এক : একদিন ঘুম থেকে  সকালে উঠে আমি নিজেকে চিনতে পারছিলাম না | নিজের নামটাও মনে করতে পারছিলাম না | আমার আশে পাশে যারা ছিল তাদের আমি চিনেছিলাম কিন্তু তারা কেউ আমাকে চিনতে পায়নি | শুনেছি সেদিন আমার ছবিসহ সংবাদপত্রগুলোতে খবর  এসেছিলো | মুখটা নাকি বিকৃত ছিল | সবাই আমার বিকৃত মুখটা দেখে চিনতে না পারলেও আমি সেদিন বিকৃত মানুষদের মনটা চিনেছিলাম | যাদের কারণে আমি খবর হয়েছিলাম | এখন আমি কোথায় আমি নিজেও জানিনা তবে তারা পাপের ফল ভোগ করছে | কিন্তু তারা নিজেরাও তা জানেনা তাদের শাস্তি শুরু হয়েছে শুধু একজন ছাড়া.......| ঐ একজনটা কে  সেটা বোঝার জন্য আমি গবেষণা শুরু করেছি | কোনো ল্যাবরেটরি পাইনি কিন্তু এমন একটা জায়গা পেয়েছি যার কোনো সীমা নেই |


দুই : লোকটা সারাজীবন চুরি করেছিল | চুরির টাকায় ছেলে মেয়েদের বিদেশে পড়িয়েছিলো | যেদিন ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেষ হলো সেদিন তারা বিদেশেই রোড একসিডেন্টে মারা গেলো | তাদের মৃত্যুটা এমন হলো যে তাদের লাশগুলো সনাক্ত করা গেলোনা | লোকটা খবরটা  শুনেই তার অতীতকে  দেখতে পেলো | মনটা তার আহত হলেও দেহটা নিহত হলোনা | শুনেছি  লোকটা তার চুরির টাকাগুলো নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে | কিন্তু যাদের টাকা  খেয়েছিলো তাদের আর খুঁজে পায়নি | অনেককে সে অভিশপ্ত টাকাগুলো দিতে চাইলেও কেউ নেয়নি | লোকটা এখন  নিজের মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে | টাকাগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেললেও মৃত্যু এখনও  তাকে ধরা দেয়নি | কোথা থেকে যেন খবর এলো ছেলে মেয়েরাও নাকি তাদের মৃত্যুর জন্য তাদের বাবাকে দায়ী করে মামলা করেছে | কিন্তু এখনও মামলার রায় হয়নি |


তিন : একজন দুর্নীতিবাজ লোক মানুষের টাকা চুরি করে অনেক সম্পদ করেছিল | লোকটা ভেবেছিলো তার আগামী প্রজম্মের জন্য চুরি করা টাকাগুলো রেখে যাবে | কিন্তু লোকটা একটার পর একটা বিয়ে করলেও সন্তানের মুখ দেখিনি | কারণ যাদের টাকা সে  খেয়েছিলো তাদের অভিশাপ তাকে লেগেছিলো | লোকটার এখন অনেকগুলো বউ আছে কিন্তু কোনো ছেলে মেয়ে নেই | কিছুদিন আগে জানলাম বউরা দুর্নীতিবাজ লোকটার সব সম্পদ ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে | বউগুলো নতুন সংসার পেতেছে | সেখানে তাদের ছেলে মেয়েও হয়েছে | অনেক সুখী তারা কিন্তু লোকটা এখন পাগলা হয়ে রাস্তায় রাস্তায় একমুঠো খাবারের জন্য ঘুরে মরছে | কিছুদিন আগে শুনলাম লোকটার পাপের জন্য যে সন্তানরা পৃথিবীতে আসতে পারেনি  তারা লোকটার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে | কিন্তু কেন সেটা জানা যাবে লোকটার মৃত্যুর ঠিক পরেই |  


চার : আমার একটা শখের চাদর ছিল | একদিন চাদরটা চুরি হয়ে গেলো | কিন্তু আমার মনটা  খারাপ হলোনা বরং আনন্দে ভরে উঠলো | কারণ আমি জানতাম এতো তীব্র শীতে যে আমার চাদরটা চুরি করেছে তার সেটা প্রয়োজন ছিল | একদিন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম | তখন খুব গরম কিন্তু আমার খুব জ্বর  হয়েছিল  | প্রচন্ড গরমেও আমি শীতে কাঁপছিলাম | সকালে উঠে দেখলাম আমার চুরি হয়ে যাওয়া চাদরটা আমার গায়ে | বুঝলাম লোকটার আর চাদরটার প্রয়োজন নেই | শীত আসলেই এখন আমি চাদরটা বাইরে ফেলে  রাখি  যদি এটি কারো প্রয়োজন হয় | এখন আমার গবেষণার বিষয়বস্তু হলো কোনটা চুরি আর কোনটা প্রয়োজন | গবেষণায় খুব ভালো ফলাফল পেয়েছিলাম কিন্তু গবেষণার ফলাফলগুলোও চুরি হয়ে গেলো | এখন ভাবছি এটা নিয়েই গবেষণা করবো " কিন্তু তার আগে আমি নিজেই চুরি হয়ে গেলাম | আমি জানিনা আমি কোথায় আছি কিন্তু সবাই জানে |


পাঁচ : দুজন মানুষ ছিল | একজন মনে করতো জীবনকে চালিয়ে নেবার জন্য বেশি টাকার প্রয়োজন নেই আর আরেকজন ভাবতো ঠিক তার উল্টো | দুজন একদিন হঠাৎ করে মারা গেলো | যে মানুষ টাকাকে বেশি গুরুত্ব দিতোনা তার ছেলে মেয়ে দুটি কষ্ট করে অনেক বড়ো মাপের মানুষ হলো | কারণ তারা দেখেছিলো তার বাবা কষ্ট করে বড় হয়েছিল আর লেখাপড়াকে গুরুত্ব দিতো | আর আরেকজন মানুষ ১০০ কোটি টাকা রেখে গেলো | তার ছেলে মেয়েরা প্রথমেই পড়াশুনা বাদ দিলো, ইয়ার বন্ধুদের সাথে ফুর্তি করে টাকা পয়সা উড়িয়ে অল্পদিনের মধ্যে সব হারালো | শেষে পথের ফকির হয়ে  গেলো |


ছয় : একদেশে এক রাজা ছিল। রাজার খুব শখ হল সে কবিতা লিখবে। রাজা শুধু ভাবে আর ভাবে কিন্তু কবিতা কি নিয়ে লিখবে ভেবেপায়না। অবশেষে রাজা রানীর কাছে গেলো। রানীর কাছে গিয়ে বললো আমি কিনিয়ে কবিতা লিখতে পারি। রানী বললো আমাকে নিয়ে কবিতা লিখো। রাজা রানীর কোন বিষয় নিয়ে কবিতা লিখবে তা ভেবে কুল কিনারা পেলোনা। রাজা ভাবছে আর ভাবছে। কিন্তু কোনো শব্দই লিখতে পারছেনা। রাজা আবার রানীকে গিয়ে বললো আমি তোমার কোন বিষয় নিয়ে লিখবো।রানী বললো, আমার রূপের বর্ণনা নিয়ে লিখো। রাজা আবার ভাবতে শুরু করলো রানীর রূপের কোন বিষয় নিয়ে লিখবে।
রাজা ভেবে ভেবে আর কোনো উত্তর খুঁজে পায়না। রাজা আবার রানীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো তোমার রূপের কোন বিষয় নিয়ে আমি লিখতে পারি? রানী বললো আমার চেহারের বর্ণনা দিয়ে কবিতা লিখতে পারো। রাজা আবার চিন্তায় পড়ে গেলো রানীর ভিতরের চেহারা নিয়ে লিখবে নাকি বাইরের চেহারা নিয়ে লিখবে। কারণ রাজা জানতো রানী তার অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য ভিতরে ভিতরে অহংকারী হয়ে উঠেছিল। আবার বাইরের চেহারার কোন বিষয় নিয়ে লিখবে তা ভেবে ভেবে রাতদিন কেটে গেলো। মাস শেষে বছর গেলো। বছর শেষে যুগ গেলো। এরপর দুই যুগ কেটে গেলো কিন্তু রাজা একটা শব্দও লিখতে পারলো না। রানী ইতিমধ্যে বুড়িয়ে গেলো। রূপ লাবণ্য হারালো। একদিন হঠাৎ করে সে রাজাকে জিজ্ঞাসা করলো আমাকে নিয়ে কবিতাটা কি লিখেছো? রাজা বললেন, না। রানী বললেন, তবে আর লেখার দরকার নেই। কারণ রানী জানে এখন সে বয়সের কারণে রূপ লাবণ্য হারিয়েছে। কাজেই এখন রাজা তাকে নিয়ে যদি কোনো কবিতা লিখে সেটা ভালো হবে না। রাজা খুশি হলো এই ভেবে যে বয়সের কারণে রানীর বাইরের সৌন্দর্য কমে গেলেও তার ভিতরের চেহারায় যে অহংকার ছিল তা আর নেই। রাজা ভাবলো কবিতা লিখতে চাইলেও লিখা যায় না। রাজা হওয়া সহজ কিন্তু কবি হওয়া কঠিন।অবশেষে রাজা কবিতা লিখার চিন্তা বাদ দিয়ে রাজ্য শাসনে মন দিলেন।


সাত : সখিনার প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল একই গ্রামের রুবেল মিয়ার সাথে | রুবেল মিয়া বাউন্ডুলে ধরণের একজন মানুষ | অন্তঃসত্বা সখিনাকে ছেড়ে সে একদিন পালিয়ে গেলো | অসহায় সখিনার জীর্ণ ঘরে এলো রাজকন্যার মতো ফুটফুটে একটি মেয়ে | গ্রাম ছেড়ে সন্তানকে কোলে নিয়ে ভাগ্যের অন্বেষণে  সখিনা ছুটলো রাজধানী  শহর ঢাকায় | একটা বস্তিতে আশ্রয় নিলো সে | কাজ খুঁজতে  গিয়ে খারাপ প্রস্তাব এলো তার কাছে | ছেঁড়া আঁচলে সে নরপশুদের লোলুপ দৃষ্টি  থেকে নিজেকে রক্ষা করার  চেষ্টা করতে লাগলো | আর বেঁচে থাকার জন্য ক্ষুধার যন্ত্রনা তাকে তাড়িত করছিলো | তার উপর তার সন্তানের আর্তনাদ | একদিন সে বিবেক শুন্য  হয়ে তার সন্তান কে বিক্রি করে দিলো | কোনো ব্যথা অনুভব করলোনা সে | নুতন করে ভাগ্য গড়ার নেশায় সে বিয়ে করলো বস্তির করিম মাতব্বরকে | একদিন সেও  সখিনাকে  অন্তঃসত্বা রেখে বস্তির আরেক মেয়েকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হলো | সখিনার ঘরে আরেক মেয়ে জন্ম নিলো | একদিন সে তাকে বিক্রি করে দিলো | কিন্তু কোনো ধরনের অনুভূতি তার মধ্যে কাজ করল না | আবার ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে সে বিয়ে করলো বস্তির রজব বেপারীকে | খুব চতুর  ছিল রজব বেপারী | সে কক্সবাজারে ঘুরতে নিয়ে গিয়ে এবার সখিনাকে বিক্রি করে দিলো নর পশুদের হাতে | তারপর শুধু অন্ধকারের গল্প | আর তার মেয়ে দুটি এরাও কি অন্ধকার জগতে হারিয়ে যাবে | বিবেককে প্রশ্ন করুন | উত্তরটা খুব কঠিন | এখানে দোষীদের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া  কঠিন কে আসল অপরাধী |


আট:  সামনে ঈদ। খুব আনন্দের একটি দিন আসছে। সবখানে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। কবির ও রেহেনার সুখের সংসার। আর তাদের আদরের ছোট ছোট দুই পুত্র সন্তান। কবির সরকারি চাকুরীজীবি। হাতে বোনাস পেয়ে মা, বাবা, ভাই, বোন, শ্বশুর, শাশুড়ী সবার জন্য পরিবারের সবাই মিলে ঢাকার মার্কেট গুলোতে খুব কেনাকাটা করলো। ছেলেদের আবদার তারা দাদা নানা বাড়িতে গিয়েই ঈদ করবে। দেশের দক্ষিনাঞ্চলে বাড়ি ছিল তাদের। উত্তাল পদ্মা নদী পার হয়ে তাদের গন্তব্যে তাদের যেতে হতো। ঈদে বাড়ি যাবার দুর্নিবার নাড়ির আকর্ষণে বাড়তি মানুষের চাপ নিয়ে লঞ্চে উঠলো তারা। এক সময় গ্রামের বাড়িতে পৌছালো। আত্মীয় স্বজনের সাথে মিলিত হয়ে তারা খুব আনন্দিত হলো। নগর জীবনের কোলাহল থেকে তারা যেন পরম শান্তির পরশ পেলো। কিন্তু আনন্দের দিনগুলি যেন খুব দ্রুত চলে যায়। এবার গ্রাম থেকে আবার ঢাকায় ফেরার পালা। সবার চোখ মুখ ছলছল করে উঠলো। কিন্তু যেতে তো হবেই। সীমার অতিরিক্ত চাপ নিয়ে লঞ্চ যাত্রা শুরু করলো। সময় ছিল পদ্মার পার। শেষ সময়ে এসে লঞ্চটি ডুবে যেতে লাগলো। দুই ছেলেকে দুই হাতে শক্ত করে ধরলো কবির। চোখের সামনে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ডুবে যেতে দেখলো সে। চোখ কান্নায় ঝাপসা হয়ে এলো। সে ও তার দুই হাতের শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ দুই ছেলে নিয়ে ডুবতে লাগলো। বাবার বুক কষ্টে আর্তনাদ করে উঠলো। দুই সন্তানসহ তার মৃত্যুকে সে যেন দেখতে পেলো। কি করবে কবির? সবাই কি লাশ হবে নাকি ছেলেদের ছেড়ে দিয়ে সে তার জীবন বাঁচাবে? ভাবনা আর ভাবনা। ভাবনার শেষ নেই। কিন্তু সময় নেই। সে তার দুই সন্তানের হাত ছেড়ে দিলো। বাবার বুক কষ্টে আর্তনাদ করে উঠলো। দুই সন্তানসহ তার মৃত্যুকে সে যেন দেখতে পেলো। কি করবে কবির ? এখানে কি আমরা কবিরকে হত্যাকারী বলবো। নাকি বলবো যে নিজের জীবনের স্বার্থকে দেখতে গিয়ে তার সন্তানদের লাশ বানিয়েছে ? নাকি সে ভাবছিলো তার এখনো ভরা যৌবন, সন্তান চলে গেলে তার হৃদয় হয়তো দগ্ধ হবে কিন্তু সে আবার নুতন করে জীবন শুরু করতে পারবে? আবার বিয়ে করবে আবার সন্তানের বাবা হবে। উত্তরটা কঠিন। কবির দোষী নাকি এটাই স্বাভাবিক এর উত্তর হয়তো কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেমন খুঁজে পায় যায়নি সেই লঞ্চটি ।