মানুষের মনের ক্ষুধা মিটতে পারে সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে। আর সাহিত্য এমন একটি মাধ্যম যা মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতাকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা রাখে। কোনো একটি সভ্যতার ইতিহাস বেঁচে থাকে সমকালীন সাহিত্যের মাধ্যমে। যে সাহিত্য যতো সমৃদ্ধ, সেই সভ্যতার ইতিহাস ততো সমৃদ্ধ হয়। সাহিত্য চর্চা ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ মানুষের মধ্যে মানবিক ও সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। সাহিত্য মানুষের অপ্রকাশিত ও পুঞ্জিভূত ভাবনাকে বিকশিত করে। ফলে উদার ভাবনা সৃষ্টিশীল মনোভাব গড়ে তোলে। যেখানে অসত্য সত্যের কাছে পরাজিত হয়, মানুষ স্বপ্ন দেখতে শিখে, স্বপ্ন দেখাতে শেখায় আর বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সাহিত্যের শক্তিতেই মানুষ বিবেক তাড়িত হয়ে যৌক্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে অনুপ্রাণিত হয়। আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সাহিত্যের স্বরূপ সন্ধান করতে গিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন যা থেকে সাহিত্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় দর্শন, প্রগতি ও মানুষের জীবনসম্পৃক্ত বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। সাহিত্যচর্চা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে চেতনা ও মূল্যবোধ তৈরি করে। সাহিত্যের মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে, যা শুভবোধের বিকাশ ঘটায় এবং মানুষের মধ্যে অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করে। এখানে প্রশ্ন থাকতে পারে যারা লেখক, কবি, চিত্রশিল্পী, গায়ক, অভিনেতা তারাই কি শুধু তাদের কাজের মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা করে নাকি বিষয়টি আরও গভীরও বিশ্লেষণধর্মী। প্রকৃত অর্থে যিনি লিখেন, যিনি অভিনয় করেন, যিনি ছবি আঁকেন তারাই শুধু সাহিত্য চর্চা করেন না বরং যারা লেখকদের লেখা পড়েন, যারা অভিনেতাদের নাটক দেখেন ও যারা চিত্রকরের ছবি দেখেন তারাও একইভাবে সাহিত্য ধারণ ও লালন করে এর চর্চার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করেন। কারণ সাহিত্যের উপাদানগুলো সাহিত্যিকের হতে পারে কিন্তু এই উপকরণগুলো যদি সাধারণ মানুষ গ্রহণ না করতো তবে সাহিত্যের বিকাশ হতো না। কাজেই যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন, তাদের লেখার প্রণোদনা ও উৎসাহ আসে পাঠকদের কাছ থেকে। আবার অন্যদিকে পাঠকরা সাহিত্যের ভিতরে প্রবেশ করে তাদের জ্ঞানের বিকাশ ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সমর্থ হয়। অনেক সময় আমরা কোন একটি সাহিত্যের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে পাঠকের মনোভাব জানতে পারি। এটি যেখানে প্রচলিত সেখানে যুক্তিবাদী ও দার্শনিক চিন্তাধারার মানুষ গড়ে উঠে। যখন সাহিত্যের নেতিবাচক কোন একটি বিষয়কে তুলে ধরে সাহিত্য সমালোচকরা এর সীমাবদ্ধতা ও তা থেকে কিভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়-এই বিষয়গুলো তুলে ধরে তখন সাহিত্যের পরিবর্তন ও উৎকর্ষ সাধনার ভাবনালব্ধ পরামর্শ পাওয়া যায়। আর যে সমাজ বা রাষ্ট্রে সাহিত্য সমালোচক যত বেশি হবে সেই রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ততো বেশি ফলপ্রসূ হবে। এখানে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, মানবিক উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। যেমন অমর্ত্য সেনের মতে মানবিক প্রগতি ছাড়া অর্থনৈতিক প্রগতি অর্জন কঠিন। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ দুটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, আবার কখনও তা নান্দনিকও হতে পারে। তবে উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে মানবিক প্রগতির বিষয়টি বিবেচনায় না নিলে থেমে যেতে পারে অর্থনৈতিক অগ্রগতি।এই মানবিক প্রগতি কেবলমাত্র সাহিত্যের মাধ্যমেই সম্ভব। সেই সঙ্গে সাহিত্যের প্রতি সাধারণ মানুষদের অনুরাগী করে কিভাবে আরও বেশি সাহিত্য সমালোচক তৈরি করা যায় সে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। তবে সাহিত্য সমালোচনা যাতে ব্যক্তি কেন্দ্রিক সমালোচনায় পরিণত না হয় সেই বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। আবার সাহিত্য সমালোচকদের সাহিত্যের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়েও ভাবতে হবে। একজন লেখক কোন একটি সমালোচনায় সাময়িকভাবে আহত হতে পারেন, কিন্তু কোন এক সময় লেখক সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গিকে যথার্থ বলে মেনে নেন। বুদ্ধদেব বসু সমালোচনার বিষয়টিকে পুরোহিতের পূজার মতো মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। বুদ্ধদেব বসু বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের যে সমালোচনা করেছেন, তাঁর পরে কবিগুরু বলেছিলেন, ‘শেষ অংশে যে মন্তব্য দিয়েছে তা পড়ে খুব খুশি হয়েছি। চোখের বালি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তার সমাপ্তিটা নিয়ে আমি মনে মনে অনুসূচনায় ভুগছি, নিন্দার দ্বারা তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া উচিত।’ আবার অন্যদিকে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে সে সময় অনেক বিরূপ সমালোচনা হয়েছে আর এর বিরুদ্ধে প্যারোডিও রচিত হয়েছে। অথচ কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখন এই কবিতাটি পৃথিবীর সবচেয়ে বহুল পঠিত এবং বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে বিবেচিত হয়েছে। এখানে সময়ের বিবর্তন কবিতাটিকে সাহিত্যের মূল্য দিয়ে মূল্যায়ন করেছে। পাশ্চাত্য সাহিত্য সমালোচক হোরেস তরুণদের লেখা প্রকাশের জন্য ব্যতিব্যস্ত না হয়ে প্রকৃত শিল্প সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগের জন্য উপদেশ দিয়েছেন। কাব্যকে খামখেয়ালি বা পাগলামি বলে মনে করেননি হোরেস। তিনি শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে পরিমিত ও সামঞ্জস্যের ওপর গুরুত্ব দেন। হোরেস মনে করতেন সকলের মধ্যে একই ধারার শিল্প বা সাহিত্যকর্মের প্রতিভা থাকবে এটি সঠিক নয়, যার যে ধাঁচের শিল্প ধারার সামর্থ্য বা সম্ভাবনা বেশি তার সেই দিকটাই বেছে নেয়া উচিত। তার তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান উপাদান ছিল কবি ও সাহিত্যিকরা তাদের ভাষা প্রয়োগ ও শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন ধারণা সৃষ্টি করবে, যা একে অন্য থেকে ভিন্ন হবে আর এই ভিন্নতার আস্বাদন মানুষের মধ্যে ভাবনা বৈচিত্র সৃষ্টি করবে। সাহিত্য সমালোচক লঙ্গিনাস সাহিত্যে সাবলিমিটি ধারণার প্রবক্তা। তিনি বিশ্বাস করতেন, যিনি মানুষ হিসেবে মহৎ ও উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী শুধুমাত্র তার পক্ষেই উচ্চস্তরের সৃজনশীল সাহিত্য রচনা সম্ভব। কারণ তার মতে উৎকৃষ্ট রচনা হলো মহৎ চিত্তের প্রতিধ্বনি। সাবলাইম কথাটি দিয়ে তিনি যে মহিমান্বিত সাহিত্যকে বুঝিয়েছেন সে সাহিত্য পাঠককে এমনভাবে অনুপ্রাণিত করবে যা একবার পড়েই পাঠকের তৃপ্তি মিটবে না, যতবারই পড়বে ততবারই তাদের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হবে। এই ধরনের বিশ্লেষণগুলো প্রমাণ করে সাহিত্য সমালোচনার কারণেই সাহিত্য সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। ফলে একজন পাঠক সাহিত্যের আদি রূপ থেকে বর্তমান রূপ পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। যার মাধ্যমে সে প্রাচীনতম সাহিত্য থেকে ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ ভবিষ্যতকে বাস্তববাদী জীবন ধারায় সম্পৃক্ত করতে পারে। আমরা জ্ঞান, মেধা, দর্শন, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও উন্নয়নভিত্তিক সমাজের কথা বলি কিন্তু সাহিত্য চর্চাভিত্তিক সমাজের কথা খুব একটা বলি না। কিন্তু জ্ঞানভিত্তিক সমাজের ভিত্তি গড়ে উঠতে পারে সাহিত্য চর্চাভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে। আর সাহিত্যকে পরিশীলিত সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করে সমাজকে যেভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব সেটি আর অন্য কোনভাবেই সম্ভব নয়। ইতিহাস সৃষ্টি করেন শিল্পী, সাহিত্যিক ও কবিরা। মারণাস্ত্রের চেয়ে কলম যে অনেক শক্তিশালী তা সাহিত্যের বহুমাত্রিক রূপের মাধ্যমেই তা প্রকাশিত হয় ও লক্ষ্যের পথে সাফল্য অর্জন করে। তাই সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির চিত্রকর্মের চিন্তা থেকে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রাইবোলোজি’ নামে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন, বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনের ‘সুলতানার স্বপ্ন’, উঁচুমানের ফরাসি সাহিত্যের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব ও তা থেকে উত্তরণ, নূর হোসেনের ‘গণতন্ত্রমুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ রক্তে রঞ্জিত সাহিত্য ধারণ আর বঙ্গবন্ধুর সাহিত্যে উজ্জীবিত স্বাধীনতার আন্দোলন ও মহা কাব্যিক উচ্চারণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’- সব কিছুর মধ্যেই মহাসত্যের স্বরূপটি সাহিত্যের মাধ্যমে সভ্যতাকে অগ্রসর হতে সহায়তা করে। আর এটিই সাহিত্যের শক্তি, যার ইতিহাস মানুষ নিজ হাতে গড়ে।