মৃত্যুশয্যায় আমি
মরণ অতি সন্নিকটে,
শুধু খানিকক্ষণের অপেক্ষা,
এরপরই প্রারম্ভ মরণোত্তর এক অজানা যাত্রার,
দৈহিক কারাগার থেকে মুক্তির,
অনুভূতির শৃঙ্খল হতে স্বাধীনতা প্রাপ্তির,
আজীবন অনুভূত সকল কষ্টের অবসানের।
নিজেকে খুব হাল্কা মনে হচ্ছে
হচ্ছে এক নির্মল আনন্দের অনুভব,
ইচ্ছেপূরণের দিন আজ,
ক্ষণস্থায়ী জীবন লাভের,
তাৎপর্যপূর্ণ জীবনধারণের,
মর্যাদাপূর্ণ জীবনাবসানের,
কর্মগুণে মৃত্যু ছাপিয়ে অবদান স্মরণের।
তোমায় মনে পড়ছে তীব্রভাবে
দর্শনের আকাঙ্ক্ষার উদ্ভব গভীরভাবে,
ছোঁবার ইচ্ছের উদয় প্রবলভাবে,
তোমার নয়নে প্রিয়জন হারানোর বেদনা দৃষ্টের কল্পনা নিবিড়ভাবে,
আমার বিদায়বেলায় তোমার নয়নের অশ্রুসিক্ততা দেখবার সাধ জাগে।
তোমার সাথে কথোপকথনের সমাপ্তি দীর্ঘকাল পূর্বে
আলাপচারীতায় মনোভাবের আদান-প্রদানের শেষ বহুকাল আগে,
তোমার কণ্ঠ শ্রবণের প্রতীক্ষার অবসান বহুদিন পূর্বে,
তোমার সাড়া পাবার আশার বিসর্জন দীর্ঘদিন আগে।
তোমাকে ভুলতে পারিনি কখনো
ভুলতে চাইনি কোনোদিন,
ভালোবেসেছি আজীবন,
কদর করেছি এতদিন।
তোমাকে হৃদয়ে অনুভব করেছি,
উপস্থিতি টের পেয়েছি,
তোমার নৈকট্যে আনন্দিত হয়েছি,
স্পর্শানুভুতির কল্পনায় বিভর থেকেছি,
সান্নিধ্য লাভের স্বপ্নে পুলকিত হয়েছি,
তোমার কথামালার স্মরণে হাস্যোজ্জল থেকেছি,
কর্মব্যস্ততায় তোমায় ভেবে ক্লান্তি উপভোগ করেছি,
দিনশেষে ঘুমের ঘোরে আমার কপালে তোমার হাতের উষ্ণতার,
পরশ পেতে চেয়েছি,
তোমার কোলে মাথা রেখে শান্তিময় নিদ্রার অনুভব করেছি।
তোমাকে নিয়ে অনেক ইচ্ছে ছিল আমার
একান্তই নিজের কিছু ইচ্ছে,
তোমার হাতে হাত রেখে পথ চলার,
তোমার কাঁধে মাথা রেখে আকাশ দেখার,
সমুদ্রের তীরে বসে সমুদ্রের গর্জন শোনার,
তোমার সঙ্গে প্রকৃতির বিশালতায় হারিয়ে যাবার,
তোমার সহিত জীবন ভাগাভাগী করবার,
সাংসারিক শান্তির নিবাস গড়ে তোলার,
আমাদের অংশের বেড়ে ওঠা দেখবার,
ভরণপোষণের দায়িত্ব বণ্টন করবার,
কর্তব্য পালন শেষে জীবন পুনরায় উপভোগ করার,
মৃত্যু অবধি পাশাপাশি থাকার।
কিছু আশা জাগিয়ে রেখেছিলাম মনে
হয়ত তুমি আসবে আমার কাছে,
আমায় ফিরিয়ে আনবে তোমার নিকটে,
আমায় জোর করবে তোমার কাছে থাকতে,
আমার মান ভাঙ্গাবে,
আমায় বুঝবে,
আমায় ভালোবাসবে।
আমি চলে যাচ্ছি চিরকালের জন্য
কিছু কথা বলার ছিল তোমায়,
জানি তুমি সম্মুখে নেই,
তবুও বলবো আজ আমি,
হয়ত প্রকৃতির লীলাখেলায় আমার শব্দমালার,
অনুরণন পৌঁছাবে তোমার নিকট,
আমার সকল আনুগত্য তোমার জন্য,
আমার সকল ভালোবাসা গচ্ছিত তোমার জন্য,
আমার ব্রহ্মচর্যের ব্রত পালন তোমার জন্য,
আমার সন্ন্যাস জীবনের যাপন তোমার জন্য,
আমার একাকী জীবনের আগলায়ন তোমার জন্য।
আমি তো চলেই যাচ্ছি
পারলে আমায় মনে রেখো,
হৃদয়ের গভীরতম স্থানে কিঞ্চিৎ অনুভব কোরো আমায়,
তোমার বিস্তৃত জীবনে পারলে আমায় একটু স্থান দিয়ো,
তোমার কর্মচাঞ্চল্যে পারলে আমায় একটু স্মরণ কোরো,
একজন মানুষ হিসেবে পারলে আমায় একটু ভালোবেসো।
মাগো, আমি আসছি তোমার কাছে
হয়ত তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি,
আত্মঅভিমানে তোমার সহিত দূরত্ব বাড়িয়েছি,
নিজ সিদ্ধান্তের অটলতায় তোমায় আঘাত করেছি,
নিজ অনুভূতির প্রাধান্যে তোমার অকৃত্রিম
ভালোবাসাকে অবহেলা করেছি,
নিজ ব্যাকুলতায় তোমার আকুলতাকে উপেক্ষা করেছি,
নিজ বেদনা লাঘবের তাড়নায় তোমার আত্মত্যাগের অসম্মান করেছি,
নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে তোমার নিঃস্বার্থ মমতাকে অশ্রদ্ধা করেছি,
আত্মযন্ত্রণার ছায়ায় তোমার অশ্রুময় চক্ষুর প্রতি অন্ধ থেকেছি,
তোমার বারংবার জিজ্ঞাসায় আমি অব্যক্ততায় পাষাণ থেকেছি।
মাগো, ও মা, তুমি আমায় ক্ষমা কোরো
পরপারে আমাকে গ্রহণ কোরো,
আমার দেয়া সব আঘাত ভুলে যেয়ো,
আমাকে তোমার বুকে আগলে নিয়ো,
আমায় স্নেহ দিয়ে ভরিয়ে দিয়ো।
মাগো, তুমি আছো তো পরপারে
নাকি তুমি জন্মেছ অন্যখানে?
যদি তাই হয়, তাহলে প্রার্থনা জাগে মনে,
পুনরায় তোমার গর্ভে জন্মানোর,
তোমার দুগ্ধ পানের,
তোমার আশ্রয়ে বেড়ে ওঠার,
তোমার দিক-নির্দেশনায় বড় হবার,
তোমাকে গৌরবান্বিত করার।
ও মা, কথা দিলাম তোমায়
পরজন্মে আমি তোমার যোগ্য মেয়ে হব,
স্বার্থহীন হব,
তোমার হাসি বজায় রাখায় সচেষ্ট হব,
তোমার পাশে থাকব।
মাগো, তুমিও প্রার্থনা কোরো
পূনর্জন্মে আমাকে কন্যা হিসেবে পাবার,
পূরণ কোরো আমার পূনর্জন্মের আকাঙ্ক্ষার।