সবাই‌কে  মা দিব‌সের শু‌ভেচ্ছা ।


মিথ্যাবাদী মা
আদিত্য অনীক


এতটা দিন পেরিয়ে আজো মায়ের জন্য কাঁদি,
কারণ আমার মা যে ছিল ভীষণ মিথ্যাবাদী।
বাবা যেদিন মারা গেল আমরা হলাম একা,
সেদিন থেকেই বাঁক নিয়েছে মায়ের কপাল রেখা।
মা বলতো বাবা নাকি তারার ভিড়ে আছে,
লেখাপড়া করি যদি নেমে আসবে কাছে।
তারায় তারায় বাবা খুঁজি তারার ছড়াছড়ি,
আমার মায়ের মিথ্যে বলার প্রথম হাতে খড়ি।


পাড়া পড়শী বলল এসে এই বয়সেই রাড়ি !
একা একা এতটা পথ কেমনে দেবে পাড়ি?
ভাল একটা ছেলে দেখে বিয়ে কর আবার,
মা বলল, ওসব শোনে ঘেন্না লাগে আমার।
একা কোথায় খোকন আছে, বিয়ের কী দরকার?
ওটা ছিল আমার মায়ের চরম মিথ্যাচার।


রাত্রি জাগে সেলাই মেশিন, চোখের কোণে কালি,
নতুন জামায় ঘর ভরে যায় মায়ের জামায় তালি।
ঢুলু ঢুলু ঘুমের চোখে সুঁই ফুঁটে মা’র হাতে,
আমি বলি শোও তো এবার কী কাজ অত রাতে?
মা বলত ঘুম আসে না শুয়ে কী লাভ বল?
ওটা ছিল আমার মায়ের মিথ্যা কথার ছল।


স্কুল থেকে নিতে আসা গা‌ড়ি ঘোড়ার চাপে,
আমার জন্য দাঁড়ানো মা কড়া রোদের তাপে।
ঘামে মায়ের দম ফেটে যায়, দু’চোখ ভরা ঝিম,
ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে আমায় দিত আইসক্রিম।
মায়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলতাম একটু নাও,
মলিন হেসে মা বলত, খাও তো বাবা খাও।
আমার আবার গলা ব্যথা, ঠাণ্ডা খাওয়া মানা,
ওটা ছিল আমার মায়ের নিঠুর মিথ্যা-পনা।


বড় হয়ে চাকরি নিয়ে বড় শহর আসি,
টুকটুকে বউ ঘরে আমার বউকে ভালবাসি।
পশ এলাকায় বাসা নিয়ে ডেকোরেটর ধরে,
সাজিয়ে নিলাম মনের মত অত্যাধুনিক করে।
মা তখনো মফঃস্বল কুশিয়ারার ঢালে,
লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে সন্ধ্যাবাতি জ্বালে।
নিয়ন বাতির ঢাকা শহর আলোয় ঝলমলো,
মাকে বলি গঞ্জ ছেড়ে এবার ঢাকা চলো।
মা বলত এই তো ভালো, খোলা মেলা হাওয়া,
কেন আবার তোদের ওই ভিড়ের মধ্যে যাওয়া?
বদ্ধ ঘরে থাকলে আমার হাঁপানি ভাব হয়,
ওটা ছিল আমার মায়ের মিথ্যা অভিনয়।


তারপর আমি আরো বড়, স্টেটস এ অভিবাসী,
বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ সুনাম রাশি রাশি।
দায়িত্বশীল পদে আমার কাজের অন্ত নাই,
মায়ের খবর নিব এমন সময় কমই পাই।
মা বিছানায় একলা পড়া খবর এলো শেষে,
এমন অসুখ হয়েছে যার চিকিৎসা নেই দেশে।
উড়ে গেলাম মায়ের কাছে অনেক দূরের পথ,
পায়ে পড়ে বলি মাকে এবার ফিরাও মত।
একা একা গঞ্জে পড়ে কী সুখ তোমার বল ?
আমার সংগে এবার তুমি এমেরিকা চল।
এসব অসুখ এমেরিকায় কোন ব্যাপার নয়,
সাত দিনের চিকিৎসাতেই সমূল নিরাময়।
কষ্ট হাসি মুখে এনে বলল আমার মা,
প্লেনে আমার চড়া বারণ তুই কি জানিস না ?
আমার কিছু হয় নি তেমন ভাবিস অযথা,
ওটাই ছিল আমার মায়ের শেষ মিথ্যাকথা।
ক’দিন পরেই মারা গেল নিঠুর মিথ্যাবাদী,
মিথ্যাবাদী মায়ের জন্য আজো আমি কাঁদি।