পর্ব - ০১


আমি সাম্পান চালাই ॥
ঝড়তুফানে ঐ মাওলারে ডাকি,
ঘূপটি মেরে ঝুপড়ী ঘরে শুয়েবসে থাকি,
দিন কাটাই দরিয়ার কূলে ছোট্ট একটা পাতার ঘর বানাই ॥
আমি এক সাম্পানওয়ালা,
এক পাকা বুড়ো মাঝির পালকপোলা,
খেলবো জলে বানিয়ে ভাসিয়ে কলার মোঁচার ভেলা,
বাবায় কিনে দিলো সাম্পান, এখন সকাল দুপুর সাঝ শুধু এই কাজ সাম্পানে তিনবেলা,
ছোট্ট তরী নাঁচন করি, আড়াআড়ি পারি ধরি, ঢেউয়ের তলে ডুবেভেসে হেসে হেসে করি মজার খেলা,
মাঝে মাঝে মরণটা এসেও নাকের ডগায়, আজরাইল ফিরে চলে যায় শেষে বেঁচে যাই ॥
পাহাড়ী ঐ নদীটার,
করি তার যাত্রী এপার ওপার,
দেয় পাঁচটাকা দশটাকা যা ইচ্ছা হয় যার,
কোনমতে চলে যায় ফুফু ও বাপবেটার সংসার,
উজানের ঘাটে যাত্রা শুরু আর যেখা ঘাট ঐ সওয়ারী নামার,
নিয়ে যায় টেনে বহুদূরে ভাটিতে শেষে বাকী পথটা হয় হাটিতে এমনই তার ঐ স্রোতধার ।
বন্যার বছরে,
মা আমার গেছে মরে,
ফুফুরও স্বামী সন্তান কেউ নাই ওরে,
তাই হয়েছে ঠাই তার এই গরীব ভাইয়ের ঘরে,
ফুফু মোদের এই তিনজনের রান্না করে, লউট্টা মাছ ছুড়ি শুটকি কিসমতে যখন যা মিলে খাই ॥
ঘরের সামনে পুঁইয়ের মাঁচা লাউয়ের ঝাঁকা,
কত বিশাল জায়গা আহা চারিদিকে পড়ে রয়েছে ফাঁকা,
বুনেছি পাটশাক, ডাটা, ঢেরশ, বেগুন, পুদিনা পাতা ও মরিচের গাছ দিয়াছি লাগাই ॥
ঐ পারে ছিল মোর দাদার বাড়ী,
কোন কারণে সেই কবে দয়াল বিধি নিয়াছে তা কাড়ি,
দাদা নাকি আমার,
ছিল অনেক বড় জোত জমিদার,
শুনেছি লোকের মোখে আর অল্প অল্প মনে পড়ে তার, বিশেষ কিছুই মনে নাই ॥
সেই ছোট্টবেলায় ভয়াল এক জলোচ্ছাসে,
হঠাৎ একদিন ব্যস্ত ছিলাম খেলায় আমি মহা উল্লাসে,
জানিনা কেমনে শেষে হায় ভেসেভেসে এইপারে মোর জীবন আসে,
আমার কপাল বদলে দাসে, অনেক পাওয়া ও অনেক বিনাশে, আর কত রাজার কপাল পুড়ে হয়েছিল ছাই ॥


পর্ব - ০২


পালক বাবার কাছে যা শুনেছি,
জানিনা কেমনে তবে, অন্যরা কোথায় সবে, এই আমি বেঁচে আছি,  
ঢেউয়ের তোড়ে ডুবেভেসে, পড়েছিলাম শেষে নাকি এসে, বালুচরে এই পারে কূলের কাছাকাছি,
এমনই নিয়তির ফের,
যেথা নাই জুলুম বড়াই অহংকারের ঘের,
সব হারিয়ে শূন্য কেউ উচ্ছন্ন কেউ ধন্য কেউ নিরুদ্দেশ লভে ঢের,
কারো সব শেষ মহা লোকসান ধন আর ভোগ-বিলাসের অবসান,
জমেনি পাপ হয়ে পূরো একসের, এমন এক নতুন জীবনের এই পরিচয় ও ঠিকানা পাই ॥
ঐ পার আমার হলেও পর,
এই পারের দিগন্তহীন ভিজা বিজন বালুচর,
আছড়ে পড়া লক্ষ ঢেউ কলকল ছলছল অশান্ত জল এই মাটির উপর,
এক ভয়াল তিমির রাত,
আঘাতের পর আবার আঘাত,
দেখছি যেন এক দীপ্ত সোনালী প্রভাত,
ডাকিছে ইশারায় দেখিয়ে হাত, শুনিয়ে ভরসার বাণী নিতে চাহিছে কাছে টানি, আর কি চাই ॥  
হয়নি বৈরী পর,
বলেছে আবার বাধিতে নতুন ঘর,
জাগার মূল্য নাই, সাফ কবলা রেজিষ্ট্রি দলিলও আমি নাহি চাই,
এইতো জীবন ওরে ঝড়ের পরে আসে ঝড়, দিয়েছে তার বুকে মোরে বাঁচিবার আশ্রয় ও ঠাই ॥
করিতে জবর দখল,
নাইরে এমন কোন লাঠিয়াল দল,
যার বেশী ধন, বেশী বিদ্যা ও বেশী কৌশল ও বল,
নাই আচার ও বিচার, নেই কোন হার, সকলই তার এমনই এক যুলুমবাজ মোড়ল,
দেখা পাই এমন এক জমিদার সকলই যার আকাশ মাটি জল, আমি করছি তার বড়াই ॥  
আমার আপন স্বজন নাইরে কেউ,
শোশো শনশন ছলাতছল শব্দ আর ঢেউয়ের পরে ঢেউ,
কাম করে ভাই দিন এনে দিন খাই, কোন বড় আশা স্বপ্ন নাই, এমনই জীবন চালাই ॥
ছোট্ট আমার সাম্পান,
কাঠের পাটাতন আর বৈঠা তার দুইখান,
নষ্ট বিলাসী জীবনের করে অবসান পেয়েছি নতুনের সন্ধান,
আছে তার একখানা ছোট মাস্তুল আর ছোট্ট একটা সাদা পাল, দেই আমি বাতাসে উড়াই ॥


পর্ব - ০৩


দামাল হাওয়ার কাছে না মেনে হার,
ঐ ঢেউয়ের সনে সমানে সমানে হাল ধরিতে হয় আমার,
যখন আমি করি ভুল,
দিক হারাই আর হারাই তার চারকূল,
ছলছল চারিধার অথই জল আর জল, সুরুজ আর তারকা দেখে শুধু অনুমানে বৈঠা বাই ॥
পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিন,
আমি বড় অসহায় একা অসীমে হয়ে বিলিন,
কুয়াশা আর ধূয়ায় ঢাকা নাই লোকালয় বন্দর কিবা বাতি ও বসতির চিন,
তবু বৈঠা টেনে,
কোন দিকেযে চলছি হেনে,
না বুঝে ও না জেনে, পিছনে কিবা সামনে,
কি আছে বামে ও ডানে, পথ আর বাকী কত, দিকহারা নাবিকের মত,
যখন আমি অচেনা এক ভিনদেশী পথিক, দিকের দিশা ও সব পথঘাট ফেলেছি হারাই ॥
প্রায়ই যখন এমন হয়,
ঈশ্বরে বিশ্বাস ও সাহসই বল হয়,
শেষে হতাশারে করি আশায় জয়,
যদিও বারবার আমারে কাতর করে প্রাণ হারাবার ভয়,
দয়াল গুরুর দরিয়ার গানের সুর,
বিজনে বিচ্ছেদ আর বিষাদ মাখানো মধুর,
দেয় আবার বাঁচার আশা সব হতাশা ভয় নিমেষে করে দূর,
সংগে লই বেশী করে চিড়া আর পানি ও গুর, যখন আমি দিনে নীল ও রাতে কালোয় ভরপূর ঐ গভীর দরিয়ায় যাই ॥
মাঝি একা নাই কোন সওয়ারী,
অকূলে বিপাকে করিবে পার নিদানের কান্ডারী,
এ বিশ্বাস রয়েছে যার, কভু ঐ প্রভু যায়নারে তার গোলামেরে ছাড়ি,
কখনও আগে কখনও পিছে সংগ নাহি ছাড়ে,
সব পারে ও সে ইতো সব করে শেষে সব দোষ দেয় আমারে,
বেশী সুখদুঃখ কষ্টবেদন,
ধনজন আর যত অভাব ও অনটন,
সৃজন বাঁচন মরণ সকলই ওরে তার আপন হাতে রেখেছেন ধরে রাজন প্রভু মালিক সাঁই ॥  
সংগে থাকা সংগী একজন,
নিরাকারে কখনও বন্ধু পরম কখনও দূষমন,
বোবা রাজার সংগে থেকে গোলামের করা দোষই তার কারণ,
নিজেরে ঢেকে রাখা আর, দৃষ্টির আড়ালে থাকার ঐ সে সফল সদা আয়োজন,
ঠেলে ফেলে দিয়ে জলে, ফের চুবিয়ে ঢের শেষে টেনে ডাংগায় তুলে, এ খেলা খেলছে সারাক্ষণ,
আবু হকে কয় আসলে ভাই তা কেমনে হয়, সংগে থেকে সব দেখেও সে মেনে লয় তার গলদ আচরণ,
অপরাধ আর অপবাদের চারিদিকে দেয়া ঘের, অদেখা ঐ জালের ফাঁদে সবারে সদা রেখেছে সে জড়াই ॥


পর্ব - ০৪


মাবাবা স্ত্রীসন্তান ও বন্ধুভাই,
এতিম আমি করে কমদামী বিধি আমারে বানাইছে তাই,
আমার কিছু নাই, কূলে বইয়া দরদী হইয়া আমার লাইগা কান্দনেরও কেহ নাই,
নাই পুণ্য কোন ভাল কাম,
শূন্য যেজন কেমনে সে করিবে দান যে কাজে বাড়ে দাম,
তবু আমি হরদম, হতে চাইযে দামী যদিও সবকিছু মোর কমকম, করি রাজার খাস গোলাম হবার বড়াই ॥
সুখের মোহ জীবনের ভালোবাসা,
বিত্তধনে ভোগবিনোদনে সবারইতো বাঁচার আশা,
এ জগত সংসারটা তাই, চাইলে ইতো আর সবকিছু সবার ভাগ্যে জুটেনারে ভাই ॥
বার্জ কোষ্টার ও ট্রলার,
লইয়া যাই ও নিয়া আসি করি পারাপার,
পেলে দেশী-বিদেশী, তার কোন খালাসী পেসেঞ্জার,
রাতের অন্ধকারে বহিঃনোংগরে থাকা বড় জাহাজের সে কিযে বাহার,
মাঝেমাঝে খাইল্লা গায়,
কিছু বেশী টাকা পাবার আশায়,
বিদেশী বড় জাহাজের গায় সাম্পান লাগাই ॥
বেশী বিপদ হয়যে রাতে,
কোমড়ে বাধা গামছা পিরন গায়েতে,
তবু কোন ভরসায় কিসের নেশায় এ দেহটা মাতে,
আছে লাল হারিকেন সাথে,পকেটে ছোট্ট রেডিও টর্চলাইট রাখি হাতে,
সারাক্ষণ বিপদের হাতছানি, চিড়া মুড়ি গুর ও বিস্কুট পানি যা থাকে সাথে তাই খেয়ে কোনমতে প্রাণ বাঁচাই ॥
জাহাজ থেকে এটাওটা এমনিতেই দেয় মানুষ তারা কত উদার,
বিস্কুট পাউরুটি চিজ বাটার পেন্ট সাবান সার্ট আর জেম চিপস চকলেট পানি মদ ও বিয়ার,
ঐ জাহাজের ভিতরেই আছে সাজানো চমৎকার, ছোট্ট বাজার রান্নাঘর খাবারঘর হাসপাতাল ও বিনোদন বার,
তাইতো ভাই,
ওসব বেঁচে কিছু টাকা পাই,
মনটা বুঝি মোর কিছুতেই আর নাহি মানে,
তাই সে লোভের টানে, মৌমাছি যেমন ছুটে যায় মধুর ঘ্রাণে,
জীবনের ভয়টারে ফেলে হারাই, গভীর উজানে প্রায়ই মাঝেমাঝে আমি ছুটে চলে যাই ॥


পর্ব - ০৫


এমনি একদিন নাও ছাড়িলাম,
জানা নেই কতদূর গভীরে আমি ঢুকেছিলাম,
সবকিছু মোর ঐ রাজার হাতে, তার মালিকানা যার, সপে দিলাম,
সাঁঝের বেশ কিছুক্ষণ পর,
করলো আকাশ কালো শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি বাদল ও ঝড়,
পলকে সব হারালাম,
এই বুঝি সাম্পানওয়ালার জীবনের দাম,
বিশাল ঢেউয়েরে এক ঝটকায় কখন ডুবিল সাম্পান,
বুঝিলাম ওরে লোনা জলে, এইবার চিরতরে বিফলে গেলো মোর প্রাণ,
ডুবে আর সাঁতরে,
নাওটা খুঁজে বেড়াই অন্ধকারে হাতরে হাতরে,
ক্লান্ত ভীষণ আর পারছিলাম না যখন ঢেউয়ের সনে যুদ্ধ করে,
সাম্পানটা খুঁজে পাই বেশ অনেকক্ষণ পরে,
উল্টে গিয়ে সেটা ভেসে আছে দেখি জলের উপরে,
বুঝিলাম বাঁচার আর কোন আশা নাই তবুও কসরত করে,
উঠিলাম আর বসিলাম গিয়ে তার তলিতে চড়ে,
কখনও শুয়ে কখনও বসে রহিলাম শক্ত করে দুহাতে সেটি আঁকড়ে ধরে ।
জানিনা কি হয়েছিল তারপরে,
দেখি আমি শুয়ে আছি একখানা সুন্দর ঘরে,
বুঝিলাম এটা হাসপাতাল এক সুবিশাল জাহাজের ভিতরে,
পনর/বিশ দিন পর,
হয়েও আমি এক ভিনদেশী অচেনা পর,
তারা সবে জানিল যখন আমার দেশ পরিচয় ও ঘর,
বেড়ালাম সেখানে যেন লভে প্রাচীন গ্রাম-বাংলার জামাই আদর,
কোন কাজ করিনা শুয়ে বসে থেকে এত মজার খানা মনে রইবে তা জনমভর,
করে তারা ভিতরে ভিতর, বিধান মত অনেক যোগাযোগ তদন্ত ও খোঁজখবর,
জাহাজ গিয়ে শেষে পৌছিল যখন করিল নোংগর, অষ্ট্রেলিয়ার এক বিখ্যাত নৌবন্দর।
আমি এক মুসাফির যাযাবর,
চলছে আমার মহারাজার মর্জি ও খেয়ালে এক আজব সফর,
বিদেশী নাবিকেরা মোরে করিল উদ্ধার বাঁচিল প্রাণ, ডুবিয়েও শেষে কেন মারেনিতো আমারে সাগর,
বড় আশা ছিল আমার মনে বিদেশে যাই,
করিব গোপনে দুহাতে আমি অনেক অর্থ টাকাকড়ি কামাই,
হবো বড় সাহেব, পকেটে অনেক টাকা লই ও গায়েতে দামী পোষাক জড়াই,
নগন্য হয়েও আমি ধন্য, কমদামী হয়েও হবো বেশী দামী আর তাতেই করিব বড় হবার বড়াই ।
জানিনা অবশেষে,
সাগরের লোনা জলে ভেসে ভেসে,
মরণ হতে জীবন লভে কপাল গুনে এই বিভূঁই বিদেশে এসে, তবে কি আমি ভাই যাচ্ছি ওরে পেতে তাই ?