মাও সালাম করে
নানি আমায় কোলে নিয়ে খুব আদর করে।
মা, খালা আর মামিমা ব্যস্ত যখন রান্নায়
নানি আমায় কোলে নিয়ে কত না গল্প শোনায়!
নানাভাই এসে বলে ‘চল বাজারে যাই’
কাতলা মাছের মাথা দিয়ে রান্না হবে পোলাও।
নানি আরো যোগ করে ‘জামা ওকে কিনে দিয়ো বাজারে গিয়ে
উচ্চ হেসে নানা বলে ‘তা বুঝব আমরা দুই ভাইয়ে’।
বাড়ি ফিরলে অনেক কিছু কিনে
মামা বলে, ‘বাজারে যাবো, চল ভাগিনে’।
নানাবাড়ি, বাগানবাড়ি, লোকে বলে মধুর হাড়ি
সবই ভালো লাগে এটাই নানাবাড়ি।
দিনভর আনন্দ, খাওয়া-দাওয়া, ঘোরাফেরা
রাত্রি হলে একই ঘরে সবাই মিলে গল্প-গুজব করা।
দিনকতক কাটিলে মা বলে ফিরতে হবে বাড়ি
তখনও বলি, ‘করোনা মা আর ক’টা দিন দেরি’।
বাড়ি যখন ফিরে আসি হাসি আর উৎফুল্লে
‘মামির জামাই’ নলে ঠাট্টা করত চাচি-বড়মা’র দলে।
লজ্জা পেয়ে চলে যাই আমি তাড়াতাড়ি
দাদিমা ডাকে আবার ফিরে দেখি বাড়ি।
কি খেলি? কি করলি? এমনি প্রশ্ন করে
এতদিন কেন ছিলি সেথায় দাদু? আমায় তুই ছেড়ে।
আমার বাড়ি মানায় নাকি চাঁদের আলো না পেলে?
আদর করে দাদিমা আমার কাছে বলে।
মানুষগুলি ফুরিয়ে যায়। আদর কোথায় যায়?
দাম দিয়েও এমন আদর আর কি পাওয়া যায়!
বিষন্ন জীবনে ক্লান্তি লাগবে যখনি
জানি, সকলেরই পড়বে মনে ছেলেবেলার কাহিনী।
পুরনো সে সকল গল্পেরই হইয়াছে ইতি
সেদিনের কাহিনী সবই আজ স্মৃতি, শৈশবস্মৃতি।