নিশীথ রাত্রে ঊর্ধ্বে আকাশে দেখি হাসিতেছে চাঁদ,
কাব্য-সাগরে জোয়ার লাগিল, ভেঙে গেল সব বাধ!
ও চাঁদ যেতেছে মোর পানে চেয়ে নিরবে কি মোরে ডাকি?
এতকাল ধরে মোরে ফেলে প্রিয়া আকাশে রয়েছে জাগি!
অভিমানী! হেথা ফেলে মোরে সেথা গেলে কোন অভিমানে?
মনের গোপন ব্যথা কি গো বল তারাদের কানে কানে?
কেন বলিলে না সেই ব্যথা মোরে? মোরে জ্ঞান করো ধূলি?
ধূলি নই! ধূলি মাটির মানুষ – যাবে লয়ে মোরে খেলি?
মাটির মানুষ, তাই কাদা-সম নরম আমার এ মন,
পুতুলের সম জ্ঞান করে তাই খেলে যাবে অনুখন?
দেখনি তপ্ত মনের বেদনা, বোঝোনি ক' মোরে আজো,
বুঝেছ নিজের অভিমান, তাই চাঁদ হয়ে বসে আছো!


সুন্দরতম অতুল সুরভিময় ফুল ধরা-বাগে,
হাজার হাজার ভ্রমর ছুটিত মরুর তৃষ্ণা বুকে! –
আসিয়া পড়িত পদতলে, তবু দেখনি ক' কভু চেয়ে,
জানিনে কেন সে কৃপার দৃষ্টি এ অধমে গেল ছুঁয়ে!
সেই ফুল তাই বক্ষে জড়ায়ে রহিতাম নিশিদিন,
বুকের বেদনা-রস শুষে হতে বক্ষের মাঝে লীন।
ফুলের ছোঁয়ায় আমারি হৃদয় হইত অমরাবতী,
বেহেশতী বাতাস বহিত এ হৃদে, ঘুঁচে যেত অমারাতি!
সহসা জীবনে কোথা হতে মোর আসিল ঝঞ্ঝা-ঘাত,
ধরণীর ফুল অভিমানে হল দূর আকাশের চাঁদ!
সে চাঁদ আমার হৃদয় সাগরে দুখের জোয়ার আনে,
জোয়ারের ঢেউ এসে লাগে মোর কাব্য-কবিতা-গানে।
মোর ভাবনার ঘূর্ণি-বাতাস হৃদে দিয়ে যায় দোল,
হৃদয়-সাগর ফুঁসিয়া উঠিয়া ছুঁতে চায় চাঁদ-কোল!
পাখি আমি প্রিয়া উড়ে যেতে চাই দূর আকাশের কোলে,
তব অমৃত প্রেমের পরশ এতটুকু নেব বলে।
এত টানে তবু উড়ে যেতে কভু পারিনে চাঁদের পানে,
ক্লান্ত পাখায় ভর করে শুধু উড়ি নিচে আসমানে।
হৃদয়ের পাখি! উড়িতে নিত্য হৃদয়-সাগর তীরে,
কাটিত আমার সারাবেলা শুধু তোর পানে চেয়ে ফিরে।
কখনো আসিয়া বসিতে আমার বাহুতে কিংবা বুকে,
পরম সোহাগে বুকে চেপে মুখে যাইতাম চুমু এঁকে!
বসন্ত-বাতাস করিত উছাস আমার মনের মাঝে,
হৃদয় কাননে কুহুকুহু তান অবিরত যেত বেজে।
মানস প্রিয়া! মোর হৃদয়ের স্বপ্ন ও সাধ জমে –
মূর্তি ধরিয়া তব রূপে যেন এসেছিল ধরাধামে।
ভরিয়াছিলে গো মোর জীবনের অসীম শূণ্যতাকে,
ঘুঁচেছিল সব ব্যথা যাহা ছিল জীবনের বাঁকে বাঁকে!
স্বর্গ হইতে সুখের বাতাস দোল দিয়ে যেত মনে,
শূন্য জীবন কানায় কানায় পূর্ণ করিলে গানে।
চেয়ে থাকিতাম তৃষিত নয়নে কথা অমৃতের পানে,
কহিতে যখনি কথা, ধরিতাম অঞ্জলি ঠোঁট-কোণে।
কোন অভিমানে গেলে প্রিয়তমা হেথায় ফেলিয়া মোরে?
পুরনো যাতনা অসহ বেদনা হয়ে এল বুকে ফিরে।
অমৃত-পিয়াসী, অমৃত বিনে এ প্রাণ ওষ্ঠাগত,
শূণ্য মরুর মোর এ জীবনে যন্ত্রণা দেবে কত?


তোমারি বিরহে আমারি হৃদয়ে প্রলয়ের ঝড় উঠে –
ধ্বংস করেছে আমারি পৃথিবী ; সাধ আশা গেছে টুটে!
ক্ষোভে, দুখে দিই ভীমবেগে নাড়া তামাম ধরণী ধরে,
প্রলয়-বিষাণ বাজাই ইস্রাফিলের শিঙ্গা কেড়ে।
চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা কাঁপে মোর ভীম হুঙ্কারে,
হুঙ্কারে মোর কাঁপন জেগেছে স্বর্গের দ্বারে দ্বারে।
ভীম হুঙ্কারে ভাঙিয়া গিয়াছে সাত আকাশের দ্বার,
সৌরলোকের কোটি গ্রহ-তারা হয় বুঝি চুরমার!
শঙ্কিতা ধরা কাঁপে টলমল আমার পায়ের কাছে,
বিশ্ব-স্রষ্টা পদে লুটে পড়ে জীবন ভিক্ষা যাচে!
কাঁপে মহাকাশ, হুঙ্কারে মোর ত্রিভুবন টলমল,
পাষাণ হৃদয় টলেনি, - এতই কঠিন হৃদয়-তল!


চাঁদ হতে বুঝি জ্যোৎস্নার রূপে করুণার ধারা ঝরে,
চাহিনা করুণা, অমৃত দাও পৃথিবীতে এসে ফিরে।
করুণার ধারা ঝরাও ব্যঙ্গ-হাসি হেসে মোর 'পরে,
ব্যঙ্গের হাসি তীরসম এসে আমার বক্ষ ফেঁড়ে –
বহায় রুধির ধারা, সে শোণিত আঁজলা ভরিয়া তুলি'
গোলাপে মাখায়ে আরো লাল করে দিতে চাহি অঞ্জলি
তব পদে; তবু কভুও কি তুমি চাহিবে না মোর পানে?
কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাঙাল ভাসিয়া গিয়াছে অশ্রু-বানে।
তুমি জানিবে না লাল সে গোলাপ এত লাল হল কেন?
জানিবে না কভু প্রেমিক-হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হেন!
মোর দুর্দশা, সিন্ধু-হতাশা এত ভাল তব কাছে?
ডাঙায় তুলিয়া ছেড়ে দিলে মাছ কতক্ষণ সে বাঁচে?
চলে গেলে? যাও! যে থাকিতে নাহি চায়, প্রিয়া! কভু তারে
বাঁধিলেও শত হৃদয়-বাঁধনে, যায় সে বাঁধন ছিঁড়ে!
ছিঁড়েছ হৃদয়তন্ত্রী-বাঁধন, রাখিতে পারিনি ধরে,
দোষ কি তোমার? বেঁধেছিনু তোমা হৃদয়ে আলগা করে!
ঠুনকো এ প্রেম তাই দ'লে গেলে ; খোঁজো ফিরে ভালবাসা,
ভগ্ন হৃদয়ে বসে হেথা, তবু কেন জানি জাগে আশা!
নাহি পারি তব হৃদয় জিতিতে, তবুও যাবার আগে –
বুকে লাথি হেনে কেন গেলে না'ক যদি চিহ্নটা থাকে!
বাকিটা জীবন পার করিতাম ও চিহ্ন বুকে ধরে,
নাহি থাক প্রিয়া! – আছে তো তাহার স্মৃতি-চিন বুক জুড়ে!


বুকে হাহাকার বাজে মোর, সখী! এসো নেমে, এসো নেমে!
ফুলের ছোঁয়ায় মুছে দেব তব সব দুখ-অভিমানে!


সহসা ঢাকিল সেই চাঁদ আসি বিরাট মেঘের ভেলায়,
একা বসে হেথা জানালার পাশে মন ছায় হতাশায়!