পর্ব – ০১


বাঁকা দুটি চোখ,
তার ঐ মায়াভরা মোখ,
যা বলে বলুকনা নাহয় সহস্র লোক,
তারা কি জানে কি বুঝে, কার মনে কোন সুখ কিবা শোক ।
কত আহত প্রেম হায়,
কত জনেরে নিভৃতে জ্বালায় পোড়ায়,
মনের ভিতরে ঝড়, কয়জনে সে খবর বলো রাখে পায় ।
যদিরে একবার, সয়ে যায় তা ঐ দেহটায়,
মন বলে যা তাতে কি আসে যায়, কদিন আছি এ দুনিয়ায়,
সবে নাহি দেখে তা, যদিওরে কিছুটা ফুটে উঠে তার ঐ চোখ ও চেহারায়,
ভালবাসার মানুষটা যদি কারো যায়রে হারায়,
সব পেয়েও সব থেকেও হায়, এক বিরহী জনযে হতে পারে কত অসহায় ।
দাসী-বাঁদীরা ঘুরে বেড়ায় আংগিনায়,  
আজ সে রাজবাড়ীর বউ, প্রাসাদে বসবাস কত ঝলমলে শাড়ী গহনায়,
বিজয়ী রাণীর রুপ ঝড়ে পড়ে,
হেরে যাওয়া সংগীটি তার মনের বিজন ঘরে,  
সুখে আছে ভেবে সে সুখ পায়, হাহাকার চেপে ধরে অন্তরে বসে দূর অজানায় ।
তার সে টোলপড়া গাল,
রলেও বিভোর হলেও প্রেমেতে মাতাল,
সে কি কথা, বিষন্নতার ভালবাসায় কিগো রাখিবে জড়ায় চিরকাল ।
হলেও দীনহীন কাঙাল,
আমি নই, হইনি কভু বেসুরো কিবা বেসামাল,
কারো সুখ-মান কাড়িনি, হইনি পথের কাঁটা কিবা কারো জীবনের জন্জাল ।
হৈ চৈ কোন কান্ড,
রই রই ব্যাপার তুলকালাম ভাংচূর তৈজষ ভান্ড,
কেন তারে শুধু পড়ে মনে,
যবে নিদ বিহনে, বিজন ঘরে নিঝুম রাত গহীনে,
উদাস আকুল করা, প্রেম বাসনায় ভরা, এমন কত আহত সকাল দুপুর ও বিকাল ।
দুঃসহ কষ্ট তাই,
সে বাঁধন খুলে তারে আমি ভুলে যেতে চাই,
নাই মোর আফসোস, লোভ, অভিযোগ কিবা ক্ষোভ আর কোন আশাওতো নাই ।
এক মাটির মন্দিরে,
লাখো লাখো দুঃখী মানুষের ভিড়ে,
ভার করে রাখা একখানা চেনা মোখ আমায় রাখে ঘিরে,
চুপ করে থাকা চোখে চোখ পড়ে, কোন অভিমানে হঠাৎ সে কেনরে পিছনে যায় ফিরে ।
কোন অপরাধে কে জানে হায়,
প্রিয়জনেরে না পাওয়া কিবা হারানোর বেদনায়,
তবু সে নিজেরে ঐ বিবেকের ঘরে, বড় অপরাধী করে অনুশোচনায় ।
কারো সুখ কেড়ে নিতে নাহি হায়,
আপন সুখের লাগি সে কভু আর নহে তারে ফিরে পেতে চায়,
তার দুহাত বাড়িয়ে রয়েছে সে দাড়িয়ে, ঐ হাত দুটি ধরে প্রিয়ার শুধু ক্ষমা পাওয়ার আশায় ।
অশ্রুহীন নিরব রোদন,
এ ভুবনটা যেন তার, একটা পোড়াবন,
ঠোটে হাসি, বুঝি তাই দেখেনা, বুঝেনা ও করেনা শ্রবণ,  
সুন্দর অভিনয়ের ঘর, তাই আপন কিবা পর, এ জগতের কেউ কোন লোকজন ।
তবু তারাই সেরা বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ,
চাহেনা একসের, সব সয় মেনে লয় গোজামিলের এ জীবন,
আহা ঐ বিদ্যার বলো তার কি প্রয়োজন, থাকিতে জীবন না ফুটিল যার ঐ তৃতীয় নয়ন,
যায় দিন যাক, সবে সুখে থাক, আর শুধু তার ভালটুকু পাক, যা চাহে মন যার ও গোপনে হায় যা খুঁজে বেড়ায় ।


পর্ব – ০২  

অনটন আর টানাপোড়নের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার ।
এক অনন্য আদর্শ পিতা-মাতা, তাদের ছিল পাঁচ কন্যা ও চার পুত্রের সংসার ।
দীনতা, পরহেজগারি ও সততা এই তিন বৈশিষ্টের জন্য যে দম্পতি স্বজন, সহকর্মী, প্রতিবেশী, পরিচিত মহল, এলাকাবাসী, মহল্লা বা প্রাম ও গ্রামীণ সমাজের কাছে হয়েছিল অতিশয় বিখ্যাত ।


মহকুমা খাদ্য কর্মকর্তার কার্য্যালয় এর বড়বাবু বা হেডক্লার্ক । কাগজে কলমে তিনি অফিস সুপারেন্টেনডেন্ট কাম একাউন্টেন্ট । বাস্তবে তিনি প্রধান কর্মকর্তার সহকারী বা সেক্রেটারী । বাবার অফিসের কাছেই ছিল এলাকার কেন্দ্রিয় জামে মসজিদ, সেখানেই তিনি তার কর্ম দিবসগুলিতে ৩/৪ ওয়াক্ত নামাজ জমাতে আদায় করতেন । ঐ মসজিদ পরিষদ ও স্থানীয় মুসল্লীগণ কর্তৃক তিনি তার কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন একযুগেরও অধিক সময় । এলাকাবাসী পরম শ্রদ্ধাভরে তাকে সুফী সাহেব বলে সম্বোধন করতেন আর এভাবেই গোটা এলাকায় তার সুফী সাহেব উপাধি অর্জন হয় এবং ধীরে ধীরে এক সময় তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় । দয়াময় আল্লাহপাক দয়া করে তাকে জান্নাত দান করুন ।


আর তাদের মহিয়সী মাতা যখন যেখানে থাকতেন বা ছিলেন সেখানকার স্থানীয় হিন্দু মুসলমান মহিলাদের সংগেই তার একটা সখ্যতা হয়ে যেতো । তিনি ঘরে থেকেই ঐ সকল মহিলাগণদেরকে নিয়ে প্রায় নিয়মিত মহিলা মজলিস করতেন । তারা সকলে তার কাছে এসে ইসলামী জীবনের গল্প শোনা ও তালিম নেওয়া, পান খাওয়া এবং নানা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যাজনিত সুখ-দুঃখের কথা বলতেন আর তিনি তাদেরকে সান্তনা ও সদুপদেশ দিতেন । আর যারা অভাবে বা খাবারের কষ্টে ছিলেন তাদেরকে হয় কিছু টাকা নাহয় সামাণ্য চাল-ডাল, আলু, পেয়াজ ইত্যাদি যখন যা ঘরে দেবার মত থাকতো তাই দিতেন । কখনওবা খাবার খাইয়ে দিতেন অথবা যাবার সময় কিছু খাদ্য সামগ্রী সংগে করে ঘরে নিয়ে খাওয়ার জন্যে দিয়ে দিতেন । তারাও মায়ের জন্য যে যখন যা পারতেন কোন ফল-ফলাদি বা উপাদেয় খাবার দুচারটে বা একটি হলেও আম-জাম, লিচু, কলা, বেল, লেবু, ডিম, গাছপাকা সুপারী ও নাড়ু-মোয়া, পায়েস কিবা রান্নাকরা তরকারি ইত্যাদি যার কাছে যা আছে তাই কিছুনা কিছু নিয়ে আসতেন ।  


কষ্টে থাকা কোন মহিলা নিজে যেচে এসে কিবা তার ছেলে বা মেয়েকে মায়ের বাসায় বাবার অমতে এবং মায়ের অনিচ্ছা ও আপত্তি সত্ব্যেও বিনা পারিশ্রমিকে ঘর-সংসারের কাজে লাগিয়ে দিতো । বাসার যাবতীয় কাজকর্ম করে দিয়ে রাতে তারা নিজের ঘরে চলে যেতো । মা অনেকটা বাধ্য হয়েই মানবিক কারণে তাদেরকে দু/তিন বেলা খাইয়ে দিতেন । মাকে তারা মা ও বাবাকে আব্বা বলে ডাকতো । একটা চাকরীর সুযোগ না হওয়া পর্যন্ত, এভাবে কারো কারো দুচার ছয়মাস বা বছরও গত হয়ে যেতো । অবশ্য একটা উদ্দেশ্য নিয়েই এবং তারা সব জেনেবুঝেই কৌশলে এভাবে মায়ের বাসায় ঢুকে শেষে মায়াডোরে জড়িয়ে পড়তো ।


খাদ্য বিভাগ এর দায়িত্বশীল পদে চাকুরী করার সুবাদে বাবার পরিচিতি, সততার সুনাম ও সুখ্যাতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল । ফলে বাবার ঐ পরের উপকারের হাতটা ছিল অনেক লম্বা বা প্রসারিত এবং বাবার মুখের একটা কথারও সবার কাছে ছিল অনেক মূল্য যা অনেকেই ফেলতে পারতেন না । অবশেষে আর না পেরে মায়ের অনুরোধেই বাবায় অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের জন্য যেমন-তেমন একটা চাকরীর ব্যাবস্থা করে দিয়ে তবে নিস্তার পেতেন । মাসে ৬০ টাকা বেতনের তাও আবার মাত্র ছয় মাসের জন্য এমন একখানা পাখা টানার চাকরীরও তখন ছিল অনেক দাম । বাবার জীবনে বাবায় এমন অকেনকেই নানা ধরণের ছোট-খাট একটা চাকরীর ব্যাবস্থা করে দিয়ে জীবিকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন । যা আমার জীবনে এমন একটিও করার সৌভাগ্য হয়নি ।


মায়ের কাছে কারো ধর্ম নয় বরং একজন মানুষ হিসাবে তার কথা, চালচলন, কাজ, আচরণ এবং মন, মেজাজ, মানসিকতা ও মানবতারই অধিক মূল্যায়ন হতো । সম্ভবতঃ তাই বুঝি তার কাছে বিভিন্ন বয়সের অনেক হিন্দু নারীরা এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন । এভাবেই তিনি এলাকার রমণীদের কাছে তাদের সুখ-দুঃখের সাথী ও পরম শুভাকাংখী আপনজন হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন । নিজ গুণে কারো কাছে তিনি পরম শ্রদ্ধাভাজন ধর্ম মা, কারো মাসী ও কারোবা যেন বিশেষ আস্থা ও নির্ভরতার গুরুজন ঠিক এমনই একজন দিদির আসন লাভ করেছিলেন । দয়াময় আল্লাহপাক দয়া করে তাকে জান্নাত দান করুন ।  


নয় সন্তানের একজন আদর্শ পিতা সরকারী খাদ্য বিভাগ (সিভিল সাপ্লাই) এর একই অফিসের দায়িত্বশীল ঐ একই পদে একটানা দীর্ঘ ২৭ বছর চাকুরী রত ছিলেন । অতঃপর কোন সঞ্চয় কিবা সম্বলহীন ভাবে ১৯৬৮ ইং সনে পেনশন পেয়ে একখানা ঘাসি নৌকা ভাড়া করে মালপত্র পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা প্রচলিত যানবাহনে সপরিবারে গ্রামের বাড়ী চলে যান । তখন তাদের ঘরের আসবাবপত্র বলতে দুখানা চৌকি, একটি আলনা, একটি মিটসেফ, একটি পড়ার টেবিল ও দুখানা লোহাড় চেয়ার ছাড়া আর কিছুই ছিলনা । ছিল দুটি লেপ, একটি তোষক, কিছু কাথা-বালিশ, বিছানা, চাদর-মশারী, ২/৩ বস্তা হাড়ি-ডেকচি ও বাসনপত্র, কয়েকটি ছোট-বড় সুটকেস ও ট্রাংক । ঘরে ও বাহিরে আজীবন অতিশয় সাদামাটা ও অতি সাধারণ সরল জীবন যাপনের একটা বিশেষ সরলতার উজ্জল ছাপ বিদ্যমান ছিল তার সারা দেহমন ও অবয়ব জুড়ে ।  


গ্রামের বাড়ীতে ছিল তাদের কাঁচা ভিটের একটি মাত্র চৌচালা টিনের ঘর যার পিছনের অর্থাৎ পশ্চিম দিকের বেড়াটি ছিল পাটখড়ির তৈরী যা গাবের রসের সংগে ধানের কুড়া মিশানো ঘন আঠালো মন্ড লেপন করে ফাঁকহীন, শক্ত ও মজবুত করে গড়া হতো । ঘরের চার দিকের ভেলকিগুলি ও ভিতরের পার্টিশনটি ছিল বাঁশ ও বেতের তৈরী । আর ঘরের কাড় বা আপার তথা সিলিংটি ছিল সুপারীর মাঁচার । তখন বাড়ীতে বিদ্যুত ছিলনা । ঘরের বাহিরে ছোট্ট দোচালা ছনের ঘরে মাটির চুলায় রান্না হতো নাড়া, খড়-কূটা, পাটখড়ি ও কুড়িয়ে আনা গাছের শুকনো ঝড়া পাতা দিয়ে । ঘরের মালিক শহরে থাকায় তথা এ ঘরে কেউ বাস না করায় কেউ কেউ সেখানে গরু রাখতো । ঠিক ঘরের মতই যেন অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল বাবার জায়গা জমিগুলো ।    


বৃটিশ আমলের এন্ট্রান্স ও কলিকাতা বিশববিদ্যালয়ের অধীনে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ পাশ করার পর বাবা ওকালতি পড়ে সফলকাম না হয়ে শেষে মুক্তারি পাশ করেন ও পেশা শুরু করেন । কিন্তু এ পেশায় তিনি তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না । তারপর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এর অধীনে চাকরী হয়ে গেলে তিনি ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) জেলায় কাজে যোগদান করেন । পরবর্তীতে ঢাকা জেলার মুন্সিগন্জ মহকুমায় বদলী করা হলে সপরিবারে সেখানে চলে যান । ১৯৫৩ সালে মুন্সিগন্জ মহকুমার বিক্রমপুর পরগণার কোটগাও এলাকার জনাব বসির খাঁ সাহেবের ভাড়াটে বাসার টিনের ঘরেই এ গল্পের নায়কের জন্ম হয় । বাবা-মায় তাদের স্নেহের নবজাত কৃঞ্চ-লোহিত গাত্র বর্ণের পুত্রের নাম রাখলেন নব-শশি বা হেলাল । দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় এক সময়কার বড়বাবু ও সুফী সাহেব ৬৫ বৎসর বয়সে রিটায়ার করে এবার তার গ্রামের বাড়ীতে এসে নতুন করে কৃষক হলেন এবং গৃহস্থি-বাসের নতুন জীবন শুরু করলেন । তাই এ গল্পের নায়ক তাকে কৃষকের ছেলে হিসাবে পরিচয় দিতে কুন্ঠা নয় বরং উৎসাহ ও গর্ব বোধ করেন ।


পর্ব – ০৩


ঐ সময়ে অত্র গল্পের মুখ্য চরিত্র বা নায়ক ছিল মাত্র নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ন হওয়া ইংরাজিতে পাকা ও অংকে কাঁচা এমন একজন ভাল ছাত্র । ভাইদের সংগে সে মাঠে গিয়ে জমিনে কাজ করতো । প্রোজেক্টের পানি ধরা, ইরি ধানের চারা রোপন করা, সময়ে সময়ে ক্ষেতে পানি দেওয়া, ক্ষেত নিড়ানো, ধান কাটা, আটি বাঁধা, ধানের বোঝা বহু দূর থেকে মাথায় করে বাড়ী এনে উঠানে পারা দেওয়া, উঠানের মধ্যখানের মইয়াতে একরশিতে ৪/৫টি গরু জুড়ে দিয়ে ধান মাড়ানো, কূলায় ধান উড়ানো, ওজন করা, ভিজানো, সিদ্ধ করা, শুকানো ও ঢেকিতে চাল তৈরী করা ইত্যাদি ঘর সংসারের হেন কোন কাজ নেই যেখানে কম-বেশী তার হাত পড়েনি । নাড়ার বোঝা বাড়ী আনা, ডুবিয়ে পাট কাটা, পাট জাক দেওয়া, পাট লওয়া, পাট ধোওয়া ও রাস্তায় বাঁশের আড়া টানিয়ে পাট শুকানো সব কাজই কিছুনা কিছু আমাকে করতে হয়েছে বা স্বতঃস্ফর্তভাবেই আমি তা করেছি ।


অবশ্য আমার ভাইয়েরা আমাকে তেমন কোন কাজ করতে দিতোনা বা কিছুক্ষণ বাদেই রোদের মধ্যে কাজ, বেশী পরিশ্রম বা কাদা-পানির কাজগুলি থেকে উঠিয়ে আমাকে বাড়ী ফিরিয়ে দিত । নিজেদের পুকুরে পাইজাল দিয়ে আইড়, বোয়াল, গজার ও কাতল মাছ ধরা, রাতে চারা গাছের কলসী থেকে খেজুর রস চুরি করে খাওয়া, তাল টোকানো ও আম কুড়ানো এবং বর্ষায় নিজে নৌকা বেয়ে বিলে ঘুরে বেড়ানো ও শাপলা তোলা ছিল তার প্রিয় সখ ও  আনন্দময় নেশা । এসব কিছুর ফাঁকে ফাঁকেই চলছিল মাঝেমধ্যে দুএকটি কবিতা লেখা ও স্কুলের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া ।  


সারা দেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তখন ছিল রাজনৈতিক ভাবে খুবই উত্তপ্ত । রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ২১শে ফেব্রুয়ারীকে জাতীয় শোক দিবস বা শহীদ দিবস ঘোষনা সহ ১১ দফার ছাত্র আন্দোলনের সংগে যুক্ত হয়ে ৬ দফা আন্দোলন পরবর্তীতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের জোড়ালো দাবীতে রুপান্তরিত হয়ে সম্মিলিত জোট এর ঐ জাতীয় মহাআন্দোলন উঠেছিল তুংগে । ধীরে ধীরে ঐ গণ আন্দোলন দেশব্যাপী গণ জাগরণ সৃষ্টি করে সারা দেশের বড় বড় শহরগুলিতে তা ছড়িয়ে পড়ে গণ বিস্ফোড়নের রুপ নেয় । সারা দেশ তখন উত্তাল । ৭১ এর শুরুর দিকে ঐ গণ বিস্ফোড়নই স্বাধীনতার গণ অভ্যুথ্যানে পরিনত হয় ।


এপ্রিলের এক রাতে এশার নামাজের পরপরই গ্রামে পাক মিলিটারি ঢুকে পড়লে ঐ রাতেই ছেলেটি মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে তার ঘরের সকল কেলেন্ডার, সংগ্রামী পোষ্টার, ব্যানার, ১১ দফা ও ৬ দফার পুস্তিকা সমূহ ইত্যাদি সবকিছু একত্র করে সামলিয়ে একটি বড় খেড়ের পাড়ার নীচে লুকিয়ে রেখে প্রায় কোমড় পানিতে দৌড়ে নদীর পারে গিয়ে সাঁতরিয়ে বাড়ী থেকে পালিয়ে গিয়ে পাশের গ্রামে পৌছায় । এ সময় ঘন অন্ধকারে চারিদিকে শোনা যাচ্ছিল মেশিনগানের গুলির প্রচন্ড আওয়াজ । তাই ভয়ে গ্রাম জুড়ে সকল ঘরের বাতিগুলি তা কুপি বা হারিকেন যাই হোক নিমেষে নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল । এমনি এক অন্ধকার ঘরে রাতভর ভিজা কাপড়ে মেঝেতে উপুর হয়ে পড়ে থেকে শেষরাতের দিকে ভিন্ন গন্তব্যে রওনা হই ।


গল্পের নায়ক ছিল তার পরিবারের নয় সন্তানের চতুর্থ আর চার পুত্রের মধ্যে দ্বীতিয় । সে ১৯৬৯ইং সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করে কলেজে ভর্তী হয়েছিল এবং পরে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে । প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে প্রধানতঃ বিত্তশালী হিন্দু পরিবারের কিছুটা বিজন পাকা বাড়ীগুলিতে তরুণ ও যুবকদের সমবেত সমাবেসে মুক্তি সংগ্রামের আয়োজন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা ও সম্মিলিত পরিকল্পনা চলছিল । তারপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই আবার তার জীবন গড়ার সংগ্রাম শুরু হয় । পরিবারের প্রয়োজনে জীবিকার তাগিদ ও তাড়নায় সে আবার বড় শহরে ছুটে যায় ।          


তার মুখে শোনা তার সে জীবনের করুণ গল্পটি আজ আমি বলছি ।


এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় বেড়াতে এসে প্রথম পরিচয় । চোখে চোখ পড়ে তা আঠার মত জোড়া লেগে গিয়ে যেন শেষে চার চোখের দুটি মন ধীর পায় বুঝি দুজনেরই অজানায় ঘনিষ্ঠ হতে থাকে ও এগিয়ে যায় । ভাল লাগা থেকে জন্ম হয় এক পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন ভালবাসার । কেউ দেখেও না দেখা ও কেউবা বুঝেও না বুঝা, এমনি করেই যেন দিন গড়িয়ে যায় । কারো মৌন সমর্থন আবার কারোবা চক্ষুশূল, তাই তারা দুজনে দ্বিধা-দন্দ ও দোটানায় পড়ে যায় । তবুও এক অসহায় বিব্রত ভালবাসা অভিবাবকদের অনুমোদন পেতে চায় ও ঠাই খুঁজে বেড়ায় ।  


সদ্য এইচএসসি পাশ করে পুনঃরায় সে জীবিকার তাড়নায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে ছুটে বেড়ায় । সৌভাগ্যক্রমে ১৯৭৩ সালে তার একটা ভাল চাকরী হয়ে যায় । সম্ভবতঃ তখন ৭৪/৭৫ সাল । ভাল লাগা ঐ মেয়েটিকে দেখতেই যেন নানা ছল-ছুতায় তার ঘন ঘন ঢাকায় যাওয়া । বিষয়টি হয়তো অনেকেরই চোখে পড়েছিল এবং কারো কারো কাছে তা ভাল না লাগারও যুক্তি আছে বৈকি । হয়তোবা এক সময়ে বিষয়টি নিয়ে তাদের পরিবারে নিজেদের মধ্যে আলোচনা বা সমালোচনাও হয়েছে । পরবর্তীতে এক পর্য্যায়ে হয়তোবা এ নিয়ে মা-বাবার কান পর্যন্ত নালিশও পৌছেছে ।


ঢাকায় নিজ বাড়ীতে বসবাসকারী আমার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের নিকট আত্বীয়ের মেয়েকে আমার ভাল লাগা ও ভালবাসার কথা জানিয়ে তাকে বিবাহ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেও তাতে মা-বাবার তেমন কোন সাড়া পাওয়া যায়নি ও শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে সে বিয়ে করায়নি । দেশে তখন বাহারী রঙের জাপানী শিফন ও জর্জেট শাড়ীর আগমন ও ছড়াছড়ি । হঠাৎ কোন খেয়ালে সব রঙ মিলিয়ে আমি বেশ কয়েকটা শাড়ী কিনে ফেললাম । মনে আশা ছিল কি আর হলো কি । বেশ কিছুদিন পরে জানলাম ঐ শাড়ীগুলো সব বোনেরা মিলে পরমানন্দে ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছে । আমার বিষয়টি নিয়ে ঘরে চলছিল আলোচনা এবং তাতে নানা রকম গড়িমসি ও তালবাহানা ।


শহরে ও গ্রামে দুই বাড়ীতেই চলছিল নানা কানাঘুষা ও তোলপাড় । ধীরে ধীরে যেন বাড়ছিল দোষাদোষী ও নানা কথার কাদা ছোড়াছুড়ি । দুটি তরুণ প্রাণের জোয়ারে হঠাৎ ভাটা ও ছন্দ পতন । কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে ফেলার মত অভিমান, গাম্ভীর্য ও নিরবতা যেন এখনই শুরু হবে তুমুল ঝড় । দুজনের মাঝখানে গড়ে উঠছিল একখানা অদৃশ্য প্রাচীর ও দূরত্ব । এখন থেকে যেন কেউ আর কারো আপন নয়, অচেনা পর ।  


পর্ব – ০৪


প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা কথাবার্তায় বুঝতে পরালাম মা-বাবা এখন আমাকে বিয়েই করাবে না । তাই নানান কথায় নানাভাবে তারা আমাকে নিরুৎসাহিত ও হতাশ করছিল । তারপর জানা হলো এ বিয়েতে আমার এত ভালবাসার মানুষটির অন্যতম একজন কট্টর অভিভাবক বিত্ত ও প্রভাবশালী তার বড়বোন রাজি নয় । ওদিকে তার বড়বোন আর এদিকে আমার মা-বাবা, দুই পরিবারের এই তিনজন মানুষের নারাজি । আমার পরিবারের অনটন, যেথা উপার্জন করছি মাত্র আমি একজন আর অল্প বেতনের চাকরী ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় মাথায় অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছিলো ।  


এ নিয়ে নানা রটনা, ঘটনা ও কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল । আর চারদিকে যেন ঐ একই আলোচনা ও সমালোচনার শন শন এলোমেলো বায়ু বইছিল । একবার আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আপনজন আমাকে ডেকে প্রশান্ত বদনে ও তিক্ত মার্জিত বচনে আমাকে শাসালো ও বুঝালো । যেসব কথাগুলি হলো তা ছিল যেন তীক্ষ্ণ মিছরির ছুরি এবং তার সারমর্ম এইরুপ যে, আমি দেখতে কালো ও মাত্র এইচএসসি পাশ । আর তাদের মেয়ে বেশ সুন্দরী ও অনার্স পড়ছে এবং তারা বড়লোক । এবার প্রশ্ন করলো আমি কি তার উপযুক্ত ? বললো যদি তার উত্তর হয় না, তবে কেন আমি শুধু শুধু তার পিছনে ঘুর ঘুর করছি । শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি কাঠের মূর্তির মত নিরব গাম্ভীর্যে বসে থেকে সব শুনে শেষে উঠে চলে আসি । কি বলতে কি বলে ফেলি তাতে আবার কিসে থেকে কি হয়ে যায় এসব ভাবনায় আর কিছুই বলা হয়নি । যা হোক, বিষয়টি আমাকে দারুণভাবে পীড়া দেয় ও নিজের প্রতি নিজের ধিক্কার জন্ম হয় । নিজেকে সে সময় আমার অনেক ছোট এবং অসহায়ও মনে হচ্ছিল । কেমন যেন একটা বিরহ ও দূর্ভাবনা আমাকে পেয়ে বসলো যা কিছুতেই মেনে নিতে কিবা তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেও পারছিলাম না ।      


তবু মন আমাকে মন্ত্রনা দিচ্ছিল । বলছিল রিজিকের মালিক আল্লাহ আর যে যার কিসমতেই খায়, ভয় কিসের আল্লাহ পালবেন ও খাওয়াবেন । তুই এগিয়ে যা ও বিয়ে করে ফেল । তাছাড়া মিয়া-বিবি যখন রাজি তখন আর অসুবিধা কি । বিষয়টি নিয়ে অনেক ভেবে দেখলাম, ঝুকিপূর্ণ দুঃসাহসী পদক্ষেপে আমার প্রিয় মানুষটিকে ডেকে এনে বলে বুঝিয়ে তার সম্মতি পেলে গোপনে দুজনে বিয়ে করে তাকে নিয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে যাবো । কিন্তু মন থেকে এ ভাবনার প্রেরণা ও উৎসাহ পেলেও মনের ভিতরে যেন কোন সাহস বা আগ্রহই পাচ্ছিলাম না । দুই পক্ষেরই আংশিক নারাজি, অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, পারিবারিক ও সামাজিক চাপ, আত্বীয়-স্বজনের নিন্দা, তিরস্কার ও ভর্ৎসনা ইত্যাদি বিষয়গুলি আমাকে কাতর করে ফেলেছিল । আমার এত ভালবাসার মানুষেটিকে যদি আমি ভালোয় রাখতে না পারি, তবে শেষে আমাদের দুজনের এ কষ্টের ভাগ কে নেবে বা কাকে দেবো । তারচেয়ে বরং আমার প্রিয় মানুষটির অন্যত্র একটা ভাল বিয়ে হোক ও সে ভালো থাকুক । যখন আমি আর পারছিলাম না, কাউকেই যেন আর আমার মোখ দেখাতে ইচ্ছে করছিল না ।  


আমি যেন হেরেই গেলাম । অক্ষমতা ও ব্যর্থতার এক দারুণ বিষ-প্রদাহ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল । মনের মধ্যে বইছিল হতাশা ও কষ্টের প্রচন্ড ঝড়-তুফান । বুকের মধ্যে এক বিশাল পাথর বেঁধে নিয়ে আমি নিরবে সকল আত্বীয়-স্বজন বিশেষ করে ঢাকার সব চেনা মোখগুলির কাছ থেকে মুখ লুকালাম । চুপচাপ গা ঢাকা দিয়ে আমি চলে গেলাম চট্টগ্রাম । তা ছিল যেন আমার স্বেচ্ছা নির্বাসন । ঘন ঘন আর আমার ঢাকায় আসা হয়না । অফিসের কাজে কখনও ঢাকা এলেও কাজ সেরে, যদিও থাকতে হয় কোথাও না কোথাও থেকে, গোপনে সরাসরি চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়া । কারো সংগেই এখন আর আমার কোন যোগাযোগ বা দেখা-সাক্ষাত নেই ।


আমি যেন এক ব্যর্থ সৈনিক, এক পরাজিত অভিমানি বিরহী । পাহাড়ের গুহায় পরাজিত, পলাতক ও আশ্রিত সেনাপতি রবার্ট ব্রুসের মত নিজেকে ভাবতে লাগলাম । কিন্তু না, রবার্ট ব্রুসের সেই সাহস ও মনোবল আমি  কিছুতেই যেন পাচ্ছিলাম না । কাকে কি বলবো, যেন আমার দুঃক্ষটা বলার জায়গা নেই । তাছাড়া নিজের অক্ষমতা ও ব্যর্থতার কথা অন্যকে বলেইবা কি লাভ । একবার ভেবেছিলাম তার বোনকে গিয়ে ধরে কাকতি মিনতি করি । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা’ও আমি আর পারিনি । নিজেকে খুউব ছোট আর অসহায় মনে হচ্ছিলো । অবশেষে অন্তরে আমার এ বোধোদয় হলো, মূল্যবান রতন কি কভু বিনামূল্যে কিবা আবেগের ছলে চুখের জলে বুক ভাসিয়ে পাওয়া যায় । তাই তার বড়লোক বড়বোনের কাছে আর যাওয়া হলোনা ।    


অন্তরালে গা ঢাকা দিয়ে দিন যাচ্ছিল । চারদিক থেকে তার ভাল ভাল বিয়ের প্রস্তাব আসছিল । হঠাৎ একদিন তার বিয়েও হয়ে গেলো । যে রাতে তার বিয়ে দূর্ভাগ্যজনকভাবে সে রাতে আমি ঢাকায় । অফিসের কাজ শেষ, রাত পোহালে পরদিন নিজের কিছু কেনাকাটা করে তবে আমার চট্টগ্রাম ফেরার কথা ছিল, কিন্তু তা আর পারলাম না । তখুনি কমলাপুর চলে এসে রাতের ট্রেনেই আমি চাটগা চলে এলাম । তারপর এভাবেই সকল আত্বীয়-স্বজনের সব সুখ-দুঃখের সকল ঘটনা প্রবাহ থেকে নিজেকে বিছিন্ন করে ও দূরে সড়িয়ে রেখে দিন কাটছিল আমার । তাই তার কাছে মনে মনে আমি একজন ক্ষমাপ্রার্থী ও নিজ বিবেকের কাছে মস্তবড় অপরাধী হয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে নিরবে এমনি কেটে গেছে আমার জীবনের অনেক কষ্টের চল্লিশটি বছর ।


পর্ব – ০৫


তার বিয়ের অন্ততঃ ১০/১২ বছর পরে আমারও বিয়ে হয়েছিল । অবশেষে একদা দুজনেরই বিয়ে হয়েছে, হয়েছে জীবনসংগী ও ছেলে-মেয়ে । আমার বন্ধুটি পেয়েছিল প্রাচুর্যের সংসার । আর আমার ছিল অনেকটা যেন ঠিক সেই আগের মতই টানাপোড়নের জীবন । পরে কার ভাগ্যে কতটুকু সুখ জুটেছিল তা জানিনা । অবশ্য তাকে হারাবার পরে আমি আর কখনও সুখ নিয়ে ভাবিনি তাই হয়তো এ বিষয়টি টেরই পাইনি । স্ত্রী, সন্তান ও সংসার সবই হয়েছে তবু আপন ভুবনের ঐ গহীন শূন্যতা যেন আজও আমাকে ছেড়ে যায়নি, কিছুতেই যেতে চাইছেনা ।


মনের বিশাল বিজন ভুবনে আমি যেন বড় একা হয়ে গেলাম । যেখানে ভালবাসার জন্ম হয় ঐ বলয়েই বাসা বাঁধলো  নির্জনতা, একাকিত্ব ও বিষন্নতা । যার এক কালো ছায়া সারাক্ষণই যেন আমাকে ঘিরে ধরে থাকলো । ডায়রীর পাতায় ও যেখানে সেখানে কবিতা ও গান লেখা একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো । মনের মধ্যে কষ্টের এক বিশাল পাথর বুকে বেঁধে আত্বীয়-স্বজন বিশেষ করে ঢাকার সব চেনা মোখগুলির কাছ থেকে মনের জগতে আমি যেন অনেক দূরে সড়ে গেলাম । নিজে সুখ পাবার জন্য নয়, বরং অতিশয় প্রিয় একজনের চোখ ও মনের শূল-বেদনা কিবা তার সংসার জীবনের কাটা না হবার জন্যই ছিল আমার ঐ স্বেচ্ছা নির্বাসন । মনের কারাগারের ঐ ৪০ বছরে তাকে একনজর দেখা ও দুটি কথা বলার জন্য ঘরে বাহিরে সকলের অজান্তে এ মনের ভিতরে সহস্রবার ‍উঠেছে ঝড় । সে ছিল এক অস্থির আকুতি, কই মাছের মত নিজের ভিতরে নিজে নিরবে গোপনে ছটফট করে কেটেছে আমার দিন-মাস-বছর । কিবা আপন কিবা পর এত বড় দুনিয়ায় কে কার মনের গহীনের গোপন সে খবরগুলো বলো রাখে কিবা পায় ।


ভেবেছি হয়তো এতদিনে মাটির অনেক তলে পৌছে গেছে সবারই সংসারের শিকড় ও কারো সুখটাই নিশ্চয় এখন আর নহে টলমল কিবা নড়বড় এবং পরাজিত ঐ ভালবাসার বুকের উপরও চাপা পড়েছে ধ্বসে যাওয়া এক পাথর পাহাড় । তাই শুধু তাকে একটু দেখা ও দুচারটে কথা বলার দূর্বার ও দূর্নিবার ঐ গোপন বাসনায় মন পাল্টে এবার জনসমক্ষে আসার মনঃস্থির করলাম । একদিন আমাদের এক স্বজনের পারিবারিক শোক দিবসে যোগ দিতে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে তার সংগে আমার একনজর দেখা আর সামাণ্য দুচার কথার শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় হয়েছিল । তারপর আরেকদিন অন্য এক সামাজিক অনুষ্ঠানে তার সংগে দেখা হলে লক্ষ্য করলাম আমার চোখ থেকে সে তার মোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে । নিজের মোখ লুকিয়ে সে যেন কারো না কারো পিছনে গিয়ে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে ও এভাবেই সে আমাকে তার সংগে কথা বলার সুযোগ দেয়া থেকে বঞ্চিত করতে থাকে । আমার বিদ্যান বিন্দু কেন এ কথাটি শিখেনি, জানেনা বা বুঝলনা যে চোখের আড়াল হলেই তা মনের আড়াল হয়ে যায়না ।  


অতঃপর যতবারই যেখানে দেখা হয়েছে আমি তার ঐ একই আচরণ লক্ষ্য করেছি যা বুঝতে পেরে নতুনভাবে আবার আমার সেই পুরাতন ক্ষতে আঘাত পেলাম । হয়তো এটাই আমার পাওনা ছিল, যে ভুলের মাসুল আজ আমি অনুভব করছি, বয়ে বেড়াচ্ছি  ও দিয়ে যাচ্ছি । আমার ধারণা, তার অতি আপন ও শুভাকাংখী কোন এক অভিভাবক একদিন যে বা যারা এ বিয়ের বাঁধা হয়েছিল হয়তো হবে তাদেরই কেউ একজন আজও আবার তাকে আমার সংগে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছে । জানিনা এতে আমার ইন্দুর বা তার ঐ অভিভাবকের কি লাভ হয়েছে আর স্বাভাবিকভাবে কথা বললেইবা কি এমন ক্ষতি ছিল বা হতো তাদের ।


বোনকে বড় ঘরে বিয়ে দিয়ে কিবা অন্য কোন ভাবে যদি অতীতে তাদের কোন ক্ষতি হয়েও থাকে তবে তাতে কার কি দোষ, বরং তা হয়তো ছিল তাদেরই কোন অহম কিবা ভুল জীবন দরশনেরই ফসল যা সাধারণতঃ অনেক বড়লোকেরই হয়ে থাকে । এবার তারা দুবোনে মিলে আবার নতুন কি লাভের আশায় সব জেনেবুঝে আমাকে কষ্ট দিতে শুরু করলো, কেজানে শেষে নাজানি কোন ক্ষতি আবার তাদের হয়ে যায় । বাধা দিলে বাধবে লড়াই, যদি কখনো ইন্দুর মন হঠাৎ এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠে তবে শেষে কে লবে তার দায় । কঠিন মনের পুরষ্কার দিতে গিয়ে যদি একটু কঠিন হয়ে উঠে খোদায় ।


শ্রদ্ধেয় পদ্মবু, জীবনে আমি কি পেয়েছি ও কি পাইনি বা কি হারিয়েছি সে হিসাব এখন আর আমি করিনা কারণ তা করেইবা আর লাভ কি । এখনতো আর চাওয়া পাওয়ারও কিছুই নেই । হারানো প্রিয়জন, ঐ কষ্ট ও সে দিনগুলির জন্য আমি কাউকে দায়ীও মনে করিনা এবং সেজন্য আমার কোন অভিযোগও নেই । বরং আমি অনুভব করছি ও স্বীকার করছি যে, ঐ পরিণতি কিবা পরাজয়ের সকল দায় ও ভুল বা অপরাধগুলি শুধুই ছিল আমার ও আমার নির্মম নিয়তির । সে পরাজয় যে বড়ই অসহায় এক অক্ষমতা, দীনতা ও ব্যর্থতার করুণ স্মৃতির । ঐ একটা অপরাধবোধ আজও সারাক্ষণ আমাকে তাড়া করে বেড়ায় ও নিভৃতে কুড়ে কুড়ে খায় । তাই আমার ঐ প্রাণপ্রিয় ভালবাসার মানুষটির কাছে আজও আমি আমার বিবেকের আদালতে অপরাধী হয়ে রয়েছি । হয়তো আমি সেদিন তার হাত ধরে টেনে নিয়ে তাকে বিয়ে করে পালিয়ে যেতে পারতাম আর সেটা ই বোধহয় আমার উচিৎ ছিল । জীবনের কোন ভুল ও অপরাধ বা তার ক্ষতি বা খেসারতগুলি পূরণের আজ আর কোন সুযোগ না থাকলেও লোকের ও খোদার কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার রাস্তাটাতো এখনও খোলা রয়েছে ।    


পদ্মবু, আপনার সংগে কখনও আমার ইন্দুর দেখা হলে দয়া করে তাকে বলবেন যে, তার পরম শ্রদ্ধা, ভক্তি ও  বিনয় ভরানো সে ভালবাসার কথা ভুলা যায়নি, তাই আজও আমি তার কাছে ঋনি ও ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে আছি । একবার ঐ কদমবুছি করা, একবেলা ভাত বেড়ে খাওয়ানো, মাঝেমাঝে কান পরিস্কার করা, কল চেপে অজু বানাতে দেওয়া ও নির্জন বিজন প্রকোষ্ঠে একদিন মশারি টানিয়ে দেবার সেই ঋন কি আর কোনদিনও শোধ হবার । যার ভালবাসার কাছে আমার দুষ্টুমি ভরা অস্থির মনের, দুরন্ত দামাল ও বেসামাল ঐ প্রথম যৌবনের ইসপিস করা হাত দুখানাও মেনেছিল যে কি চমৎকার বশ্যতা ও হার । স্বরণে পড়ে ঐ অবাক বিস্ময়, কোন পরশ বিহীন ঐ মন্ত্র ছোয়ার সে মুগ্ধতার কথা আজও আমাকে ভাবায় । পদ্মবু, কিছু ভালবাসা আছে যা কভু মুখে বলা হয়না তবে মনে মনে জানা হয় ও অনুভবের মুগ্ধতায় হৃদয় ভরে রয় । যা চুখে দেখা যায়না আর জগত বেঁচেও একজীবনে যার মূল্য পরিশোধ হবার নয় ।  


পর্ব – ০৬


পদ্মবু, আমার হয়ে আপনি তাকে আমার আকুল মিনতি জানিয়ে বলবেন, পারলে তিনি যেন দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দেন । বিয়ে হয়নি, তাকে পাইনি তাতে কি হয়েছে । ভালবাসাতো আর মরে যায়নি, তাছাড়া ভালবাসতেতো আর বিয়ের দরকার কিবা বন্ধুকে কাছে পেতে হয়না । স্মৃতির কল্পনায় ভালবাসার মানুষের ঐ আবছা মায়া মোখখানাকেও ফুল দিয়ে মনের ঘরে সাজিয়ে ভালবাসা যায় শত বছর ।


সত্যি বলছি পদ্মবু, তাই সে যে আজও আমার পরম ভালবাসার । দেখা হয়না আজ চল্লিশ বছর, দেখা হলেও এখন কথা হয়না তাই বলে কি সে পর, তবুও সুযোগ কই মনের মোটা ক্যানভাসে থাকা তার ঐ মোখের ছবিটি মুছে ফেলার । সেতো কোন কিছু দেয়া-নেয়া, লেন-দেন বা চাওয়া-পাওয়ার ভালবাসা নয় বরং দূর থেকে শুধু কল্যাণ ও মংগল কামনার ভালবাসা । আমি তার বন্ধু না হলেও দুষমন নয় । আগেও ছিলাম না, আজও নহে এবং জীবনে আর কোনদিন তেমন হতেও পারবো না নিশ্চয় । বরং আজও সে আমার হেন আপন অন্তরের অজানা ঘরে আজীবন বসবাস যার । তাকে বলবেন যে, তাকে আমার বড় দেখতে ও দুটি কথা বলতে ইচ্ছে করে ।


না, আমার পুরাতন সে কষ্টের কোন ভাগ নিতে হবেনা । আমি আমার ঐ বিষন্নতার ৪০টি বছর ফেরৎ, তার কোন কৈফিয়ত কিবা ক্ষতিপূরণ কারো কাছেই এমন কিছু চাইবো না । কোন অভিযোগ কিবা ভালবাসার কথাও নয়, মাঝেমাঝে যেন চোখ জুড়ায় ও মন হাল্কা হয় শুধু নিছক এমন ক্ষণিকের গল্প কিবা সামাণ্য কিছু কুশল ও শুভেচ্ছা বিনিময় এর দেখা হলেইতো হয় । তাহলে থাক, এটুকু প্রত্যাশাও যদি অনেক বেশী বলে মনেহয় তবে আর তা’ও চাইবোনা । হলে এমন সুমতি, হেন চল্লিশ লগনে যদি ৪০ বছরের কষ্টের সে ক্ষতটা মুছে যায়, তবে তাতে কার কি আর এমন বিশেষ ক্ষতি ।  


পদ্মবু, দুই পরিবারের মধ্যে আত্তার একটা বন্ধন ছিল, আজ যা সামাণ্যই টিকে রয়েছে আর কিছুদিন পরে হয়তো তা একেবারেই শূন্য হয়ে যাবে । ইন্দুর সংগে আমার একটা ভালবাসার নব বন্ধন যা কিছু মানুষের জন্য হতে গিয়েও হলোনা তাদের অধিকাংশই আজ তাদের কথা ও কাজের সামাণ্য স্মৃতি রেখে পরপারে চলে গেছেন । যারা বাকী আছেন তারা এবং আমরাওতো সবাই ঐ একই পথের যাত্রী । ওসব ভাবতে গিয়ে কেমন জানি সুন্দর এ পৃথিবীটার জন্য মায়াটা আরও বেড়ে যায় । যদিও আমাদের সমাজ জীবনে প্রতিনিয়ত এমনি কত সহস্র বন্ধন হয়তো অকারণেই ছিন্ন হচ্ছে আবার অজানা অচেনা অনেক মানুষের মধ্যে অসংখ্য নতুন বন্ধন সৃষ্টিও হচ্ছে ।


পদ্মবু, দুই পরিবারে ছিল ধন-সম্পদের মূল্যায়নেও কিছুটা ব্যবধান । গ্রামীণ গৃহস্থ জীবন ও শহুরে জীবন যাপনের মানের দিক থেকে এমনিতেই একটা ব্যাপক ব্যবধান দৃশ্যমান হয় । ইন্দুর সংগে আমার ছিল বিদ্যারও কিছুটা ব্যবধান । আর ছোট ছোট ঐ সকল ব্যবধানগুলি বুঝি সলা করেই মনের ব্যবধানটা অনেক বড় করে দিয়ে আমাকে পর করে দিতে চেয়েছিল, তা হয়েছে কি ? এমন বিদ্যা, বয়স ও ধনের কত ব্যবধান লয়েওতো কোটি কোটি বিবাহ হচ্ছে, কি হতো আমাদেরও হলে । যুগে যুগে দুনিয়ায়ই জনে জনে ধনের এই ব্যবধানেরও হয় উঠানামা ও পরিবর্তন আর মরণে তার সবকিছুরই অবসান ।  


যে বিদ্যা মানুষের মূর্খতা দূর করেনা, অন্ধত্ব ঘুচায়না ও মানুষকে জ্ঞানী করেনা তথা মানুষ বানায় না সে বিদ্যা কারো জীবনের সুখ-শান্তির গেরান্টি দেবে কিভাবে এবং কি করে তা কারো দুঃক্ষ-অশান্তির কারণইবা হবে কেন ও কিভাবে । তাই এ বিদ্যার বড়াই করেইবা আর লাভ কি । এগুলো মানুষের মিথ্যে সামাজিক মোহ-ক্লিষ্ট ভুল ছাড়াতো আর কিছুইনা । পুরুষের জন্য যেন তার কালো বা শ্যামবরণ রুপটাই আসল সৌন্দর্য্য আর নারীর জন্য দুধে-আলতা । এই রুপওতো নারী কিবা পুরুষের কারো জীবনের সুখ-শান্তিরই আজও কোন গেরান্টি দিতে পারে নাই । তাহলে কি আর অঢেল বিত্ত, রুপ ও বিদ্যার অধিকারী হওয়া সত্ব্যেও অগণিত সংসারগুলি দাম্পত্য কলহে ভেংগে চুরমার হয়ে যেতো । আর অজ্ঞরাতো এবার জেনে নেওয়া দরকার যে, সুখ যেমন নহে ধন, রুপ কিবা বিদ্যায় তেমনি আসলে পুরুষের আসল রুপ ও পৌরুষওতো অন্য কিছুতে নয় বরং শুধু তার সুস্থ্যতা ও সততায় ।


বেশী বড়লোকদের সুখতো পাওয়া যায় বড় বড় ঐ শপিং মল, জুয়েলারী, ফ্যাশন হাউস, বিউটি পারলার, নাইট ক্লাব এবং রাজকীয় জমকালো ও ঝলমলে পার্টি সেন্টারগুলিতে । আর আমার মত গরীবের সুখতো শুধু তার মনে । কিবা বড়জোর নদী তীর, সাতরঙ ফুলে সাজানো সবুজের উদ্যান আর জোছনা ভরা কিবা অন্ধকার রাতের তারকা ভরা আকাশে । অর্থাৎ যখন যেটুকু ও যেমন নগদে পাওয়া যায় বা বাস্তবে আছে নিজের কাছে অর্থাৎ হাতে, পকেটে, ঘরে ও পাতে গরীবের সুখ হলো তাই । ইন্দুরতো যেমন ছিল রুপ তেমনি বিদ্যা ও তার স্বামীরও ছিল প্রচুর বিত্ত-ধন তাই হয়তো নিশ্চয় সুখে গড়াগড়ি করেই তার কেটেছে জীবন ।


আর আমার না ছিল বিদ্যা, না ছিল রুপ ও না কোন বিত্ত-ধন তদুপরি মনে ছিল আমার মনের মানুষটিকে না পাওয়ার হু হু করা হাহাকার । তাই আজ আমার অন্ধের ষষ্টি কিবা সপ্তমী তা যাই হোক, সাত সন্তানের একটি আইন পড়ছে, তিনটি মাষ্টারস, একটি ইন্জিনিয়ার ও দুটি ডাক্তার, তবু তা নহে মোর অহংকার । বরং সে পরম পাওয়ার কথা বলে বলে ঐ আনন্দের মাঝে পড়ে ঢলে ও অন্য নানান ছলে সারাক্ষণ আমার ঐ একটা অপ্রাপ্তি বা হারাবার কষ্টটাকে নিরন্তর ভুলে থাকারই আপ্রাণ চেষ্টা মাত্র ।


সবিনয় দাওয়াত রইলো, সময় পেলে ও মনে চাইলে আমার অনলাইন (bangla-kobita.com/abuhaaawk) কাব্য জগতে এসে ঘুরে যাবেন । সেখানে পাবেন আপনার চমৎকার ভাল লাগা ও ভাল না লাগার অগণিত বিচিত্র কাব্য সমাহার । জীবনের শত রঙ ও সহস্র রকম এর সৃজন, দুনিয়া ও আখেরাতের এমন কোন দিক নেই যেখানে চোখ ও কলম পড়েনি এই নরাধমের । আমার নগণ্য লেখায় প্রতিটি শব্দ চয়ন ও বাক্য বয়নের সূত্র ও মন্ত্র এসেছে সপ্তম আকাশের মহারাজার ঐ বাতিঘর থেকে । যা জীবনের উপলব্ধি, অনুধাবন, মূল্যায়ন ও দরশন এর পুণ্যে ভরপুর । হোক তা যেমনই নিন্দুকের চোখে ও ভাষায় সুদীর্ঘ বিরস অপ্রিয় মহাকাব্য, তাতে আমার কি আসে যায় । আমার প্রয়োজন আপনার মতন বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ পাঠকগণের গবেষণ যারা ছাইয়ের টাল দেখলেই তা উড়িয়ে করতে চাহে কিছুনা কিছু আহরণ তাদের মূল্যবান মন্তব্য, সমালোচনা, মতামত ও পরামর্শ লাভ করে ধন্য হবার প্রত্যাশা করছি ।          


ইতি – আবু হক মুসাফির