(বাংলা-কবিতা.কম এর পাঠকদের জন্য থাকছে কবি অনন্য মিজানের তিনটি কবিতা ।)


মাঠে


ফাঁকা মাঠে ঘুঘুদিন চিরন্তনী ঘুমের নেপথ্যে
অরণ্যে পাতাঝরা অন্তর্দ্বন্দ্ব
কাঠগোলাপ মিলনে
পিচ ঢালা পথে নিষিদ্ধ সময়ের কাঁটাতার
গণমুখী স্লোগান রৌদ্রবাক্যে ত্রিভুবন কাঁপানো আলোয়
অনন্তকাল অবিনাশী প্রলোভন বৃক্ষচাঁদে
গাফিলতির উঠোনে সন্ন্যাসী বালিকার চুল
আকাশে আকাশে অনেক আলোয় প্রজন্মের মাহফিল
অন্ধগলি নিরসনে প্রতিশ্রুতির বরাত মুক্তপ্লাটফর্মে ।
জীবন জলসার টেবিলঘড়ির প্রেক্ষাগৃহে তারুণ্যের টিকটিকি
আজীবন মহাসংগ্রামের গার্জিয়ান সতীর্থ সতীন
হয়ে দুর্দান্ত রূপসজ্জার পেয়ালার মতো চাঁদ চায়ের ঘ্রাণে ।
ছিন্নভিন্ন ইচ্ছেঘুড়ি ডানাভাঙা রৌদ্রের মেঘের পাহাড়ে
কর্পূরের মতো উবে গেছে স্থিরজীবন বিনিদ্র রাত
সঙ্গোপনে বহুব্রীহি শিশির রক্তক্ষরণের বিকেলে প্রোথিত ঘুম
চিরকুটের শব্দবহ সংসারে ঘায়েল মৌন নিষাদ
শূন্যে অন্তর্নিহিত প্রয়াত নিবিড় মুদ্রা ।
খোপার গোলাপে অরণ্যের উল্লাস পাখিজীবন
উৎসবের নাগরদোলায় সন্তর্পণে জানালায় মধ্যরাত্রির সমুদ্র-ডানা ।



মধ্যরাত্রির গাড়ি


প্রত্যাবর্তনের গাড়িতে বিষাদিত পাণ্ডুলিপি বসে আছে
কাকতাড়ুয়া হয়ে সে তার পাশেই ।
"আমি যখন তোমার কণ্ঠস্বর শুনি,
মনে হয় বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ ।
যখন তোমায় দেখি মনে হয় এই বুঝি আমার মৃত্যু ।
তোমার কি লজ্জাশরম কিচ্ছু নাই ।
এত্তো অপমান করি একটু লজ্জাবোধ থাকা উচিত ।
কি জঘন্য তুমি, আমাকে এভাবে বেদনা দিয়ে জল্লাদের মতো খুব উল্লাসিত হও । আমায় একটু শান্তি দেবে...." ।
প্রেম অপ্রেমের অন্তর্দ্বন্দ ঘুমোতে দেয় না ।
জাগিয়ে রাখে দীঘল রাত্রির ধূসর অন্ধকারের ডানায় ।


আচ্ছা নীলা কি এখন খোলা আকাশের নিচে চিকিৎসিত শ্বাসে মুক্তির আলোয় ভাসছে ।
নাকি স্মৃতির পাণ্ডুলিপি প্রাক্তন অক্ষরে শৃঙ্খলিত করে রাখে, ঘুমোতে দেয় না ।
ঠিক আমার মতো । ভীষণ জানতে ইচ্ছে....
"পৃথিবীটা কেবল তোমারই থাক,
শ্রেষ্ঠ সব সুখের গল্পে ভরে উঠুক তোমার জীবন-পাণ্ডুলিপির সমুদ্র ।"
পৃথিবীর আর্টগ্যালারীতে নীলার মায়াবী মুখটি ছায়াচিত্রে
রেখে লিখে দিতে ইচ্ছে হয় বাসন্তী রঙে ।
টানাপোড়েন গর্জিয়ে দেয় প্রেম অপ্রেমের বহুমুখী সংঘাত ।
তবু ভালোবাসা সুখে থাক ।
রাত্রিবেলার শহরের ঝিকিমিকি আলোয় চলেছে গাড়ি
অসংখ্য গাড়ির উড়ুক্কু প্রবাহের প্রহরে ।
"গল্পটা তো বললে না ।
টানাপোড়েনের অক্ষরে মুদ্রিত সেই প্রেম অপ্রেমের গল্প ।"
লোকজ সময় বলে চোখের দিকে তাকায় ।
দৃষ্টির আয়নায় অন্তর্দাহের গন্ধ পায় ।
"পৃথিবীটা এক পৃষ্ঠার গল্প । অথচ এ গল্পের শেষ নেই ।
কেউ কেউ মিলনের খেলাঘরে আনন্দিত প্রহর নামায় ।
কেউ কেউ বেদনায় শোকগলা বরফে ঘুমিয়ে পড়ে বুকপাঁজরে যন্ত্রণার পাহাড় রেখে ।"
কথা বলতে গিয়ে সে হোচট খায় ।
অন্তরা থামিয়ে বকের ঢঙে বসে থাকে ।
দুচোখ আঁটসাঁট অন্ধকারে ঘুমন্ত বেলার অন্তিমসময়ে গলে যায়
পুরনো পাণ্ডুলিপির অক্ষরে ।
অশ্রু, নদীর জুয়ায় মুহুর্মুহু উঁকি
দেয় বাইরের পৃথিবীর শূন্যতাবোধে ।
দৃষ্টির আলো ফিকে  হয়,
শিশিরের ডানায় বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরি
ধোঁয়ার বুদ্বুদে লাশকাটা ঘরের নিঃস্ব শরীর ।


"বড্ড পানি-পিপাসা পেয়েছে ।
বুকের ভিতরে গণকবরের আর্তনাদ ।
এক ঢোক পানি হবে ?"
পিপাসার্ত ভঙ্গিতে লোকজ চাঁদের দিকে ডাগর দৃষ্টি অর্পণ করে ।


"আকাশে তারাদের ঝিকিমিকি ।
আকাশে তারা দেখলেই আমার ছেলেবেলার কথা মনে হয় ।
তারা ফুটতো, মেঘলা আকাশ হতো বৃষ্টি হতো ।
রাত্রের ঝমঝম বৃষ্টি উপভোগ করার আনন্দটাই অন্যরকম ।"
পূর্ণিমা আয়ু কথার প্যাচ অন্য দিকে ঘোড়াতে চায় ।


"আপনি কি পাষাণ ।
আমি পানির পিপাসায় মরে যাচ্ছি,
আর আপনি স্মৃতির ঝাপি খুলতে ব্যস্ত ।"


"হুম, পানি তো নেই ।
পিপাসা বড্ড পিপাসা আকাশেরও
কত দিন জমিনের বুকে নিজেকে সমর্পণ করা হয় না ।"
জানালার চশমায় বাইরে চোখ রাখে সে ।


বিরহী প্রেমিক বিরক্তের ঢঙে চোখমুখ কোঁচকায় ।
একটি ভারিক্কি গোছের দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে যায় বাতাসে ।
অন্ধকারে অন্ধকারে অনেক রাত ।
ঝিঁঝিঁপোকা ডাকছে,
ইতিউতি কিছু জোনাকিপোকা মিছিলের আলোয় জ্বলছে ।


"নীরবে সহো সব বিরহ-বেদনা
কোথাও শান্তি নেই, হৃদয় শান্তির ঠিকানা
যে তোমায় হারিয়ে দেয় আনন্দের তুফানে
ভালোবাসা তার নয়, মুখ মুছো স্বপ্নের ক্যালেন্ডারে
মেঘের বাড়ি শোনো আকাশবাড়ি...."
তার চোখে রক্ত ঝলকিত হয় । অন্ধকারে গাড়ি চলতে থাকে । গাড়ি চলছে ।
ল্যাম্পপোস্ট সব এখন মৃত.....



প্রেম বিরহ প্রেম


অগ্রজ সময়ের খোলা জানলার ডানায় উজ্জ্বল আয়ু
দারুণ রূপালী অস্ত্রের প্রতিশ্রুতির ছায়ানিনাদে খেলাঘর
বিষাদী সুর মিলনের বিচ্ছেদে
প্রাণের মোমবাতির আলোয় কয়েকটা জোনাকিপোকা ।
বেদনাকে অস্বীকার করে সাবেককালের মাঠে দাঁড়িয়েছি গৃহত্যাগী  আঁধারের চোখে
আলোর মুখোশে পূর্ণিমারচাঁদ
মানুষগুলো বনভূমির সাইকেলে দৌড়ায় ভোলা-ভোলা চিন্তায়
পৃথিবীর সিম্ফনি পাহাড়ের স্তনে মুখ রেখে ঘুমোয় ।
ম্লান চিরকুটে নিস্তব্ধ কাফনে মোড়া রৌদ্রগানের দিন
জীবন জুয়ায় উল্টো চাকার গাড়িতে আয়ুরেখা দূরদ্বীপে বিলীন ।
নিভৃত পাড়াগাঁর নিরিবিলি উঠোনে আমায় বৃক্ষমানব ভাবতেই
কাঁধ ছোঁয় তোমার হাত
তোমার চোখের আয়নায় দেখি নিজমুখ
বৈশাখী ঢঙে বাসন্তী রঙে চুমু হঠাৎ
এখন আমার গালে একটি দেশের ঠোঁট
বৃক্ষের মায়াবী সবুজ পাতা....