“চীন দেশের কবিদের নিয়ে তো অল্প আধটু পড়াশোনা করছ। বল দেখি, চীন দেশের কবি বলতে কার নাম প্রথম মাথায় আসে?” ডিভানে গা-টা এলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল ওয়ান সুণ থাং। ঠোঁটে লেগে আছে হালকা একটা হাসি।
বললাম, “যার নাম মনে আসে, তার সম্বন্ধে পড়েছি, কিন্তু তোমার কাছে শোনা হয় নি।”
“আচ্ছা। তুমি যদি ঠিক নাম বলতে পারো, তবে আজকে সেই কবির কথাই শোনাবো তোমায়। আর না বলতে পারলে আজ নো গল্প।”
“দু ফু,” সংক্ষেপে উত্তর দিলাম।
“ব্রাভো। ব্রাভো।” চেঁচিয়ে উঠলো ওয়ান সুণ থাং। তারপর ফোন করে একটা পিৎসার অর্ডার দিলো সে। বলল, “লাঞ্চটা সেরেই যেও।”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিতে, ও উঠে গিয়ে একটা বেশ মোটা বই নিয়ে এলো। তারপর সিগারেট ধরিয়ে শুরু করল ওর গল্প।  
দু ফু (৭১২-৭৭০) চীন দেশের একজন বিখ্যাত কবি। ওনাকে চীন দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিও বলা হয়। ট্যাং সাম্রাজ্যের রাজসভায় চাকরি করতেন তিনি। দু ফু-র জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যাই নি। যা জানা গেছে, তা ওনার কবিতার মাধ্যমেই।  প্রথম জীবনে কবি হিসাবে তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন না।
দু ফু-র প্রথম জীবনের কবিতায় আমরা ভীষণ ভাবে পাই প্রকৃতিকে। প্রকৃতির বিভিন্ন রূপকে কবি ধরেছেন তাঁর কবিতায়। যেমন এই কবিতাটা।


হেমন্তের বর্ষা


হেমন্তের বর্ষায় পচে মরে ঘাস,
পায়ের তলার জুইমিং তবুও সতেজ,
সবুজ পত্র, পালকের মত জড়িয়ে আছে শাখায়,
আর, স্বর্ণ মুদ্রার মত, অসংখ্য ফুল ফুটেছে।
ক্রন্দনরত ঠাণ্ডা বাতাস যেন তোমায় ছুয়ে দেয়,
ভয় হয়, এই বুঝি তুমি পড়ে যাবে,
উপরে বৃদ্ধ মানুষটার সাদা চুল হাওয়া ছুয়ে দেয়,
সে গন্ধটা অনুভব করে আর অকারণেই কাঁদে।


বি.দ্র: জুইমিং চীন দেশের এক জাতীয় হলুদ রঙের ফুল।


৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আন লুশান বিপ্লব শুরু হয় আর আগামী আট বছর চলে। চীনের সমাজকে বিদ্ধস্ত করে দিয়েছিলো এই বিপ্লব। যুদ্ধ, মৃত্যু, দুর্ভিক্ষের দৃশ্য, আস্তে আস্তে দু ফু-কে পরিবর্তন করেছে। পরিবর্তন হয়েছে ওনার কবিতাও।
‘আমার ফেরা’ কবিতাটি ৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে লেখা। দু ফু বহুদিন পরে রাজসভা থেকে ছুটি পেয়ে নিজের গ্রাম, কুইয়াং-এ ফেরার পথে লিখেছিলেন এই কবিতাটি। অনুবাদ করলাম।


আমার ফেরা


পশ্চিম আকাশে রক্তিম মেঘের ঘনঘটা,
সূর্যটা পাহাড়ের পিছনে লুকাচ্ছে,
পাখীদের বাসায় ফেরার তাড়া।
সেই বিকেলে আমি ঘরে ফিরলাম।  


নীচের কবিতাটি ৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে লেখা। চীন দেশে ‘মুন ফেস্টিভাল’ নামে একটি উৎসব হয় হেমন্ত কালের মাঝামাঝি। নিয়ম অনুযায়ী, সেইদিন পরিবারের সকলে একসাথে চাঁদ দেখে। দু ফু সেই সময় বিপ্লবীদের হাতে বন্দী। সেই বন্দী অবস্থায় তিনি এই কবিতাটি রচনা করেন।


চাঁদের আভা


চাঁদটা চকচক করছে ফুঝৌ-এর আকাশে,
নিজের ঘর থেকে, একাই দেখছে চাঁদটাকে।
পুত্র-কন্যার জন্য তাঁর মন কেমন করে,
তারাও হয়তো ওই চাঁদটাকেই দেখে।
তার স্ত্রীর চুলের সুমিষ্ট গন্ধ,
তার চোখ দুটো ঝলসে ওঠে চন্দ্র আভায়,
সে জানলার উপর ঝুঁকে পড়ে,
চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে, কান্না ভেজা চোখে।


কবি লি বা-র মতই, দু ফু-র কবিতায় দুটো ভিন্ন সময় ফুটে ওঠে। দু ফু-র শেষ জীবনের একটি কবিতার অনুবাদ দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি।


আমার বন্ধু ওয়ে-কে


আজকাল, বন্ধুদের দেখা পাওয়া বিরল,
ঠিক যেমন সূর্য আর সন্ধ্যাতারা,
আজ সেই বিরল সন্ধ্যা,
মোমবাতির আলোয়,
দুটো বন্ধু, যারা কিছুদিন আগেও যুবক ছিল।
কিন্তু এখন চূলে পাক ধরেছে,
তাদের অন্য বন্ধুরা বেশীর ভাগই মৃত,
তাদের হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে পুরানো স্মৃতি
তারা ভাবেই নি যে আবার
বিশ বছর পর দেখা হবে।