আলতো চরণ রাখিলে আসিয়া আমার ধেয়ানলোকে,
উদিত হইল প্রভাতের রবি আমারি মানসলোকে!
সাধনা করিয়া নিশিদিন যারে মনের আকাশে খুঁজি,
রবি-রূপে আজ ধরা দিল মোর হৃদয়-আকাশে বুঝি!
আমার আঁধার আকাশ প্রভাত-রবির রোশনী মেখে –
রাঙিয়া উঠিল, - স্বপ্ন হাসিল জীবনের বাঁকে বাঁকে!
নব জীবনের হাতছানি দেখি মোর সম্মুখে ভাসে,
নব প্রভাতের গান শোনালে গো আঁধার জীবনে এসে!
রুদ্ধ জীবনে যেন খুলে গেল সম্ভাবনার দ্বার,
দখিনা বাতাসে রঙিন স্বপ্ন দুলে ওঠে বারবার!


তুমি তো জান না, প্রিয়তমা! তুমি কবির প্রথম ধ্যান,
তোমায় হেরিয়া হয়েছে কবির দিব্য-কাব্য-জ্ঞান!
ধ্যানের জগতে, গানের জগতে আসো তুমি বারেবারে,
ধ্যানমগ্ন এ কবি তাই তোমা বাঁধে বসে সুরে সুরে।
তোমার গলার স্বর মোর সব গানে বাজে সুর হয়ে,
সুরের ইন্দ্রজালে গিয়াছে এ বিশ্বভুবন ছেয়ে।
মর্ত্য ছাপিয়ে সে সুর আমার ভাসে গো স্বর্গ জুড়ে,
দেবী, অপ্সরী, দেব, কিন্নরী – মোহাবিষ্ট সে সুরে!
তন্ময় হয়ে শুনে সবে সুর, বিস্মিত হয়ে কয় –
স্বর্গলোকের সুরও নাকি বলে এত সুমধুর নয়!
উহারা জানেনা আমার গানের সুর সে তোমার দান,
তোমায় বেঁধেছি মোর গানে, তাই এত সুমধুর গান!
তুমি ভুলে গেছো, - অবহেলা ভরে আঘাত হেনেছ বুকে,
আজো তার চিন্ আছে এই বুকে ধ্রুবতারা সম জেগে!
আঘাত হেনেছ কবির হৃদয়ে, আঘাতের বাণী দিয়া –
রচিয়া তুলেছি কবিতা ও গান, - শুনে বোঝোনি ক' প্রিয়া!
খুলে যায় মোর বেদনা-তপ্ত হৃদে কাব্যের ডালি,
মনের আকাশে তারা রূপে ফোঁটে বিরহ গীতির কলি!
ভেবেছ প্রলাপ, দেখনি ক' দেহে কত সে যাতনা বহে,
উহা যে কবির বুকের বেদনা, পাগল প্রলাপ নহে!
তোমারি আঘাত বুকে ধরে আমি পরম সে মমতায় –
ফুটাইয়া তুলি' ফুলরূপে প্রিয়া! অঞ্জলি দেব পায়!
কথার যে তীর হানিয়াছ মোর পুষ্প-কোমল মনে,
তীরের আঘাতে শোণিতের ধারা বয়ে গেছে মোর প্রাণে!
মোর হৃদয়ের সব আশা-সাধ, সব ভালবাসা দিয়া –
হৃদয়-রক্তে চরণ-কমলে আলতা পরাব প্রিয়া!
তুমি জানিবে না পায়ের আলতা কবির খুন বুকের,
কি হবে জানিয়া? তুমি লয়ে থাক জীবনের স্মৃতি সুখের।
কত ফুল ফুটে ওঠে এ হৃদয়ে, প্রেয়সী! তোমায় স্মরে,
আশা লয়ে ফোঁটে, তবু নুয়ে পড়ে নিরাশা-বেদনা-ভারে!
হৃদয় কাননে শুভ্র ফুলেরা হৃদয়-রক্তে রাঙে,
পুষ্পের সাধ – ঝরিবার আগে যাবে তব পদ চুমে!


তোমার মিষ্টি দৃষ্টি দিয়াছ যবে সৃষ্টির পানে,
অপরূপ সাজে সাজে গো প্রকৃতি, নব সাড়া জাগে প্রাণে!
পাতায় পাতায় সজীবতা লাগে, পাখি ফিরে গান গায়,
দৃষ্টি পাইয়া শুষ্ক পুষ্প হয়ে ওঠে মধুময়!
মোহময় তব চাহনিতে সদা অমৃত-সুধা ঝরে,
ফুল ফোঁটায় সে দৃষ্টি শুষ্ক শূণ্য মরুর 'পরে!
কবির মনের বাগানে পুষ্প ছিল সব মৃতপ্রায়,
অর্ধমৃত পুষ্পিত লতা ভূমিতলে পড়ে রয়,
শূণ্য কানন বিবর্ণ যেন গ্রীষ্মের দাবদাহে,
মরুভূমি সম এ হৃদয় জুড়ে শুধু লু হাওয়া বহে!
মনের গহীনে সহসা শুনিতে পাই কার পদধ্বনি,
নিষ্প্রাণ সেই কাননের বুকে বারিধারা হলে তুমি!
তুমি যবে মোর 'পরে প্রিয়তমা লাল হয়ে ওঠো রেগে,
গোধূলির আকাশ রেঙে ওঠে তব গালের লালিমা মেখে!
দুরন্ত বাতাসে উড়ন্ত চুল হাতছানি দেয় মোরে,
বৃক্ষের মাথা এলোমেলো যেন কালবৈশাখী ঝড়ে।
কভু সে চুলের খোঁপায় গেঁথেছ ফুল তুলে আনমনে,
মোর অজান্তে চুলে এ হৃদয় বাঁধা পড়ে তার সনে!
হৃদয়ের পানে চাহিয়া সহসা আমি চমকিয়া উঠি,
ক্লান্ত-পক্ষ নীড়-হারা পাখি খুঁজে পেল তার দিঠি!
তোমারি ললাট চুমিতে আকাশে ওঠে গো সন্ধ্যাতারা,
ধ্রুবতারার আলো ও রূপের কাছে যেন জ্যোতিহারা।
আলোকিত তব রূপের ছটায় চন্দ্র ও তারাদল,
তোমার রূপের রৌশনী মাখে, রবি তাই উজ্জ্বল!
তব রূপ-সুধা পিইতে ছোটে গো কোটি কোটি গ্রহ-তারা,
স্বর্গের ফুল রূপ চুরি করে হয়েছে নজরকাড়া!
আলোকিত হল তামাম বিশ্ব ও রূপের ছটা মেখে,
রূপের আলোর বন্যায় ভাসে তামাম সৌরলোকে!


অভিমানী প্রিয়তমা!
ভাগ্যের আকাশে সহসা দেখি গো কালো মেঘের আনাগোনা!
জ্যোৎস্না-প্লাবিত করিয়া নিত্য মোর আকাশে চাঁদ ওঠে,
চকোর কণ্ঠে উচ্ছাস ভরে তাই গান ওঠে ফুটে।
সে গানে হৃদয়-কাননে ফোঁটে গো হরেক কুসুম-কুঁড়ি,
মৃদুমন্দ ফাগুনের হাওয়া বহে গো হৃদয় জুড়ি'!
সহসা থামে সে গান, দেখি বুকে পাথর-বেদনা বেঁধে –
মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে চাঁদ, - ফিরে গেল তাই কেঁদে!
তোমার বুকের ব্যথার হেতু তো এ অধমে নাহি বল,
কোন সে অসহ বেদনা-আঁসুতে আঁখি তব টলমল?
বেদনা-সাগর হৃদয়ের আড়াল করো হাসিমুখ দিয়া,
সে সাগর হতে অশ্রু ও চোখে ওঠে তবু উছলিয়া।
কোন বেদনায় ক্ষতবিক্ষত তোমার কুসুম হিয়া?
আষাঢ়ের মেঘে কালো কেন তব হৃদয়-আকাশ প্রিয়া?
বল! বল! তব হৃদয়ের ব্যথা – সে কথা শোনার লাগি –
শুধু আমি নই, - কোটি গ্রহ-তারা আকাশে রয়েছে জাগি!
আজ্ঞাবাহী সে দাসের মতন তব দ্বারে পড়ে থাকি,
বলিবে না তবু হৃদয়ের ব্যথা? নাকি দেবে মোরে ফাঁকি?
চাতকের মত চেয়ে রই এসে তব চাঁদমুখ পানে,
ফুল-সম ফোঁটে ঠোঁটে সেই কথা কোন সে শুভক্ষণে?
মোমের মতন গলিয়া পড়েছি তোমার পায়ের কাছে,
এত সাধি, তবু বল না তাই তো অভিমানে মাঝেমাঝে –
দূরে চলে যাই, তবুও একাকী থাকিতে পারিনে, তাই –
বিরহের জ্বালা সহিতে না পারি বারেবারে এসে শুধাই!
লা-জওয়াব! – তবু প্রতীক্ষারত রাতের চাঁদের মত।
মোর জীবনের ভোর হবে কবে? – কেঁদে যাব আর কত?
নাকি এ আমার আঁধার জীবনে প্রভাত হবে না আর?
জনম জনম কেটে যাবে কেঁদে; - কাটিবে না এ আঁধার?
নারীর মনের রহস্য নাকি ঈশ্বরও নাহি বোঝে?
দীনহীন এই বিরহী প্রণয়ী কিভাবে তা পাবে খুঁজে?
ধরিতে পারে না রহস্যভরা মন অন্তর্যামী,
কবি তো মানুষ, সাধারণ, - ছোঁবো কিভাবে তা নাহি জানি।
রামধনু সম তোমাদের মনে নানান রঙের মেলা,
এই আকাশের ঘনঘটা! তো কিনা এই রৌদ্রের খেলা!
মনে বড় ব্যথা, - এই ধরণীটা এত নিষ্ঠুরময়,
স্বার্থের এই পৃথিবীতে হায়! কেউ কারো তরে নয়!
প্রয়োজন শেষ, সাথে নিঃশেষ হয় মানুষের স্মৃতি,
মানুষ দেখে না মানুষের মনে বাজে বেদনার গীতি!
হৃদয়ে আঘাত হেনে চলে যায়, চাহে না'ক পিছু ফিরে,
দেখে না বুকের রক্ত চোখের অশ্রুর রূপে ঝরে!
শঙ্কায় কাঁপে হিয়া, - মোর প্রিয়া! যাবে তুমি আজও চলে?
মোর আকাশের রবি চিরতরে যাবে কি অস্তাচলে?