[ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ]


চৈত্রের দাবাদহ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে,
উনুন আর চিতার আগুন জ্বলছে সমান তাপে।
মাঠের পর মাঠ ফেটে চৌচির, গাঙ শুকিয়ে  
ধূধূ বালুচর, ভ্যাপসা গরম প্রান ওষ্ঠাগত।


এমনই এক  ক্ষণে বিচিত্র এক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার
আয়োজন চলছে খোলা এক প্রান্তরে,
কবিতা’দের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।


সারি সারি কবিতা’দের লাশ পড়ে আছে
নামি দামি, চেনা অচেনা সহস্র কবিতা,
বেনামী কিছু কবিতা পড়ে আছে
লাশ কাটা ঘরে গন শেষকৃতের অপেক্ষায়।


রবিন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ খানি
নিয়ে আসা হোল বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে,
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ লাশটাকে মাথায় তুলে
নিয়ে আসল বাবরি দোলান ঝাকড়া চুলের দল।


বিশেষ বিমানে করে নিয়ে আসা হোল
একটি নেপালি কবিতার খাতা,
ওটা নাকি পাওয়া গেছে ধ্বংস স্তূপের নিচে।
মহিমান্বিত হোক তবে মহাঅন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়।


বঙ্গ বন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ নিয়ে লেখা
নিরমলেন্দু গুনের কবিতাখানি নিয়ে আসা হোল
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়, লাল সবুজের পতাকা মুড়ে।


‘স্বাধীনতা তুমি’  কবিতাটি শেষ যাত্রায় পেল
বিশেষ সন্মাননা, কবি নিজে উপস্থিত হয়ছেন
লোবান জ্বালিয়ে হাতে নিয়ে।


লুতফর রহমান রিটনের ছড়ার বাক্সে
পেরেকের ঠোকাঠুকি চলছে শেষ বারের মত,
পাশে বসে তিনি বিড়বিড় করে ছড়া কাটছেন।  


মাথায় লাল পট্টি বেঁধে শ্লোগান মুখরিত
বামেদের ছোট্ট মিছিলটি এগিয়ে চলছে  
কমরেডকে লাল সালাম জানাতে।


রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রির বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক
অনেকেরই শোকবার্তা পড়ে শোনান হোল,
তোপধ্বনি হোল, বিউগল বেজে উঠল করুন সুরে।


অতঃপর জানাজা পড়া হোল, কিছু কবিতাকে
শুয়ে দেয়া হোল চিরনিদ্রায় ধর্মীয় রীতিতে ,  
হরি বোল বোল হরি ধ্বনি তুলে কিছু কবিতা
নিয়ে যাওয়া হোল শ্মশানের ঘাটে,
আর দু’ একটা কবিতা টাঙ্গিয়ে দেয়া হোল ক্রুশে।


চারিদিকে তখন মেঘের ঘনঘটা
প্রবল ঝড় বাতাসে সবাই ছুটছে দিকবিদিক,
ততক্ষনে গোর খোদকেরা বিদায় নিয়েছে
শ্মশানে আগুন তখন নিভু নিভু।


শেষকৃত অনুষ্ঠানে আগত শেষ ব্যক্তিটি যখন
বেড়িয়ে পড়ল, কবরস্থানের পাহারাদার গেটে
তালা ঝুলিয়ে বাড়ির পথ ধরল।


আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন সদ্য ভূমিষ্ঠ
কবিতাটিকে বাঁচাতে পারলাম না,
নিজের সন্তানের মত বুকে জাপটে ধরে
ছুটে এসেছিলাম এই মহাঅন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়।


ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে
বন্ধ গেটে হেলান দিয়ে আমি যখন শোকে পাথর,
এক পশলা বৃষ্টি এসে আমার লেখা কবিতা খানি
ধুয়ে মুছে দিয়ে গেল।


আর আমরা কবিতার খাতা শূন্যই পড়ে রইল।



                   গায়ের ছবি আর মূর্খ এক কবি !!


ঘুংগুর শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায়,
নেংটো শিশুটির হামাগুড়ি ধীর পায়।  
কলসি কাঁখে দেখ গায়ের ঐ বধু যায়,
কিশোরী-বালিকা টক-ঝাল আম খায়।  
দুরন্ত বালকের লাড্ডুর ঘুরপাক,
ঘুড্ডির মারপ্যাচে কে জেতে দেখা যাক।

ক্লান্ত কৃষকের তরু ছায়ায় বিশ্রাম,
গায়ের শেষ বাঁকে তাহাদের আশ্রম।
গোধূলির ধুলো ওড়ে মাঠের শেষ প্রান্তে,
রাখাল বালক তবু ঘুমায় শ্রান্তে।
মন্দিরে মন্দিরে আরধনা সঙ্গীত,
যাত্রার বিবেকের স্পন্দিত লোকগীত।


রুগ্ন গরুটাই গোয়ালিনীর ভাগ্য,  
শত ছেড়া জালটাতেই কর্ম-যজ্ঞ।  
একটা বস্ত্রেই আবৃত যৌবন,  
গায়ের যুবকের নেইকোন বিনোদন।
সিঁদকাটা চোরেদের গায়ে গায়ে উৎপাত,
সবটাই মেঠো পথ নেই কোন ফুটপাত।


ভেসে যায় বন্যায় কৃষকের পাকা ধান,
নেই কোন উৎসব আনন্দের জয় গান।
বাজারেতে আগুন লাগে সংসারে ঘাটতি,  
একমুঠ চাল নেই গোলাতে বাড়তি।
ইঁদুরের উৎপাত, ফোটে ফুল কাঁচা বাঁশে,  
ভাগ্যের চাকা ঘোরে মহাজনের পাতা ফাঁসে।


জননী জায়া আর পুত্র-কন্যা,
অভাবে থাকলেও অখুশি কেউ হয় না।  
ঘরেতে তেল নেই, কুপিবাতি জ্বলে না,
শিশুদের আবদারে মা রা’ করে না।  
বাবার বুকে জমে অস্ফুট হাহাকার,
আমি বেটা মূর্খ-ফালতু ছড়াকার।


                এক থেকে পাঁচ।


একলা পথিক আপন পথে,
                 একলাই রইল বিদায়ী রথে।
দু’জন দুজনার মিলন মেলায়,
                 উজান ভাটির প্রেমের ভেলায়।
ত্রিভুবনের স্বর্গ নরক মর্তে,
                 বিশ্বাস মিলায় নিরাথক তর্কে।
চতুষ্কোণের ইট পাথরের দেয়ালে,
                 ব্র্যাকেটবন্ধী জীবন ছেড়ে বেখেয়ালে।
পঞ্চভুতের তাণ্ডব নৃত্যের কাঁপনে,
                 বালির বাঁধে জোয়ার আসে স্বপনে।


         অগ্রজ কবিদেরকে-


সিগ্রেট ফুঁকিতেছেন বসিয়া জানালার পাশে,
মুদিয়াছেন চক্ষু  গেলাসে চুমুকের আশে।    
ভবের কথা, ভাবের কথা হবে বিনিময়,
মনের কথা বলিবেন খুলিয়া, মনে যা তাদের লয়।  


খানিক পরে হইবে যখন স্বপ্ন গোলাপি,
যুক্তি তর্কে সবাই তখন উচ্চ আলাপি।
আমি তখন কবিতার খাতা যেইনা খুলতে যাই,
বড় বড় কবিরা সব তুলতে থাকেন হাই।


মনের কথা মনের খাতায় তাইত পরে রয়,
জমে থাকা কষ্ট টুকু অশ্রু ধারায় বয়।
তবে কি ভাই আমার লেখা শ্রুতিমধুর নয়?
নতুন তবে লিখব কেন এমন যদিই হয়?  


              বন্ধু আমার।


দূর প্রবাসে বন্ধু তুমি, রইলা কোথায় গিয়া,
দেশে আসো, গাঁয়ে যাব তোমায় সাথে নিয়া।
ঘর পালিয়ে যখন তখন যেতাম স্টিমারঘাটে,
জড় হতাম বন্ধুরা সব আগৈলঝাড়ার হাটে।    
বিকেল হলেই চলে যেতাম কানা-কাসেমের গলি,
থাকুক ওসব এখন তবে ডিটেইলস না হয় বলি।
তুমি ছিলে ভাজা চালের অনেক বেশি ভক্ত,
আমার তো ভাই হজম করা হত ভারি শক্ত।  


একটু হলেই লেগে যেত কাদা ছোড়া-ছুড়ি,
তবুও সবাই বলত মোদের দুষ্ট মানিক-জুড়ি।  
তোমার মায়ের কাছে ছিলাম ভীষণ বিশ্বস্ত,
সাথে আছি জেনে তিনি হতেন আশ্বস্ত।
তোমার বাবার হুংকারে ভয়ে কাঁপা-কাঁপি,
সামলে দেবার জন্যে তুমি করতে চাপা-চাপি!
ঠাট্টা তামশা ঝগড়া বিবাদ নিত্য দিনই হত,
সবই আবার মিটিয়ে নিতাম যখন দিবাগত।


মধুময় সব স্মৃতি গুলো জমাট বেঁধে আছে,
আসোনা ভাই ফিরে আবার বাংলা মায়ের কাছে।  
বড়ই যে ভাই ইচ্ছে করে সেরাল গাঁয়ে যেতে,
লিকার চা আর চালের ভাজা তোমার সাথে খেতে।
কোথায় আছো কেমন আছো কোন খবর নাই,
মনটা ব্যাকুল ক্যামনে আবার তোমায় কাছে পাই।
যেখানেই ভাই থাকনা কেন ভাল তুমি থেকো,  
ভুলনা বন্ধু এই অধমেরে একটু মনে রেখো ।।  


                        দোলা।।


আমাদের বাড়িটা হবে পাহাড়ের কোলে,
যেখানে গুচ্ছাকারে বন ফুলেরা দোলে।  
বাড়ির সামনের রাস্তাটা খুব প্রশস্ত নয়,
গাড়ি নয়, যাতে শুধু পায়েচলা পথ হয়।  
পিছনটাতে সুইমিংপুলে সাঁতার কাটা নয়
ইটপাথরের দেয়াল? সেটা বেমানানই হয়।  
থাকবে শুধু খোঁদাই করা মেহগনি কাঠ,
আর থাকবে শান বাঁধানো ছোট্ট একটা ঘাট।


বাড়ির পিছনে থাকবে কিছু নারিকেল গাছের সারি,
শালিক খোঁজে খেজুর গাছে শীতের দিনে হাঁড়ি।
দীঘির জলে জটলা বাঁধে পুঁটি পাবদা আর কৈ,
খড়ের গাদায় হেলান দেয়া বাঁশের একটা মই।
তালের পাতায় বাবুই পাখির আপন আপন বাসা,
ঘরের ছাদে চরুইপাখির নিত্য যাওয়া-আসা।  


বাড়ির গেটে বিশাল কোন লোহার শিকল নয়,
মাধবীলতার শাখায় কেমন শীতল হাওয়া বয়।
থাকবে না সীমানা প্রাচীরে কোন চৌকিদার,  
বুক উঁচিয়ে বেড়ে ওঠা কাঁটার ঝোপ-ঝাড়।    
উত্তরে হিজল তমাল আর কাশফুলের বন,      
বাঁশের ছাউনির নিচে শুধু আমরা দু’জন।  
দখিনা দুয়ার রবে দিন রাত্রি খোলা,  
বাড়ির নামফলকে খোঁদাই করা ‘দোলা’।