(বি.দ্রঃ কবিতাটির নিচে প্রয়োজনীয় টীকা দেয়া আছে)


ঊর্ধ্বে আকাশে উঠিয়াছে ওই মহররমের চাঁদ,
বিশ্ব-ভুবনে ভাঙিয়া গিয়াছে শোক-সাগরের বাধ!
শোকের মাতম উঠেছে শূণ্য কারবালা প্রান্তরে,
ফোরাতের জল, - আঁসু যেন তার, উপচে উঠেছে তীরে।
কাঁদে কারবালা – শূণ্য তেপান্তরে হাহাকার শুনি,-
“হায় হোসেন! হায় হাসান!” – এ রবে কাঁদিছে বিশ্ব-ভূমি!


মানসে সে ছবি ভাসে –
চলিছে হোসেন কুফা-পানে লয়ে অটল বিশ্বাসে!
রাজতন্ত্রের সাপিনী দ্বীনের উপরে ছোবল হানে,
সাপের সে বিষ-দন্ত ভাঙিতে সেনা চলে কুফা-পানে!
মরুর সূর্য আগুন-বৃষ্টি করে বালুকার 'পরে,
অশ্বের পদ দেবে গেল তার কারবালা প্রান্তরে!
মুখ তুলে চেয়ে চারিদিকে দেখে ঘিরেছে এজীদী-সেনা,
এরা বর্বর কুফাবাসী! – এদের বোধ টাকা দিয়ে কেনা!
হাহাকার ওঠে কারবালা-মাঠে – পিপাসায় ফাটে ছাতি,
এজীদী সৈন্য এসে অবরোধ করেছে ফোরাত নদী!
একটি বিন্দু দুধ, জল নাহি পেয়ে শিশু তড়পায়,
অন্ন-জলের অভাবে কাফেলা ধুঁকে ধুঁকে মৃতপ্রায়।
সহসা গর্জে উঠিল ওহাব, - নির্ভীক শের-নর,
“ফোরাতের জল আল্লার দেয়া” – ছোটে নদী বরাবর!
ক্ষুৎপিপাসায় ক্লান্ত ওহাব হাতে তলোয়ার ধরে –
নরকে পাঠায় শত শকুনেরে শীর্ণ হস্তে মেরে!
তুফানের বেগে ছুটে চলে বীর অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে,
চরকির মত অসি হাতে ঘুরে জালিমের শিরে পড়ে !
সহসা শত্রু-অসির আঘাত গর্দানে এসে পড়ে,
পবিত্র শির ওহাবের হায় লুটায় মরুর 'পরে!
ওহাবের মাতা দেখে কাটা-শির তুলিয়া লইল কোলে,
চক্ষু অশ্রুশূণ্য – সেথায় রুদ্র-অনল জ্বলে।
সহসা তুলিয়া সে শির হস্তে ছোঁড়ে সীমারের শিরে,
মস্তক ফেটে ওহাব-হন্তা গড়ায় মরুর 'পরে!
এমনি সময়ে এজীদী সৈন্য নেকড়ের সম এসে –
আঘাত হানিল মাতায় তবুও অটল ঈমানী জোশে –
অবিরাম লড়ে রণরঙ্গিণী, - সহসা আসিয়া তীর
বক্ষ ফাঁড়িল, - শহীদ হয়ে গেল চলে বেহেশতী-নীড়!
হাসানের বেটা কাসিম আসিয়া অশ্ববল্গা ধরে,
'আল্লাহু আকবার' – রবে টুটে পড়ে শত্রুর 'পরে!
নববধূ হয়ে গৃহে আসে তাঁর সখিনা ক্ষণিক আগে,
দেখেনি প্রিয়ার মুখ – অসি হাতে ছোটে শত্রুর ডাকে!
উন্মাদ-বেগে ঝঞ্ঝার রূপে পড়ে শত্রুর শিরে,
রুখিতে না পারি' শকুন হটেছে পিছু পড়িমরি করে।
ও কারা? – সীমার, ওমর লুকায়ে পশ্চাতে তীর হানে,
ইহারা শৃগাল! – এদেরি আঘাতে কাসিম পড়িল ভূমে!
শরাঘাতে দেহ জর্জর তবু মুখে আল্লার নাম,
শহিদী পেয়ালা পিয়ে বেহেশতে করে মহাপ্রস্থান!
কারবালা প্রান্তর জুড়ে হায় উঠিল শোকের মাতম,
কাঁদিয়া উঠিল শয়তানও আজ, কাঁদিল বিশ্বভুবন!
তৃষ্ণায় জল নাহি পেয়ে মরে খিমায় মাসুম শিশু,
ছাতি ফেটে মরে, - হাহাকার তবু শোনেনা এজিদ পশু!
তকবীর হেঁকে আলী আকবার – “আল্লাহু আকবার” –
সাক্ষাৎ যম নেমে এসে যেন প্রাণ করে সংহার!
আঘাতে আঘাতে শত্রুর শির ধুলায় লুটায়ে পড়ে,
আম্রবৃক্ষ হতে যেন আম টুপটাপ পড়ে ঝরে।
ক্ষুৎপিপাসায় ক্লান্ত শরীর, ক'দিন জল না পেয়ে –
শির নুয়ে পড়ে – পড়ে না ক' হাতে সত্যের অসি নুয়ে।
উন্মাদ বেগে অবিরাম লড়ে একা মরু-প্রান্তরে,
মৃত্যুর দ্বারে শুধু আল্লার নাম মুখে, অন্তরে!
তৃষ্ণা-কাতর ক্লান্ত সে দেহ আর পারে না'ক, তাই –
ছুটিয়া আসিয়া লুটিয়া পড়িল পিতা হোসেনের ঠাঁই!
কাতর-কণ্ঠে জল যাচে, কহে – “পিতা গো একটিবার –
জল পেলে এক চুমুক পাঠাব জালিম নরক-পার!
ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর সে দেহ লুটে পড়ে বালুকায়,
কণ্ঠের কাছে প্রাণপাখি তার – তবু নাহি বাহিরায়।


হোসেন কাঁদিয়া কহে –
“জল পাব কোথা? – খোদার সে জল আমাদের তরে নহে!
ফোরাতের তীর উপচে উঠেছে খোদার সে নেয়ামতে,
মোরা হতভাগা! – বঞ্চিত সেই জল-নেয়ামত হতে!
বাপজান মোর! আকবার এই আমার রসনা চুষি –
তৃষ্ণা মেটাও, লও আমার এ রসনার রস শুষি'!”
জানিনা সেদিন ফেরেশতা সব শুধায়েছে কি না রবে –
“ইনসান? নাকি পশু সৃজিয়াছো ধরায় মানবরূপে?”


আবদুল্লাহ, আলী, আসগর শহিদ হল ক্রমে ক্রমে,
মৃত্যুরে প্রিয়া ভেবে বুকে টানে – ভালবেসে ইসলামে!
এমন সময়ে সহসা হোসেন – দুলদুল আসওয়ার –
ছুটিল, -  ঊর্ধ্বে বিজলীর সম চমকায় তরবার!
একের পর এক আঘাত হেনেছে তলোয়ার মুঠে ধরে,
উন্মাদ-সম আঘাতে আঘাতে শত্রুর শির ওড়ে!
সৈন্য পালায় বন্য শৃগাল-সম সে আঘাত খেয়ে,
কচুকাটা হয়ে শত শত শির গড়াগড়ি যায় ভুঁয়ে!


শত্রুসৈন্য শূণ্য দেখিয়া নামে সে ফোরাত-তীরে,
আঁজলা ভরিয়া জল তোলে তবু ওষ্ঠে সে নাহি ধরে!
পুত্র, পুত্রী, স্ত্রীর সেই করুণ চাহনি ভাসে, -
জল নাহি পেয়ে মরেছে স্বজন ক্ষুধাতৃষ্ণায় শেষে।
তৃষ্ণা মেটাল চিরতরে বুকে তীর খেয়ে আসগরে,
অশ্রুতে চোখ ভারি হয়ে আসে কচি মুখখানি স্মরে!
আঁজলার জল নোনা হয়ে ওঠে মিশে চক্ষের জল,
চোখের সামনে ঝাপসা করুণ স্মৃতি করে টলমল!
হস্ত তুলিয়া করুণ কণ্ঠে দোয়া মাঙে – “রহমান! –
বিচার করিও রোজ-কেয়ামতে এসব পাষাণ-প্রাণ!
তোমার দেয়া সে নেয়ামত হতে বঞ্চিত করি' যারা –
মারিল তোমার সৃষ্ট নিরীহ জীবে, - কি মানুষ তারা?
মোরা মজলুম ক্ষুৎপিপাসায় ধূ ধূ মরু-প্রান্তরে –
ধুঁকে ধুঁকে মরি, দেখে নিও রোজ কেয়ামতে ইহাদেরে!
হাশরের মাঠে তৃষায় মরিব জল নাহি পেয়ে কভু,
মোদেরে সেদিন জল বঞ্চিয়া দেবে ইহাদেরে প্রভু?
তোমার বিধান কায়েম করিতে যারা দিল হেসে প্রাণ,
ইহারা শহিদ! – এদেরে নসীব করিও স্বর্গধাম!”
এতেক বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে চোখের অশ্রু মোছে,
শরাঘাতে দেহ ক্লান্ত, রক্তে উঠেছে বসন ভিজে!
ক্ষুৎপিপাসায় ক্লান্ত সে দেহ বালুকায় পড়ে লুটি',
শহিদী রক্তে রঞ্জিত হয়ে কাঁদে কারবালা-মাটি!
নিথর ইমাম পড়িয়া রহিল কারবালা প্রান্তরে,
মা ফাতেমায় কাঁদিয়া উঠিল আরশের পায়া ধরে!
হায়রে হোসেন! হায়রে হাসান! হায় যুবাদের নেতা!
তোমাদের ত্যাগ আজিও বিশ্ব মুসলিম বুকে ব্যথা!
প্রাণ বলিদান দিল শুধু এরা আল্লারে ভালবেসে,
কলসি কলসি তাজা খুন ঢেলে দিল অকাতরে হেসে।
সত্যের তরে জীবন দিয়াছে, এরা নির্ভীক বীর,
নত হয়নি ক', আকাশ ছুঁয়েছে এদেরি সত্য-শির!


ফিরিয়া এসেছে মাহিনা মহররম পুনঃ দুনিয়ায়,
ত্যাগ চাহে ইসলাম, - ক্রন্দন-অভিনয় নাহি চায়!
আপনারে দিতে পার কি বিলিয়ে মানবমুক্তি লাগি?
মানুষের তরে প্রাণ দেবে আজ! – আছে কেউ হেন ত্যাগী?
হাসানের মত পিইতে কি পার গরল অমৃত জ্ঞানে,
হোসেনের মত হাসিতে হাসিতে প্রাণ দিতে পার রণে?
সত্যের পথে নির্ভীক লড়ে দিতে পার কেহ প্রাণ?
আল্লার রাজ কায়েম করিতে কে হবে আগুয়ান?
অত্যাচারীর উদ্ধত-শির কে করিবে চুরমার?
রণক্ষেত্রে কে হাঁকিতে পারে হায়দরি হুঙ্কার?
কার শিরে বাঁধা কলেমার আমামা? – হাতে কোরানের তেগ?
কার বুকে আছে চির-দুরন্ত ঝঞ্ঝার গতিবেগ?


আজ চেয়ে দেখি তখতে তখতে বসে এজিদের চেলা,
দিকেদিকে এরা সৃজন করেছে নৈরাজ্যের মেলা,
রাজতন্ত্রের সাপ ছোবল হানে মুসলিম দুনিয়ায়,
এজীদী দৈত্য প্রাসাদে প্রাসাদে ঘাঁটি গাঁড়ে পুনরায়।
এরা মানুষের খুন শুষে খেয়ে মানুষে শোষণ করে,
নিঃস্বের শেষ সম্বল কাড়ে এরা স্বার্থের তরে!
ইহারা দানব, মানুষের রূপে সাক্ষাৎ শয়তান,
হুঁশিয়ারি আজ ইহাদের তরে, - জেগেছে মজলুমান!
তোমাদের তরে আমাদের কাছে বহু মার আছে জমা,
সেবারে ফিরিয়া গিয়াছ, জানিও এবার আর ফিরিবে না!
দিকেদিকে আজ বীরের কণ্ঠে ধ্বনি' ওঠে তাকবির,
দুনিয়ার বুকে মুসলমানের নত নহে কারো শির!
মানুষের হাঁড়ে গড়েছো প্রাসাদ, - করেছ বিপুল পাপ,
ঊর্ধ্বে তাকায়ে দেখো ধেয়ে আসে আল্লার অভিশাপ!


(বি.দ্র. – ওহাব – পুরো নাম আবদুল ওহাব। কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেনের সাথী ছিলেন এই বীর এবং তার অসম সাহসী মাতা।


কাসেম- ইমাম হাসানের পুত্র। বিষাদসিন্ধু পুরাণ অনুযায়ী হযরত হাসানকে যখন এজিদের ষড়যন্ত্রে বিষপ্রয়োগ করা হয়, তখন মৃত্যুশয্যায় বড় ভাই হোসেনকে বলে গিয়েছিলেন তাঁর পুত্র কাসেমকে যেন হোসেন কন্যা সখীনার সাথে বিয়ে দেয়া হয়। হযরত হোসেন ওয়াদা রক্ষার্থে কারবালা প্রান্তরে তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন।


সীমার – সীমার ছিল এজীদপক্ষীয় সেনা। এই বর্বর হযরত হোসেন শহিদ হওয়ার পর তার মাথা কেটে নেয় বলে বিষাদসিন্ধু পুরাণে কথিত।


ওমর- এজিদের সেনাপতি।


আলী আকবার – আলী আকবার ওরফে আলী ছিলেন হোসেনের পুত্র।


আবদুল্লাহ্, আসগর – আবদুল্লাহ এবং আসগর ছিলেন আলী আকবারের ভাই।


আসগর – আসগর নাম করে আরেকজন ছিলেন কারবালা প্রান্তরে যিনি ছিলেন হোসেনের কনিষ্ঠতম পুত্র। ইনি ছিলেন শিশু। এজীদ সৈন্য ফোরাত নদী অবরোধ করলে সকলে পিপাসায় কাতর হয়ে ওঠে। কাতর হয়ে ওঠে এই অবুঝ শিশুটিও। তখন হোসেন তার স্ত্রী সাহারাবানুর কোল থেকে শিশুটিকে নিয়ে ফোরাতের তীরে পানি পান করাতে যায়। কিন্তু সেই শিশুটির আর পানি পান করা হয় না। এজীদের সৈন্য কর্তৃক হোসেনকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া তীর এসে বিঁধে সেই শিশুটির বুকে। আর সাথে সাথে সেখানেই শাহাদাত বরণ করে এই অবুঝ শিশুটি!)