(বিঃদ্রঃ কবিতাটির নিচে প্রয়োজনীয় টীকা দেয়া আছে)


সুবে সাদিকের সূর্য উঠেছে পূর্ব গগন জুড়ে,
আঁধার টুটেছে, অত্যাচারীর তখত উঠেছে নড়ে!
পীড়িতের দল শির তুলে হাঁকে হায়দরি হুঙ্কার,
ছিনিয়ে আনিবে জালিমের কালো থাবা ভেঙে অধিকার।
নির্যাতিতের হুঙ্কারে টলে ওঠে গোটা কারাগার,
বীর-বন্দীর লাথিতে টুটেছে কারার রুদ্ধ-দ্বার!
আসিতেছে লাল পাল উড়াইয়া তারিকের রণতরী,
গগন কাঁপিয়ে বাজিয়া ঊঠেছে বিপ্লব-রণভেরী!
রক্ত-পিপাসু দানবের দল! – হুঁশিয়ার! হুঁশিয়ার!
মজলুমানের ক্রোধানলে গদি জ্বলে হবে ছারখার!
তোমাদের চেয়ে ইতিহাসে ছিল যাহারা প্রবলতর,
খোদার উপরে খোদাগিরি করে ভাবিত শক্তিধর,
জুলুম করিয়া মানুষে কহিত – “আমরা তোদের প্রভু,”
ইচ্ছা-অন্ধ! তাহাদের পানে চেয়ে দেখেছ কি কভু?
তখতে চড়িয়া নিজেরে ভাবিত “সর্বশক্তিমান”,
আল্লার মারে উড়ে গেছে “প্রভু” – দেখনি ক’ পরিণাম?
আল্লার সাম্যের ধরণীতে যারা নিপীড়ন করে,
যুগে যুগে দূর হয় দানবেরা তাঁহার প্রবল মারে!
আল্লার প্রিয় সৃষ্টি মানুষে দ’লে যারা পদতলে,
খোদার “ধ্বংস-পরোয়ানা” তার শিরোপরি সদা দোলে!


শোষণমুক্ত নবযুগের আগমনী ঘোষিতেছে “নকীব”,
দুয়ার বন্ধ করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতেছে ক্লীব।
আরশ-কাঁপানো মজলুমানের বুকফাটা হাহাকার –
শুনেও শোনে না! – ভোগোন্মত্ত থেকে হল খাসি খোদার।
ভেঙে ফেল! ফেল ভেঙে ভীরুদের বদ্ধ ঘরের তালা,
ঘুমন্তে জাগা! – দুয়ারে দুয়ারে জ্বালা রে! আগুন জ্বালা!
জাগা রে! জাগা রে! নিদ্রাতুরেরে পৃষ্ঠে চাবুক মেরে,
নিঁদমহলের ভিত্তি কাঁপা রে শের-সম হুঙ্কারে!


ঝলসে উঠেছে ঊর্ধ্ব-গগনে আলীর জুলফিকার,
ফাঁসির রজ্জু পরে হেসে ওঠে ওমর আল মুখতার!
ধরার বাতাসে মিশে আছে কত পীড়িতের আহাজারি,
কত শহিদের খুনে রাঙা ঐ জালিমের তরবারি,
সেই শহিদের পবিত্র খুন ক্রমাগত লিখে চলে –
অত্যাচারীর আগাম পতন-বার্তা এ ধরাতলে!
জালিম-জুলুমে ইতিহাসে হল কত জনপদ লয়,
জীবন-প্রদীপ অকালে নিভিল – কত প্রাণ হল ক্ষয়,
জুলুম-পীড়নে যদি কেহ কভু নতশিরে নাহি মেনে –
প্রাণ-ভয় ভুলে দ্রোহ করে, তবে খোদার রহম নামে।
থরথর কেঁপে জালিম-প্রাসাদ গদি উল্টায়ে যায়,
নির্যাতিতেরে ভালবেসে তারে জয় দেয় আল্লায়!
নিরাশ হয়ো না মজলুম – ঊর্ধ্বে চাহ বুকে বেঁধে আশা,
বেহেশত হতে অসি হাতে নামে উরুজ বার্বারোসা!
ভূমি ফুঁড়ে আসে শহিদেরা – বুকে জ্বলে কোরানের নূর,
গর্জেছে পুনঃ সেরিংগাপটমের শেরে মহীশূর!
গগন কাঁপিছে - নির্যাতিতেরা হুঙ্কার হাঁকে ফের,
ফাঁসির মঞ্চে পাগড়ি ওড়ে - ও কি সাইয়েদ কুতুবের?


মুসলিম সেই! – এক খোদা বিনে নোয়ায় না কভু শির,
নির্লোভ, নিরহঙ্কার, অজেয়, চির-নির্ভীক বীর!
কোনো প্রলোভনে নত নহে – চির-দুর্বার-দুর্জয়,
জুলুম দেখিয়া শের-সম হাঁকে – বিশ্বে সে নির্ভয়।
নতশিরে কভু সহে না ক’ ওরা জুলুম-অত্যাচার,
মার খেয়ে হাঁকে –“নারায়ে তাকবীর! আল্লাহু আকবার!”
শত নিপীড়নে গর্জে ওঠে সে আহত বাঘের মত,
অত্যাচারীর সম্মুখে যার শির চির-উন্নত!
তকবীর হেঁকে কাঁপন ধরায় স্বৈরাচারীর প্রাণে,
কালসাপ সম জালিমের উদ্ধত শিরে ছোবল হানে!
পীড়িতের হাহাকারে আঁখি-নিদ গেছে চিরতরে টুটে,
জুলুম-অবিচারে টর্নেডো সম হুঙ্কারে পড়ে ফেটে!
নির্যাতিতের তরে মরণেরে ‘প্রিয়া’ ভেবে বুকে টানে,
প্রাণ দান করে অকাতরে হেসে পীড়িতের কল্যাণে।
মানুষের তরে লড়ে প্রাণ দেয় – চির-বিপ্লবী বীর,
শহিদী-মৃত্যু-লোভে যে বীরের আত্মা চির-অধীর!
মুসলিম সেই! – ফাঁসির মঞ্চে হাসে ব্যঙ্গের হাসি,
মৃত্যুরে দেয় ধিক্কার যারা মৃত্যু-দর্প নাশি’!


যুগযুগান্ত মুখ বুঁজে যারা সয়েছে অত্যাচার,
শোধ নিতে আসে নিজ পাঁজরের হাড়ে গড়ে তলোয়ার!
রক্ত-মাংস শুষেছে ওদের – কঙ্কাল আছে বাকি,
কঙ্কালসার হাতে ধরে দেবে জালিমের গদি ঝাঁকি!
মরণের মার খেয়ে তবু ওরা মানেনি ক’ আজো হার,
অন্ধের মত মারিবে জালিমে ওরা সাপমারা মার!
ওদের বুকের ক্রোধানল-শিখা ছুঁয়েছে গগন-দ্বার,
পাপ-জুলুমের বিশ্ব জ্বালিয়ে করে বুঝি ছারখার!
চির-লাঞ্ছিত নত শির তোলে সপ্ত-গগন ফুঁড়ে,
বাজের মতন চাহনি – ফিরিবে জালিমে নিত্য তেড়ে!
বীর-বন্দীরা শির তোলে আজি ভীম কারাগার ভেদে,
জলোচ্ছ্বাসের সম ফুঁসে ওঠা বিদ্রোহে কেবা রোধে?
খুনে রাঙা বিপ্লব-পথে আসে শত অনাগত সেনা,
যুগে যুগে প্রাণ দিয়ে ওরা শোধ করে জীবনের দেনা।
মুক্তির রবি আনিতে ও কারা হাতে প্রাণ লয়ে ছোটে?
ঝঞ্ঝার বেগে অত্যাচারীর শিরে পড়ে ওরা টুটে!
শহিদী পেয়ালা পিইবার তরে কাড়াকাড়ি করে মরে,
শত্রুর হাতে শির দিয়ে ওরা শুধু হাতে পায়ে লড়ে।
প্রাণ দেয় তবু এরা কভু নাহি দেয় আপনার মান,
নিজ প্রাণ-বাতি নিভায়ে জাগায় শত ঘুমন্ত প্রাণ।
যারা দুর্বল, যারা নিপীড়িত - তাদের প্রেমের টানে -
খোদা প্রদত্ত শক্তি লইয়া বেহেশত হতে নামে!
জালিমের থাবা ভেঙে দিতে চাহে নির্যাতিতেরে ত্রাণ,
পীড়িতের তরে যুগে যুগে দেয় নিজ প্রাণ বলিদান!
উল্কার বেগে ছুটে এসে যারা ভাঙে জালিমের গদি,
অত্যাচারীর উদ্যত হাতিয়ার ভাঙে – মেরে লাথি,
প্রাসাদ ধসিয়ে স্বৈরাচারীর – মাটিতে মিশায় যারা –
চির-দুর্বার, চির-সংগ্রামী, যৌবন-মাতোয়ারা!
চির-নির্ভীক, নির্ভয়ে হাসে ধরে মরণের দ্বার,
লক্ষ্য যাদের – হয় প্রাণ বলিদান, নয় অধিকার!
জালিমের ঘাড়ে দন্ত বসিয়ে খুন পান করে যারা,
মুক্ত-স্বাধীন, চির-দুর্মদ, বাঁধা-বন্ধনহারা!
হক-বাতিলের দ্বন্দ্বে – সত্যে হিমালয়-অটল যারা,
বাতিলের আঘাতে প্রাণ নিভু নিভু – তবু যারা ভয়হারা!
অসির আঘাত বুক পেতে লয় প্রিয়ার পরশ ভেবে,
শহিদী ঈদগাহে জমায়েত হয় শহিদী মৃত্যু লোভে।
বিপ্লবের ইতিহাস লিখে যায় বক্ষের খুনে,
মুক্তি-সূর্য ওঠে যুগে যুগে ইহাদের খুনে রেঙে।


শহিদী লোহুতে যুগে যুগে শত মুক্তি-প্রদীপ জ্বলে,
প্রতি ফোঁটা খুন হতে ‘বিপ্লবী’ জন্মে এ ধরাতলে!


(শব্দার্থঃ হায়দরি হুঙ্কার - হযরত আলীর রণহুংকার; আগমনী - আহ্বান গীতি; এখানে আহ্বান; নকীব - ঘোষণাকারী;  ক্লীব-ভীতু)


(টীকাঃ


*) তারিক – সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ। যিনি ৭১১ সনে দুর্ধর্ষ স্পেনরাজ রডারিককে পরাজিত করে সেখানকার নির্যাতিত মুক্তিকামী জনতাকে উদ্ধার করেন।


তারিকের স্পেনজয়ের ঘটনাটা নিম্নরূপঃ

৭১১ সনের কথা। মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে স্পেনের মাটিতে পা রাখলেন। উদ্দেশ্য একটাই – স্পেনের মাটিতে আল্লার কালেমাকে বুলন্দ করা। ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়া। মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান করা। কিন্তু বাধ সাধল তৎকালীন স্পেনরাজ রডারিক।
কুফরের ধ্বজাধারী রডারিক সেনাপতি থিওডমিরের নেতৃত্বে প্রায় এক লাখের মত সৈন্য প্রেরণ করলেন তারিকের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেবার জন্য। এদিকে তারিক এক অভাবনীয় কাণ্ড করে বসলেন। যেসব জাহাজে করে মুসলিম বাহিনী স্পেনে এসেছিল জিব্রালটারে নেমেই সেসব জাহাজে তারিক আগুন ধরিয়ে দিলেন। বললেন – “গভীর সমুদ্র আমাদের পিছে গর্জন করছে। আর সামনে অন্যায় অবিচারের প্রতীক বিশাল রডারিক বাহিনী। আমরা যদি পালিয়ে যেতে চাই, সমুদ্র আমাদের গ্রাস করবে। আর যদি সামনে অগ্রসর হই, তাহলে ন্যায় ও বিশ্ব-কল্যাণ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা শহিদ হব, নয়তো বিজয়মাল্য লাভ করে গাজী হব। এই জীবনমরণ সংগ্রামে কে আমার পিছে অনুগামী হবে?"
মুসলিম বাহিনীর প্রত্যেক সৈন্যই বজ্র-নির্ঘোষে তাকবির দিয়ে সেনাপতি তারিকের সাথে ঐক্যমত পোষণ করল।
অতঃপর তুমুল লড়াই হল। একদিকে তারিকের মুষ্টিমেয় সত্যের সৈন্যগণ। আরেকদিকে সাগরের জলরাশির ন্যায় রডারিকের বিশাল সৈন্য।  কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল তারিকের এই ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান মুষ্টিমেয় ১২০০০ সৈন্যের কাছে রডারিকের বিশাল সৈন্যবাহিনী নিমিষে মাটিতে মিশে যায়। স্পেন করতলগত হয় মুসলিম বাহিনীর!


*) জুলফিকারঃ হযরত আলীর দ্বি-ফলকবিশিষ্ট তলোয়ার


*) ওমর আল মুখতারঃ ওমর আল মুখতার ছিলেন লিবিয়ার এক সংগ্রামী বীর সেনানী যিনি ২৩ বছর ধরে ইতালিয় উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দখলদার ইতালিয় সেনাদের হাতে এই মরু সিংহ শাহাদত বরণ করেন। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। মুখতারের নেতৃত্বে ২৩ বছর ধরে ইতালিয় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিল লিবিয়ার দেশ প্রেমিক যোদ্ধারা।
১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে অটোম্যান তুর্কি সাম্রাজ্যের সঙ্গে ইতালির যুদ্ধের সময় ইতালির নৌবাহিনী হানা দেয় লিবিয়ার উপকূলে। সে সময় লিবিয়া ছিল তুর্কি সাম্রাজ্যের অংশ। ইতালিয়রা লিবিয়াকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। কিন্তু তুর্কি সেনারা ও তাদের লিবিয় সহযোগীরা আত্মসমর্পণের পরিবর্তে উপকূল ছেড়ে পেছনের দিকে সরে আসেন।
ইতালিয় হানাদার বাহিনী তিন দিন ধরে ত্রিপলি ও বেনগাজিতে বোমা বর্ষণ করে। লিবিয়ার সাইরেনাইকা অঞ্চলের জনগণ ওমর মুখতারের নেতৃত্বে একের পর এক প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। মরুভূমির লড়াইয়ে অভিজ্ঞ ওমর মুখতার হয়ে ওঠেন ইতালিয় সেনাদের জন্য চক্ষুশূল। ইতালীয়রা মরু অঞ্চলে যুদ্ধের সাথে পরিচিত ছিল না। শায়েখ তার ছোট সৈন্যদল নিয়ে সফল গেরিলা আক্রমণে সক্ষম হন। আক্রমণের পর তার বাহিনী মরুভূমিতে আত্মগোপন করত। তার বাহিনী দক্ষতার সাথে বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, সৈন্যবহরের উপর আক্রমণ চালায় এবং যোগাযোগ ও সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তার গেরিলা পদ্ধতির লড়াইয়ে ইতালীয় সৈনিকরা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে, ১৯২৯ সালে পিয়েত্রো বাদোগলি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পায়। ওমর মুখতারের সাথে আলোচনায় তাকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। সেই বছরের অক্টোবরে মুখতার এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এবং ইতালীয় সেনানায়ক রডোলফো গ্রাজিয়ানির সাথে ব্যাপক যুদ্ধের জন্য লিবিয় মুজাহিদদের পুনরায় সংগঠিত করেন।
কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয় মুনাফিক, গাদ্দারদের কারণে ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এক অতর্কিত হামলায় আহত ও বন্দি হন মুখতার। ৫ দিন পর আতঙ্কগ্রস্ত ইতালিয় দখলদাররা তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করে।
ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায় মরুর সিংহ নামে খ্যাত ওমর মুখতারকে মুসোলিনির ইটালিয়ান সেনা অফিসার জিজ্ঞেস করেছিল:


তুমি কি জান তোমার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড?


জবাবে ওমর মুখতার বলেছিলেন,
হ্যাঁ।


ওই অফিসার বললেন,
তুমি যা করেছ তার জন্য তুমি কী অনুতপ্ত?


ওমর মুখতার বললেন,
প্রশ্নই হয় না, আমি আমার দেশ আর মানুষের জন্য লড়েছি।


সেনা আদালতের বিচারক তার দিকে তাকিয়ে বলে,
তোমার মত লোকের এমন পরিণতি দেখে আমি দুঃখিত।


ওমর মুখতার বললেন,
"কিন্তু এটাই তো জীবন শেষ করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। মহান আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া যে তিনি আমাকে এভাবে বীরের মত শহীদ হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।”


এরপর বিচারক প্রস্তাব দিল তাকে মুক্ত করে দেয়া হবে যদি তিনি মুজাহিদদের কাছে চিঠি লেখেন যাতে মুজাহিদরা ইটালিয়ানদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করে। ওমর মুখতার বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন:
"যেই শাহাদত অঙ্গুলি দিয়ে আমি প্রতিদিন সাক্ষ্য দেই যে এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নাই। সেই আঙ্গুল দিয়ে অসত্য কোনো কথা লিখতে পারবো না। আমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে আত্মসমর্পণ করি না। আমরা হয় জিতি, না হয় মরি।"


*) উরুজ বার্বারোসাঃ ১৫১৭ সাল। স্পেনে মুসলমানদের শেষ আশ্রয়স্থল গ্রানাডার পতনের (১৪৯২) ২৫ বছর পরের ঘটনা। গোটা স্পেন খ্রিস্টানদের পদানত। সম্রাট পঞ্চম চার্লস এবং তার পুত্র ফিলিপের লোমহর্ষক অত্যাচারে লক্ষ লক্ষ মুসলমান ধর্মান্তরিত অথবা স্পেন থেকে বিতাড়িত। উত্তর আফ্রিকার মুসলিম শক্তিও বিধ্বস্ত। সেখানেও চলছে স্পেনরাজের হুকুম। স্পেনের বিতাড়িত মুর মুসলমানরা বাঁচার প্রাণান্তকর সংগ্রামে রত। ভূমধ্য সাগরের যাযাবর সেনাপতি উরুজ বার্বারোসা তাদেরই একজন।


উরুজ বার্বারোসা তখন আলজিরিয়ার তিলিসমানে অবস্থান করছেন। সাথে মাত্র ১৫০০ তুর্কি ও মূর সৈন্য। পার্শ্ববর্তী ওরানের খ্রিস্টান শাসনকর্তা মার্কোয়াস ডি কোমারেসের আকুল আবেদনে স্পেন সম্রাট পঞ্চম চার্লসের প্রেরিত ১০,০০০ সৈন্য উরুজের বিরুদ্ধে ছুটে আসছে। চেষ্টা করেও সাহায্যের কোনো উৎস তিনি কোথাও থেকে বের করতে পারলেন না। সামনে রয়েছে ডি কোমারেসের বিরাট বাহিনী। অগ্রসর হওয়া যায় না। সুতরাং পিছু হটে  আলজিয়ার্স ফেরাই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন উরুজ। শত্রুপক্ষের চোখ এড়াবার জন্য একদিন রাত্রিযোগে আলজিয়ার্স যাত্রা করলেন। কিন্তু তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হল। কোমারেসের নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনী ছুটে এল। উরুজের চলার পথে সামনেই রয়েছে এক নদী। উরুজ নিশ্চিত, একবার নদী পার হতে পারলেই শত্রুপক্ষ আর তাদের নাগাল পাবে না। লোভী স্পেনীয়দের যাতে বিলম্ব হয় সেজন্য উরুজ তাঁর স্বর্ণ ও অর্থসম্পদ রাস্তাময় ছড়িয়ে আসতে লাগলেন। কিন্তু খ্রিস্টানবাহিনী এবার দুর্জয়, অপ্রতিরোধ্য উরুজকে পাবার নেশায় পাগল হয়ে উঠেছে। তারা মণিমানিক্য পদদলিত করে ছুটে এল উরুজের পেছনে।


উরুজ তাঁর অর্ধেক সৈন্যসহ নদী পার হয়েছেন। ইতোমধ্যে খ্রিস্টান বাহিনী এসে পড়ল নদীর তীরে। নদীর ওপারে উরুজের অবশিষ্ট সৈন্য আক্রান্ত হল। উরুজ ফিরে দাঁড়ালেন। নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে নিজ সাথীদের আক্রান্ত হবার দৃশ্য দেখলেন। ইচ্ছা করলে উরুজ তাঁর বাকি অর্ধেক সৈন্য নিয়ে নিরাপদে আলজিয়ার্স ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না।  তিনি এপারের সাথীদের বললেন –“আমার একটি মুসলিম ভাইকেও খ্রিস্টানদের হাতে রেখে আমি ফিরে যেতে পারি না।“ বলে আবার তিনি লাফিয়ে পড়লেন নদীতে। তাঁকে অনুসরণ করল তাঁর প্রতিটি সৈনিকই। ওপারে উঠে তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনী সংগঠিত করে শত্রুসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। উরুজের প্রতিটি সৈনিক শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রু হনন করে শাহাদাত বরণ করলেন। ইতিহাস বলেঃ একটি মুসলিম সৈনিকও সেদিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়নি। সিংহের মত যুদ্ধ করে উরুজ তাঁর পনেরশ সাথী সমেত যুদ্ধক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করলেন। একটি যুদ্ধে ত্যাগের এরূপ মনোভাব নিয়ে একটি গোটা বাহিনী  নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর সমগ্র ইতিহাসে আর নেই।  


*) সেরিংগাপটমঃ মূল শব্দ "শ্রীরঙ্গপত্তনাম"। ইংরেজীতে সেরিংগাপটম (Seringapatam)। সেরিংগাপটম ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষের মহীশূর রাজ্যের রাজধানী। এখানেই "শেরে মহীশূর" খ্যাত টিপু সুলতানের মূল দুর্গ ছিল।


*) শেরে মহীশূরঃ শহিদ টিপু সুলতান। জন্মঃ ২০ নভেম্বর ১৭৫০। শাহাদাতঃ ৪মে ১৭৯৯।
বৃটিশ সয়লাব আর মারাঠা বর্গি যখন সমগ্র ভারত চুরমার করে ফেলেছে ঠিক তখনই পাহাড়ের মত অসীম দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ছোট্ট একটি রাজ্য। বাংলা বিহার উড়িষ্যা যখন ইংরেজের দখলে, অবিরত বর্গি হামলায় ভারতের জনজীবন বিপর্যস্ত, ঠিক তখনই দিনের পর দিন চীনের প্রাচীরের মত পুরো দক্ষিণ ভারতকে পাহাড়া দিয়েছে মহীশুর সালতানাত। একটি দুটি নয়, পুরো ত্রিশটি বছর ইংরেজ সয়লাব ক্ষুদ্র শক্তি বলে আটকে রাখার নায়ক হচ্ছেন শেরে মহীশুর সুলতান টিপু এবং তাঁর পিতা হায়দর আলী।


এই দুই বীর যেভাবে সেই সময়ের অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। এমনকি, একই সময়ে ইংরেজ সৈন্য,অগণিত মারাঠা বর্গি এবং হায়দরাবাদের নিজামের সম্মিলিত শক্তির সাথেও সুলতান টিপুকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সমগ্র ভারতের সকল পরাশক্তিকে দিনের পর দিন বাধা দিয়ে তাদের গতি বার বার ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। রক্ষা করেছেন মহীশুরের স্বাধীনতা।


সেই সময়ে ইংরেজদের বিষফোড়া হয়ে ওঠেন টিপু। তাদের রাজ্য জয়ের পথে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ান। ইংরেজরা হাত করে মারাঠা সর্দারদের। সোনা আর দেশ জয়ের লোভ দেখিয়ে মারাঠাদের ক্ষেপিয়ে তুলে নিজেদের মিত্র বানায় ইংরেজরা। অপরদিকে হায়দরাবাদের নিজাম আগেই তার কিসমত জুড়ে দিয়েছে ইংরেজের সাথে। কাজেই টিপু একাই মুখোমুখি হন এই তিন পরাশক্তির। তার রণ কৌশল, বীরত্ব, বুদ্ধিমত্তার কাছে বারবার পরাজিত হয় এই তিন বাহিনী। সে সময়েই মহীশুরের জনগন তার উপাধি দেয় শের-ই-মহীশূর, মহীশুরের ব্যাঘ্র।


৩০ বছর ধরে পথ আগলে রাখার পরও সুলতান টিপু কে পরাজিত হতে হয় সম্মিলিত শক্তির কাছে তাঁরই প্রধান সেনাপতি মীর সাদিকের বিশ্বাসঘাতকের কারণে।  সেদিন মহীশুর রাজ্যে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। শহীদ হন শেরে মহীশুর। ইতিহাস বলে, এরপর ইংরেজদের আর কয়েক বছর ও লাগেনি সমগ্র ভারতের দখল  নিতে।


শাহাদাতের ঠিক আগ মুহূর্তে সুলতান টিপুকে চতুর্দিক থেকে ইংরেজ সৈন্যরা ঘিরে তার বুক বরাবর গুলি করে। সুলতান পড়ে যান ঘোড়া থেকে। ঐ সময়ে তাকে মৃত মনে করে এক ইংরেজ সৈন্য তার কোমর থেকে রত্নখচিত তলোয়ার টেনে বের করতে গেলে টিপু হাত দিয়ে বাধা দেন এবং অকস্মাৎ নিজেই তার কোমর থেকে তলোয়ার বের করে পূর্ণ শক্তিতে তাকে আঘাতকারী ইংরেজ সেনাকে আঘাত করেন। আঘাত ব্যর্থ হয়ে লাগে সেনার বন্দুকের নলে। তলোয়ার অর্ধেকটা ভেঙে যায়। হাতের মুঠিতে তলোয়ারের বাটসহ বাকি অর্ধেকটা ধরে থাকা অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন এই ইতিহাসের এই মহান সেনানী।)


শব্দার্থ: নিঁদমহল- নিদ্রাপুরী/নিদ্রাকক্ষ; যে প্রাসাদে/দালানে অলসেরা ঘুমিয়ে থাকে, বিশ্রাম নেয়।