কবিতা কি?
কবিতা হলো এমন অন্তর্জাত উপলব্ধি যা সুষম শব্দে ও সুষম বিন্যাসে ব্যক্ত করা হয়। তাতে থাকে উপমার ব্যাপ্তি। থাকে সময়কে ধারণ করে সময়কে অতিক্রম করার যোগ্যতা। তাই সব কথাই কবিতা নয়। কবিতা হয়ে ওঠে। কবিতা বুঝতে হয়। বোঝানো যায় না।


পদ্য, ছড়া ও কবিতার মাঝে পার্থক্য
সুষম ছন্দোবদ্ধ কথামালা হলো পদ্য। আর কোনো পদ্যের চরণে চরণে যদি ভাবের সুষ্পষ্ট ও সাবলীল প্রকাশ ঘটে এবং শব্দের নিখুঁত গাঁথুনি হয়, সেটাকে আমরা ছড়া বলি। আর যদি ভাবের গায়ে উপমার চাদর জড়িয়ে রহস্যময় করে তুলি, রূপ দেই মোহনীয় চিত্রকল্পের, তবে সেটাই হয়ে ওঠে কবিতা। তাই পদ্যকে ছড়া বা কবিতা বলার অবকাশ নেই। ছড়াকেও কবিতা না বলা চাই। প্রত্যেক বিষয়কে আপন স্থানে থাকতে দেয়াই শ্রেয়।


ছন্দে চাই স্বকীয়তা
যদি ছন্দ, মাত্রা ও অন্ত্যমিল ঠিক রাখা যায়, এবং শব্দের নিখুঁত গাঁথুনির তুলিতে ভাবের সুষ্পষ্ট ও সাবলীল প্রকাশ ঘটানো যায়, তবে সেটি একটি সফল ছড়া হয়ে ওঠে। তবে একটি ছড়া সফল ছড়া হলেই সাহিত্যের মূলধারায় সংযোজিত হয় না। সেজন্য প্রয়োজন ছড়াটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে মূর্তমান হওয়া। ছন্দের কাঠামোতে বৈচিত্র্য থাকা।
ছন্দে বৈচিত্র্য আনা যায় বিভিন্নভাবে। নিম্নে উদাহরণসহ তা বিধৃত হলো,
১. প্রচলিত যে কাঠামো আছে, তাকে ব্যতিক্রম অবয়বে তুলে ধরা। যেমন
তুমি যদি পাশে থাকো মন থাকে শান্ত,
শত ঘাত ভুলে যাই দেখে তব কান্ত।
ভুলে যাই কিছু আগে মনে ছিল দুঃখ
মুছে যায় সবকিছু হোক যত সুক্ষ।
জীবনেতে চাই শুধু ভালোবাসা এটুক
মন ভরে থির করে ভালোবাসা যেটুক।  
এটি মাত্রাবৃত্ত স্বরে রচিত প্রচলিত একটি ছড়ার কাঠামো। তবে এটাকে আমরা নতুনত্ব দেয়ার জন্য এভাবে উপস্থাপন করতে পারি।
তুমি যদি
পাশে থাকো
মন থাকে
শান্ত,
শত ঘাত
ভুলে যাই
দেখে তব
কান্ত।
ভুলে যাই
কিছু আগে
মনে ছিল
দুঃখ
মুছে যায়
সবকিছু
হোক যত
সুক্ষ।
জীবনেতে
চাই শুধু
ভালোবাসা
এটুক
মন ভরে
থির করে
ভালোবাসা
যেটুক।  
এতে কাব্য কাঠামো ঠিক থাকলেও একটি নতুনত্ব ও সৃজনশীলতা প্রকাশ পেয়েছে।
একই কাঠামোকে আপনি আরেকভাবে লিখতে পারেন। যেমন
তুমি যদি পাশে থাকো মন থাকে
শান্ত,
শত ঘাত ভুলে যাই দেখে তব
কান্ত।
ভুলে যাই কিছু আগে মনে ছিল
দুঃখ,
মুছে যায় সবকিছু হোক যত
সুক্ষ।
জীবনেতে চাই শুধু ভালোবাসা
এটুক,
মন ভরে থির করে ভালোবাসা
যেটুক।
এভাবেও নতুনত্ব প্রকাশ করা যায়। একই কাঠামোকে আপনি ভিন্নভাবেও দেখাতে পারেন।
তুমি যদি পাশে থাকো
মন থাকে শান্ত,
শত ঘাত ভুলে যাই
দেখে তব কান্ত।
ভুলে যাই কিছু আগে  
মনে ছিল দুঃখ,
মুছে যায় সবকিছু
হোক যত সুক্ষ।
জীবনেতে চাই শুধু
ভালোবাসা এটুক,
মন ভরে থির করে
ভালোবাসা যেটুক।
এভাবে লিখলেও নতুন দেখা যায়। অন্যভাবেও লেখা যায়। দেখুন,
তুমি যদি         পাশে থাকো
        মন থাকে শান্ত,
শত ঘাত          ভুলে যাই
        দেখে তব কান্ত।
ভুলে যাই         কিছু আগে  
       মনে ছিল দুঃখ,
মুছে যায়         সবকিছু
       হোক যত সুক্ষ।
জীবনেতে        চাই শুধু
       ভালোবাসা এটুক,
মন ভরে           থির করে
      ভালোবাসা যেটুক।
নতুনত্ব ভিন্নভাবেও তৈরি করা যায়। যেমন
তুমি যদি পাশে থাকো
মন থাকে
শান্ত,
শত ঘাত ভুলে যাই
দেখে তব
কান্ত।
ভুলে যাই কিছু আগে
মনে ছিল
দুঃখ,
মুছে যায় সবকিছু
হোক যত
সুক্ষ।
জীবনেতে চাই শুধু
ভালোবাসা
এটুক,
মন ভরে থির করে
ভালোবাসা
যেটুক।  
নতুনত্বের আরেকটি দিক এভাবে আনা যায়,
তুমি যদি পাশে থাকো
মন থাকে শান্ত,
শত ঘাত
ভুলে যাই
দেখে তব কান্ত।
ভুলে যাই কিছু আগে
মনে ছিল দুঃখ,
মুছে যায়
সবকিছু
হোক যত সুক্ষ।
জীবনেতে চাই শুধু
ভালোবাসা এটুক,
মন ভরে
থির করে
ভালোবাসা যেটুক।  
সৃজনশীলতার পরিচয় এভাবেও ফুটে ওঠে, যদি একই কবিতায় একাধিক কাঠামো ব্যবহার করা হয়। যেমন,
স্মৃতিজুড়ে রয় শুধু প্রীতিময়
দিন,
বড় হয়ে ভুলে যায় ওসবের
ঋণ।
স্মৃতি বড় মধুময় মন তাকে
চায়,
ব্যথা পেলে মন তাই ফিরে সেথা
যায়।
তাই হয়
লোকজন
স্মৃতিতে কাতর,
স্মৃতি ভোলা লোক হয় নিমিষে পাথর।
আজ যেটা ঘটে যায়
কাল সেটা স্মৃতি,
ভালোবাসাময় হোক
আমাদের পৃথ্বি।
ভালোবাসা নিয়ে তবে গড়াবে জীবন
কুলকুল বয়ে যাবে মরু বিয়াবন।
এভাবেও ছন্দকাঠামোতে নতুনত্ব আনা যায়। এখানে আটটি অবয়ব দেখানো হলো, আপনি চাইলে প্রচলিত এই ছন্দকাঠামোর আরো কোনো রূপ আবিষ্কার করতে পারেন। এভাবে পুরোনো কাঠামোকেই ভিন্ন ছাঁচে ফেলে আপনি নিজের সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেন। এতে সাহিত্যের মূলধারায় আপনি নিজেকে উপস্থাপিত করতে পারবেন। মনে রাখবেন, সাহিত্য সবসময় সৃজনশীলতাকে আশ্রয় দেব। আর গতানুগতিক ধারাকে সময়ের সাথে সাথে ছুঁড়ে ফেলে।
অথবা নিজে নতুন কোনো কাঠামো আবিষ্কার করা। নিজে নতুন কাঠামো আবিষ্কারের জন্য, যারা নতুন কাঠামো ধরে চলে, তাদের কাঠামোগুলো লক্ষ্য রাখা। তাদের নতুন বিনির্মাণের ভেদ উদঘাটন করে, আপনিও নতুনের সন্ধানে নেমে পড়ুন। তবে আপনি অবশ্যই নতুনের দেখা পাবেন।
কিছু কাঠামোর সন্ধান তবে দেই,
১.
নাম কি তোমার
মান্না,
কথায় কথায় কণ্ঠভারি
ক্ষণিকবাদে রসের হাড়ি
নানা রূপের মাঝে হঠাৎ
দেয় জুড়ে দেয় কান্না।
আহা, মান্না আমার মান্না।
নাম কি মেয়ের
মিষ্টি
বাইরে গেলে পরিপাটি
সবার সাথে যেন মাটি
বোনের সাথে খুনসুটিতে
দারুণ মনের সৃষ্টি।
আহা, মিষ্টি আমার মিষ্টি।
২.
চাই চাই চাইয়া
বিলধারে যাইয়া
কানা বক ঘুরে ঘুরে
মাছ মারে নাইয়া।
চাই চাই চাইয়া।
চাই চাই চাইয়া
ভাই গেল খাইয়া
লোকমাঝে গান ধরে
গলা ছাড়ে গাইয়া
লোকজন টাকা দেয়
খুশি সেটা পাইয়া।
চাই চাই চাইয়া।
চাই চাই চাইয়া
মাছ মারে মাইয়া
কোচ ভরে চুনামাছে
ভেলাখানা বাইয়া।
লোকজন হেসে হেসে
মারে তাকে ঘাঁইয়া।
চাই চাই চাইয়া।
৩.
মনের মতো বন্ধু পেলে
আর কোনোদিক চেয়ো না।
ভিনঘাটে আর নেয়ো না।
যতন করে আগলে রেখো
কষ্ট তাকে দিয়ো না,
নিজেও কষ্ট নিয়ো না।
মনের মতো বন্ধুটা তো
খুব সহজে মেলে না,
তাই তাকে কেউ ফেলে না।
বন্ধু চেনা খুব সে কঠিন
সহজ সেটা কভু নয়,
খুব কঠিন যে তবু নয়।
৪.
হয়তো ভালোবাসো না
নয়তো কেন হাসো না
ভালোবাসা থাকলে প্রিয়
ফুটবে হাসির ফুল,
এই জীবনে ভালোবাসা
না দেয়া খুব ভুল।
মনমুকুরে পরম আশা
একটুখানি ভালোবাসা
আমার জন্য হোক,
আমি হলাম মনভিখারি
মন চাওয়া এক লোক।
মনকে চেয়ে না পেলে তো
আর থাকে না কুল,
এই জীবনে ভালোবাসা
না দেয়া খুব ভুল।
হাসলে তুমি হাসে পৃথ্বি
পরম পাওয়া পরম প্রীতি
এক জীবনে বেশ,
তোমার খুশি পুলক জাগায়
মন মাতায় অশেষ।
তোমার হাসি আমার খুশির
শুদ্ধতম মূল,
এই জীবনে ভালোবাসা
না দেয়া খুব ভুল।
৫.
মনটা যখন তোমার কথা কয়
ডেকে ওঠি ও সখী গো দূরত্ব না সয়
বড্ড নিরালয়।
কাছে এসে প্রাণটা জুড়াও হয়ো না নির্দয়।
তোমার পরশ পেলে আমার
জেগে ওঠে দিল,
তোমার ভালোবাসা আমার
মনটাতে দেয় খিল।
ভালোবেসে টানতে কাছে
আর না অভিনয়,
একটু খানি প্রেমের ছোঁয়া
দিস রে ও নির্দয়।
৬.
হঠাৎ সেদিন পথের ধারে থমকে দাঁড়াই দেখে
চলে গেলে ব্যস্ত-ভাবে বিষণ্নতা মেখে।
বুঝি তখন ভুলছ আমায় দুঃখ চেপে রেখে।
সেদিন যখন অন্যজনের হাতটি ধরে হাঁটি
অশ্রুভেজা নয়ন মেলে দেখলে স্মৃতির ঘাঁটি
এখন কেঁদে লাভ কি বলো ছিলে কেনো বেঁকে?
আমি এখন অন্যজনের স্বপ্ন তাকে নিয়ে
বদলে গেছি পুরোপুরি স্মৃতির দাফন দিয়ে।
দুঃখ সয়ে হয় না বদল বল না সখা সে কে?
৭.
এক হাতে ফুল দাও
এক হাতে কাঁটা,
এইটা কি পাও চাটা
এইটা কি চাটা?
একদিকে চোখ মুদো
একদিকে খুলো,
এইটা কি মুলো বলো
এইটা কি মুলো?
ফুল যদি দিতে চাও
দিয়ো দুই দিকে,
চোখে দেখো ইনসাফে
নয় সব ফিকে।
৮.
নাম কি গাঁয়ের
ঢেপা,
মানুষগুলো
খেপা।
মাটির সাথে লোকের আবার
হয় স্বভাবটা লেপা।
অলিগলি নয়তো আবার
অনেক অনেক চেপা।
ঢেপা সে যে ঢেপা।
৯.
সবুজ শ্যামল বন-বনানী আছে অনেক মাঠ
লম্বা দীঘল পাট
হাওয়ার তালে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের বিশাল ঘাট।
মাঠে মাঠে সবুজ হাসে দুলে ধানের শীষ
পাতায় পাতায় মিশ
এমন শোভা কোথাও পেলে খবর আমায় দিস।
মাঠে চরে গরু মহিষ থাকে রাখাল দল
মিষ্টি কোলাহল
মাটির ছেলে সহজ সরল নেই তো কোনো ছল।
১০.
চিঠির দিবস
মনটা বিবশ
নেই যে কেউ
মনে ঢেউ
নেই কি আমার প্রিয়,
তবে তুমি
মনের ভূমি
কাকে দেবে
কী বা নেবে
তার জানানটা দিয়ো।
আমায় যদি
মনের নদী
একটুখানি
দিতে টানি
নিতাম তুলে পানি,
জীবন পথে
কোনো মতে
চলতে গিয়ে
সেটা দিয়ে
চালিয়ে নিতাম ঘানি।
চিঠি দিয়ো
খবর নিয়ো
মনের খবর
হোক না জবর
যাবে নতুন এলে,
তারই আগে
আমার ভাগে
দাও না কিছু
নয়তো পিছু
খুশি হব পেলে।
এখানে ১০টি নতুন কাঠামো দেখা হলো। নতুনত্বের শেষ নেই। সৃজনশীল ছড়াকাররা নিত্যনতুন ছন্দের পেছনে সবসময়ই ছোটেন। তাই তাদের ছড়ার প্রতি দৃষ্টি রাখা চাই। তবে আপনিও নিজেকে নতুন কোনো দিগন্তে আবিষ্কার করবেন।
মনে রাখবেন নতুন কাঠামো ও নিখুঁত গাঁথুনি ছড়া সাহিত্যের মূল ধারায় সংযোজিত হওয়া যায় না। নতুন কাঠামোর জন্য বর্তমান প্রতিষ্ঠিতদের লেখা ছড়া-কবিতা নিয়মিত পড়তে হবে। তবে নিখুঁত গাঁথুনির জন্য রথি-মহারথীদের সাহিত্যের বিকল্প নেই। সেজন্য নজরুলের কাঠামোতে নিজের কাব্য না বুনলেও তাকে পাঠের বিকল্প নেই।