মুসলমান
দেবীপ্রসাদ মিশ্র
(মূল ভাষা- হিন্দি)
ভাষান্তর : আসাদুজ্জামান


বলা হয়, তারা একটি বিপর্যয়ের মত এসেছিল,
দূষণের মতো ছড়িয়ে পড়ে ছিল,
তারা মহামারীর মত সর্বগ্রাসী ছিল,
আর ব্রাহ্মণরা বলত ,তারা ম্লেচ্ছ ছিল,যবন ছিল
তারা, মুসলমান ছিল ।


তাদের ঘোড়া সিন্ধু পেরিয়ে
‘হিন্দু’ সম্ভাষণে সকলকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে ছিল।


তারা এই সুবিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি মহিমান্বিত নাম দিয়েছিলেন
তারা নদীর নামে একটি সভ্যতার নাম রেখেছিলেন


তারা প্রতিটি গভীর এবং নিরবচ্ছিন্ন নদীর গহনকে
অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন
তারা মুসলমান ছিলেন,

যদিও কবীরের মত  
হিন্দুর ঘরে জন্মগ্রহণ করতেও তাদের কোন আপত্তি ছিল না।


তাদের ঝুলিতে ছিল
রুপকথার থেকেও রোমাঞ্চকর জীবনের আখ্যান ।
পথ চলার গল্প
দিনযাপনের কাহিনী
অসীম মহাবিশ্ব পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন
এবং মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবনের মায়া।


বিরোধী হত্যার রক্ত তাদের হাঁটু রঞ্জিত করেছিল
কিন্তু আপন রক্তের নদীতে
তারা ছিল আবক্ষ নিমজ্জিত,
তাদের মুষ্টিতে ছিল ঘোড়ার লাগাম,
হৃদয় গভীরে ছিল মানব সভ্যতার
রঙিন মানচিত্র  ।
না ,কারো মৃত্যু কিম্বা হত্যার জন্য নয়
তারা ধ্বংসের জন্য যুদ্ধ লড়তেন না।


তারা পারস্য থেকে এসেছিলেন
তারা ইরান থেকে এসেছিলেন
সমরখন্দ, ফরগনা, বোখারা
তুর্কিস্তান থেকে এসেছিলেন ।


তারা বহুদূর থেকে এসেছিলেন …
যদিও তারা পৃথিবীরই একটা অংশ থেকে এসেছিলেন
তারা এসেছিলেন, কারণ তারা আসতে পারতেন।
কারণ তারা মুসলমান ছিলেন


তারা এমন মুসলিম ছিলেন ! ইয়া আল্লাহ !
বিশ্ব মানবতার সাথে তাদের মুখচ্ছবির হুবহু সাদৃশ্য ছিল।


তারা ছিলেন সম্মানিত ও গুরত্বপূর্ণ অভিবাসী
কারণ তাদের বুকে ছিল
উৎপীড়িত বঞ্চিত মানুষের হাহাকারের স্মৃতি ।


তারা আস্তাবলের মাটিতে পিঠ রেখে ঘোড়ার সঙ্গে নিদ্রা যেতেন
তারা পাথর পাহাড় বিচূর্ণ করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতেন।
কারণ তারা মানব-সভ্যতার ইমারৎ নির্মাণের জন্য অত্যাগ্রহী ছিলেন।  


তারা মুসলমান ছিলেন ।


যদি সত্যকে সত্যের মত করে বলা হয়,
তবে সত্যকে সত্যের মত করেই শোনা উচিত।


এখন প্রায়ই এমন হয় ,বুঝতে পারি না
তারা কি সত্যিই মুসলমান ছিল ? নাকি অন্য কেউ।


তারা মুসলমান ছিলেন ।


তারা না থাকলে লক্ষ্ণৌ থাকত না
অর্ধেক এলাহাবাদ থাকত না
খিলান, গম্বুজ থাকত না ,
থাকত না সৌজন্যের আন্তরিক ‘আদাব’


মীর মকদুম ঈমানদার থাকত না
থাকত না জান্নাতের অপরূপা হুরপরীরা


তারা না থাকলে এই উপমহাদেশে-
সুমধুর সঙ্গীতের শ্রোতা ‘খুসরু’ থাকতেন না
তারা না থাকলে গোটা দেশের অস্থিরতায়
উদ্বিগ্ন হবার জন্য ‘কবীর’ থাকতেন না
তারা না থাকলে  ভারতীয় উপমহাদেশের দুর্দশা বর্ণনা করার জন্য
মির্জা গালিবের কালাম থাকত  না,
মুসলমান না থাকলে আঠার’শ সাতান্নর সিপাহী বিদ্রোহ হত না।


তারা ছিল বলে ,হাসান চাচা ছিল
তারা ছিল বলে রঙিন আকাশে স্বপ্নের ঘুড়ি ছিল
তারা মুসলমান ছিল,


তারা মুসলমান ও হিন্দুস্তানী ছিল
এবং তাদের আত্মীয়রা পাকিস্তানেও বাস করত।


তারা ভেবেছিল যে যদি একবার
তারা পাকিস্তানে যেতে পারত
তারা ভেবেছিল এবং ভেবে ভয় পেয়েছিল
তারা ইমরান খানকে দেখে খুশি হয়েছিল,
তারা যতটা খুশি হয়েছিল তার থেকে বেশি সন্ত্রস্ত হয়েছিল ।


তারা ‘পিএসি’র সৈন্যদের দেখে যতটা আতঙ্কিত ছিল
‘শ্রীরাম স্লোগানেও ততটাই ভীত হয়ে ছিল
তারা ‘মোরাদাবাদ’কে ভয় পেত
তারা ‘মিরাট’কে ভয় পেত
তারা ‘ভাগলপুরের’ নাম শুনে কেঁপে উঠত
তারা বড়াই করত তবে ভয়ও করত


তারা পবিত্র(!) বর্ণকে ভয় পেত
তারা মুসলমান হওয়ার জন্য ভয় পেত


তারা ফিলিস্তিনি ছিল না তবু
নিজের ঘরে বসে, ঘর নিয়ে ভয় পেত
দেশের ভিতরে থেকে দেশ নিয়ে ভয় পেত


তারা নিজেদের নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি
তারা নিজেদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ও অসুস্থ হয়েছিল
তারা মুসলমান ছিল


তারা কাপড় বুনত
তারা কাপড় সেলাই করত
তারা তালা ও বাক্স তৈরি করত
তবু ঐ বাক্স ব্যবহার করতে পারত না
তাদের নিরলস শ্রমের গুঞ্জন
শহরের প্রতি কোণে প্রতিধ্বনিত হত
তবু তাদেরকে শহরের বাইরে বাস করতে হত।


তারা মুসলমান ছিল তবু দামেস্ক তাদের শহর ছিল না
তারা মুসলিম ছিল তবু আরবের পেট্রোল তাদের ছিল না
তারা যমজম নয় যমুনার পানি পান করত


তারা মুসলমান ছিল


তারা মুসলমান ছিল বলেই নিজেকে বাচিয়ে চলত
তারা মুসলমান ছিল, তাই তাদের কণ্ঠস্বর দ্বিধান্বিত ছিল
দেশের বেশিরভাগ সংবাদপত্রগুলি বলত-
মুসলমানদের কারণে আমাদের শহরে কার্ফু লাগে
এবং একের পর এক একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে যায়


খবর আসত- তারা নিঃশব্দে
তাদের নারীদের উপর অত্যাচার করে থাকে
আর তাদের শিশুরা ভয়ের দেওয়ালে সেঁটে থাকত
তারা মুসলমান ছিল বলে ,জং পড়া তালার মত
তাদেরকে খোলা যেত না


তারা মুসলমান ছিল,


তারা পাঁচবার নামায পড়ত
যতবার নামাজ পড়ত
তার থেকেও অনেক বেশিবার
তাদের মাথাকে তারা আনত রাখতো


কারণ তারা মুসলমান ছিল।


তারা জানতে চাইত, এই লালকেল্লা নিয়ে আমারা কী করব
তারা জিজ্ঞাসা করত আমরা হুমায়ুনের সমাধিসৌধ নিয়ে কি করব
আমরা ইসলামের ঐতিহ্য বহন কারী ‘কুব্বা –তুল –ইসলাম’
মসজিদকে নিয়ে কি করব


তারা মুসলমান ছিল


তারা দূরে কোথাও চলে যাবার কথা চিন্তা করতো
কিন্তু যেতে পারতো না
তাই ভাবত- এখানেই থেকে যাই
তবু তারা এখানেও থাকতে পারত না
তারা অর্ধজীবিত বক্রীর মত বেদনা বোধ করত


কারণ তারা মুসলমান ছিল
ঝঞ্ঝা কবলিত জাহাজের যাত্রীদের মতো
তারা একে অপরের সাথে বিতর্ক করত


কিছু লোক আলোচনা করেছিল যে,
এদেরকে যদি নিক্ষেপ করা হয়,তবে
কোন সমুদ্রে নিক্ষেপ করা যাবে,
বিতর্ক হচ্ছিল যে,
তাদেরকে যদি ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়
তবে কোন পর্বত থেকে ফেলে দেওয়া যথাযথ হবে


তারা মুসলমান ছিল, পিঁপড়ে ছিল না
তারা মুসলমান ছিল মুরগী ছিল না


সাবধান!
ওই মহাসিন্ধুর দক্ষিণে-
শত বছরের নাগরিকতার পরেও
তারা মোটেই একখণ্ড কাদামাটির টুকরো নয়


তারা পাথর ও পশমের মতো সত্য
তারা সিন্ধু ও হিন্দুকুশ পর্বতের মতো সত্য ।


সত্যকে যেভাবেই বোঝানো হোক না কেন
তা সমস্তভাবেই ভাবেই সত্য হয়ে থাকে  ,
তারা ছিল সভ্যতার অমোঘ নিয়তির মত সত্য ।
আর এই সত্য কোন অলীক জনশ্রুতি নয়--
তারা মুসলমান ছিল
তারা মুসলমান ছিল
তারা মুসলমান ছিল
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(অনুবাদকের ঠিকানাঃ পুটুরিয়া,গোলাবাড়ি বাজার। উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ ,ভারত)