ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার প্রিয়তম!
আপনাকে মনে পড়লে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
খুব মানে ভীষণ। যতোটা ভীষণ হলে এ হৃদয়ের নাম
বিষণ্ণ আকাশ— আমি যে কী করি!

আপনার মায়ামুগ্ধ চেহারায়ে মুবারক সাক্ষাতের
তীব্র আশায়— যাপিত কত দিন-রাত পিছনে ফেলে এসেছি কেউ জানবে না। আপনাকে না দেখার অশ্রুজলে আমার দু'চোখ পরিত্যক্ত নদীর গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক অগন্তব্য ঝরনা।

পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে আপনারে খুঁজি,
নির্জলা কুয়াশায় ঢাকা রাতের রুপোলি জোৎস্নার আড়ালে।
খুঁজতে বসি নিস্তব্ধ নদীর ঘাটের আবডালে! কত নৌকা ভিড়ে, মানুষের নিখাদ ব্যস্ততা। নিয়ন বাতি জ্বালিয়ে সবাই ছোটে কেবল এক অদ্ভুত লালস্যতার দিকে। ব্যস্ততম অনাদিকাল শহরের হৈ-হুল্লোড় শব্দ। শব্দের অশ্রাব্য ধকল, যান্ত্রিক ভায়োলিন। আমাকে কিছুতেই এসবে শান্তি দেয় না!

কতকাল যে দেহ আপনার মুয়ানাকা পাবার উন্মাদনায় বিভোর বেপরোয়া, যে হাত নিভৃতে আপনাকে ছোঁবার অহমে বেজায় বেকারার, আপনাকে দেখার যে শীতল চোখগুলো শুকিয়ে আজ ইউফ্রেটিসের নিশুতি প্রান্তর,
যে হৃদয়ের ভাবনারা সদা এক শ্রেষ্ঠ তাজ মহামানবের তাসবীর্ স্মরে— তবে সে আস্ত একটা হৃদয়কে আপনার সাক্ষাৎ ছাড়া আর কীসে প্রশান্ত করবে ইয়া রাসুলাল্লাহ? আপনি আমার বিক্ষিপ্ত পাপদরিয়ার এক অবিশ্বাস্য আলোকবর্তিকা; আমার অন্যতম সুমহান আদর্শ।

আপনি বিশুদ্ধতম সেই নৌকার মাঝি, যেই নৌকার নাম পুলসিরাত! আমি সে নৌকার এক অজপাড়া যাত্রী।
আপনার সুপারিশ ছাড়া জাহান্নামের অতল সমুদ্রে
ভীষণভাবে ডুবে যাব। সেদিন কি হবে আমার! কি করে সেথায় আপনার চেহারায়ে মুবারকের উদগ্র সাক্ষাৎ লাভ করা যাবে ইয়া রাসুলাল্লাহ? আপনাকে না দেখার তীব্র অসুখে সেদিন আমার অনবরত মৃত্যু হবে। আমাকে হাশরের কঠিনতম দিনে শাফায়াত প্রাপ্তদের তালিকাভুক্ত করুন!

আপনাকে ভাবতে ভাবতে খুঁজি।
অগুনতি ভাবনার বীভৎসতায় হারিয়ে গেলে ফের আকুল হয়ে খুঁজি। ব্যাগভর্তি বই নিয়ে স্কুল থেকে আসা সন্তান যেমন ঘরে এলে শুরুতেই খুঁজে প্রিয় মাকে! চৈত্রের ভরা দুপুরে রিক্ত ফসলের মাঠঘাট যেমন বৃষ্টির তৃষ্ণায় প্রচন্ড হাহাকার করে— আপনাকে দেখার প্রাবল্য তৃষ্ণায় তদ্রূপ আমার হৃদয় বিরান-ধুনিত অঙ্গার!

আপনাকে প্রথম দেখায় অতিবিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকব একশো আটানব্বইটা বসন্ত; বিচ্ছুরিত মায়ামাখা মুগ্ধতার আলোয় আমার তাবৎ চেহারা জ্বলেপুড়ে ঝলসে যাওয়া পর্যন্ত! আপনাকে দেখে আমার চেহারা ঝলসে যাক ইয়া রাসুলাল্লাহ। আপনাকে দেখে যেন আমার চেহারা ঝলসে যায়!

আপনি কি আসবেন আমার ভোরবেলার জায়নামাজে,
নরম বালিশে রাখা মাথার কাছে— রাসুলের ভাবনায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘুমিয়ে পড়া এক আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নে? অথবা
প্রথম রাত্রিতে ঘুম না আসা প্রকোষ্ঠের হিম জানালায়।
ম্রিয়মাণ খোলা বাতাসের নিশ্চলতায় এই অনারবের শিয়রে; জাহান্নামের সতর্কবার্তায় আমার এলোমেলো জীবন গোছানোর সুনির্মল পরামর্শ দিতে?

আমার জন্য দুআ করুন ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আপনার এক অনারবি উম্মত। নক্ষত্রসম দূরের অতিদুর্গম এক অজপাড়াগাঁয়ে থাকি! বিচারদিনে আপনার শাফায়াতের নির্মম ভিখারি হয়ে পানে চেয়ে থাকব সুমিষ্ট হাউজে কাওসারে। সেদিনও আমি পাগলের মতো আপনারে খুঁজবো— ক্লেশিত, ভয়ার্ত চেহারা আর নগ্ন, উদ্বিগ্ন দেহ নিয়ে যেদিন মানুষ খুঁজবে আরশের নিচে একটুকরো ছায়ার মলাট!

সন্ধ্যাতারার বাতায়নে ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা দু'চোখ আপনাকে দেখার বিশাল আকাশ জন্ম দেয়। চোখের পাতায় উদাস আঁধার নামলে একখণ্ড সুস্নিগ্ধ আলো এসে মুখ উজ্জ্বল করে। আপনিই কি সেই চাঁদ হে আমার প্রিয়? যার আলোয় উচ্ছ্বসিত হয় আমার সমস্ত অন্ধকারচ্ছন্ন শরীর!

চাঁদের তো নিজস্ব আলো নেই। সূর্য থেকে যা আলো পায়
তা দিয়ে রাতে আলোকিত করে নিখিল জগৎ। অথচ আপনি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা থেকে মহিমান্বিত আলো নিয়ে এক ধ্রুপদী চাঁদ হয়ে পৃথিবীতে এলেন! আলোর মশাল জ্বেলে গোটা জগৎবাসীকে বের করলেন অতল অন্ধকারের উদগীরিত আগ্নেয়গিরি থেকে!

অজ্ঞাতার আয়নাঘর থেকে মুক্তি দিলেন তামাম জাহেলিয়াতের উপকূলে থাকা উজবুক আধিবাসীদের! সংঘবদ্ধ করলেন বিচ্ছিন্নতম বিগ্রহে লেপটে থাকা অথর্ব ছন্নছাড়াদের! মানুষ কেবল এক স্রষ্টার গোলাম; মানুষের গোলাম যে মানুষ হতে পারে না, চিরতরে সেই নিপীড়িত দাসপ্রথার কবররচিত করলেন। অভিভূত অভিভাবক হয়ে আশ্রয় দিলেন অভুক্ত এতিমদের! জীবন্ত পুঁতে ফেলা কন্যাসন্তানদের ভাগ্যে বড় হয়ে বেড়ে উঠার অধিকার দিলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ— যাঁরা আজীবন সম্মানিতা মায়ের সম্মানে সমাদৃত হলো সর্বত্র। যাঁরা পেলো উৎকৃষ্টময় উৎকর্ষ মণিমুক্তার জীবন!

হে মহানবী, আমার প্রিয়তম হাবীব,
ডাহুক ডাকা কোনো এক জারুল বিকেলে— আপনার অপেক্ষায় নিশ্চুপ বসে থাকব শান্ত ঝিলের ধারে। মদিনার বার্তাবাহকের খামে— প্রিয় রওজা জিয়ারতের চিঠি এলে সুখের অঝোর ধারায় কাঁদবো! যে কান্নায় ঝরবে এই আশেকের আবেগাশ্রিত অশ্রুবৃষ্টিমালা!