আমাকে নাস্তিক বলতে চায় তারা, কারণ আমি তার তীর্থে
তার দেবতায় বিশ্বাস করিনা। করি না, তাতে কী তার কোন ক্ষতি হয়?
কি সে তার এত ভয়! কি সে এত শংকা, বাজে ডঙ্কা মনে সারাক্ষণ!
তার দেবতা শুয়ে থাকতে জানে না, কালান্তরে উপবিস্ট আছে, থাকে
যে দেবালয় গড়েছে সে, যে উঁচু আসন পেতেছে সে দেবের জন্য, তাতে।
তার দেবতা ভাষাহীন হয়ে থাকে, যদিও তারা অনবরত কথা বলে;
কী বলে নিজেও ঠিক জানে না, কথা বলে সব বিষয়ে, এত বিষয়
দেবতারও মনে থাকে না; যদিও তারা তার নামেই সব করে, বলে।
গাছ থেকে পাতা ঝরে, তারা বলে দেবতার ক্রোধে আজ তার এই দশা,
দেবতা বলেছে, ‌‌‌‘‘মঙ্গল পথে চল’’, তারা ধরে সঙ্গীন উঁচু করে,
বলে ‘‘দেবতা মানে না! কে আছ এমন ঘরে?
বেরিয়ে আসো, না হয় আমরা যাবো, তোমাকে কোপাবো।’’


দেবালয় থেকে জনা কয় লোক বেরিয়ে এসেছে পথে, তার কোপানলে
আজকে হবে বলী, বহুদিন হলো তার নামে কিছু লোকজন খেলে হোলি।
শ্যামলীর ছোট বাসা, গোটাকয় কক্ষ আর জনাচারেকের ঘেরাটোপ;
কবির নিজস্ব খোপ, আসবাব আছে মধ্যবিত্ত, পড়ার টেবিল-ল্যাম্প,
সামনে রাখা আধখোলা পাতা, আর আছে ফাউন্টেন পেন।
সারাঘর বই ময়, আলমারীগুলো, বুকশেল্ফগুলো, অতটা ধূসরিত নয়,
যতটা ধুলো জমে থাকে মাথার ভিতরে, দেবতার প্যাঁটরাতে।
কবি বলেছেন, ‘‘যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলে, স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে,
অসাম্প্রদায়িক চিন্তা করে এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, তারা নাস্তিক।
আর যারা এসবের পক্ষে বলে তারা হচ্ছে আস্তিক, সাচ্চা বিশ্বাসী।’’
কাঁপা কাঁপা গলা, শীর্ণদেহ, চোখ ভর্তি আলো, ভাষায় তার শিশুর সরলতা,
বিশ্বাসের ঘর লখিন্দরের বাসরের চেয়েও নিশ্ছিদ্র-অনড়, অবিচল, ক্ষুরধার।


২.


যেদিন থেকে কালো চশমায় সূর্য্যটা ঢেকে গেলো, মুজিব কোটের বদলে
চালু হলো কাবলী, যেদিন জয় বাংলা নিভিয়ে দিয়ে জ্বালানো হলো
জিন্দাবাদের মশাল, বাংলাদেশ নিষিদ্ধ হলো, ভেসে গেলো খালের জলে;
কবি পরিপাটি ঋদ্ধ স্বরে বলেন, শূকরের চীৎকারে ভরে উঠলো কান,
সারা দেশটা হয়ে উঠল এ্যানিমেল ফার্ম, রাস্তায় রাস্তায় জলপাই রঙ্গের
সাঁজোয়া যান, ঘোড়সওয়ারী ঢাকাবাসীর চিরায়ত অভ্যাস তাবৎ পাল্টে
অশ্বক্ষুরের বদলে রাজপথ বিদ্ধ হলো বুটের খট খট শব্দে, ছড়িয়ে পড়লো
রাজধানী থেকে জেলায় জেলায়, আরো দেহাতী শহরে, বন্দরে
মানুষের হাতে পতাকার বদলে উঠে এলো কালাশনিকভ আর চীনা কুঠার
তাজউদ্দীন, নজরুল, হেনা বা ক্যাপ্টেন ছাপিয়ে উঠল
অধৈর্য্য সবুর, যাদু ধন, এ কালের শাহ বা গোলামরা
যেদিন আমার সোনার বাংলার কপালে তিলক কেটে, তার অধিক সুরে
কান ঝালাপালা করে বাজতে লাগল প্রথম বাংলাদেশ, সেদিন
হঠাৎই বিভ্রম হয়, ভুল স্বপ্নের ভিতর দিয়ে কী কোন ভুল জগতে
প্রবেশ করেছি, জেগে উঠেছি ভুল সময়ে, ভুল বুলিতে শিখছি
শুভেচ্ছা আদান-প্রদান। আমাদের ছেলেরা নতুন আদব রপ্ত করছে
বাবা হয়ে উঠছে-আব্বা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা হয়ে উঠছে নারায়ে তাকবীর
সেনাশিবিরে সেনাশিবিরে উল্টো হয়ে ঝুলছে মানুষ, স্বাধীনতার সৈনিক
যারা অস্ত্র হাতে, কলম হাতে, কণ্ঠ নিয়ে, শব্দ নিয়ে লড়াই করেছিল
রাষ্ট্রাচারে তারা অপাংক্তেয় হলো, নিভে গেল মনের ভিতর প্রজ্জ্বলিত
চিরায়ত আলোর মশাল, ভুল মশালে, ডুবে গেল জিন্দবাদের পুনরুত্থানে
বাংলার বোল বাংলার চাল। আমরা হয়ে উঠলাম পাকিমন। আমাদের
বুকের ভিতরে লুক্কায়িত চেতনার সেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গ, শ্বাশত বাংলার
কাল্পনিক অস্ত্রের সন্ধানে ব্যাপৃত সেনাদল, নাকে মুখে উষ্ন পানির ধারা।
কবি বললেন, সেই থেকে আমি পিতৃহারা, নিদারুণ পরিচয়হীনতা
নিজেকে পান্ডুর করে রাখে, ধীরে ধীরে চোখের আলো ম্রিয়মান,
শব্দের শৌর্য্য ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসে, চারদেয়ালের ভিতরে, স্তম্ভিত বসবাস।
এ যবনিকা সহসা আর ওঠেনা। কবি সেঁধিয়ে যেতে থাকেন ক্রমশঃ
শব্দহীনতার ভিতরে।এক জলপাই রঙের সকাল আসে,
সব জলপাই আচার হলে, মৌসুম শেষে বাধ্যতামূলক পতন, আবার
জেগে ওঠে নতুন জলপাই, খেজুরের স্বাদ মাখা গায়ে মাথায় ক্রমশঃ জলপাই
আর সদ্য গজিয়ে ওঠা বাইশ সেট চুড়ি বা গয়নার ভিতরে
আটকে পড়ে ঢাকা।কবি তখন নিজস্ব একান্ত কলমটি নিয়ে শান্ত-ক্লান্ত পায়ে
ফিরে আসেন ঘরে, প্রিয়তমার কাছে; যেন তিনি সেই পুরাতন শিশু
নরসিংদীর কোন দেহাতী পুকুরের পাশে বসে, ঝিরঝিরে বাতাসে,
সকল যুদ্ধক্লান্তিকে একপাশে আলেগোছে জমিয়ে রেখে লিখছেনঃ
‘‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?/আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?’’


৩.


বয়সের ভারে, রোগের অত্যাচারে, ক্ষীণ হয়ে আসা দৃষ্টিশক্তির নিরন্তর
অসহযোগিতা তাঁকে করে তোলে গৃহী-নিভৃতচারী, তবু সময়ের প্রয়োজনে
ডাক আসে তাঁর ঘরের বাইরে, যান না তেমন এক, তবে লিখেন
একাধারে। তবুও শৃঙ্খল মুক্তির জন্য, স্বৈরাচারের পতনের জন্য,
সাম্প্রদায়িকতার ধ্বংসের জন্য বা গণতন্ত্রের আহ্বানের জন্য আমরা শুনেছি
কবিকন্ঠের উচ্চারণ, শুনেছি ঘাতকের বিরুদ্ধে সোচ্চার দেশ, তিনি পাশে।
সময়ের প্রতিটি আঘাতের সময় পেয়েছি তাঁর বাড়ানো হাত, আশীর্বাদ;
রাষ্ট্রপক্ষ তাঁকে এবারও, এর আগে যেমন স্থানচ্যুত করেছিল আসন থেকে,
জীবিকা থেকে, এবারও তাঁকে তালিকায় নাম তুলতে হলো
রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে; যুদ্ধাপরাধীর বিরূদ্ধে সোচ্চার দুই ডজন কন্ঠের তিনি একজন।


থেমে থাকেনি তার প্রয়োজন, সারাদেশ থেকে তরুণ আগুনেরা
বার বার কাছে ডাকে তাঁকে, তিনিও সেই জরাগ্রস্ত দেহ নিয়ে ছোটেন
সময়ের ডাকে, আহ্বানে সাড়া দিয়ে, চট্টগ্রাম থেকে দিনাজপুর, খুলনা থেকে…
সিলেটে…সিলেটে? না এ মহাপবিত্র ভূমি তাঁকে মাটি দেয়নি, পা রাখার;
তিনি নাকি ব্লাসফেমার, মুরতাদ-তার মুন্ডু এখন রাষ্ট্র্রের দরকার।
ছুটে এসেছে ঘাতক কাঁটা, ঘোর অন্ধকার, দেবালয় থেকে বাইরে,
পথ খুঁজে ছুটে এসেছে শ্যামল বাংলার শ্যামলীতে, ঘরে, কোপ দিয়ে
খুলে ফেলতে চেয়েছে কব্জি বাহু থেকে, যে বাহু কব্জি  ঘুরিয়ে আ্ঙুল নাড়িয়ে
প্রতিটি কবিতার প্রতিটি ছত্রে তিনি লিখে গেছেন-ঘাতকের দন্ড।
প্রিয়তমা স্ত্রী তার অধেক কাঁটা তুলে নিয়েছেন, হাতে, কাতরাতে
কাতরাতে, তবু ফিরিয়ে দিয়েছেন কোপ, রাষ্ট্র তখন আচ্ছন্ন গভীর ঘুমে;
রাষ্ট্রের ঘুম বড় বেশি প্রয়োজন, কারণ শহীদের রক্ত ঘুমায় না।


জলপাই রং ক্রমশঃ আরো ফিকে হয়, জেগে ওঠে সবুজ-সাদা;
নাপাকি বর্ণ না তো! হতেও পারে-কারো মাথায় সবুজ পাগড়ী চাপানো
কেউ ডুবে থাকে হরেক সাদার সফেদ পোষাক সমুদ্রে, তবু
তার মাঝ থেকেই জেগে ওঠে সময়ের দাবী, স্বাধীনতা তুমি কাঁদছ,
ফেরাবো তোমার চুরি যাওয়া স্বপ্ন, ভেঙ্গে দেব ভুল স্বপ্নের ঢেউ,
ফিরিয়ে দেব ঘাতক কাঁটা, অতল গহীনে দেবালয়ের প্রতিফলনহীন
নিবিড় কালোর কাছে। কবির কাছে এ আমাদের চিরকালীন অঙ্গীকার।


এস, এম, আরশাদ ইমাম//অবিনাশী সময়
১৭ আগষ্ট ২০১৫; সোমবার; ২ ভাদ্র ১৪২২; ঢাকা।


(কবি শামসুর রাহমান শ্রদ্ধাস্পদেষু! দু’বার তাঁর বাসায় সাক্ষতের ও এবার একান্তে আলাপের সযোগ হয়েছিল; তিনি যা বলেছিলেন, তার অনেক কিছুই বলা গেল না; সময় ফুরিয়ে যায় নি। তাঁর প্রয়াণ স্মরণ।)