গত রবিবার লোয়াঙ বলে একটি জায়গায় বেড়াতে গেছিলাম। সাধারণত রবিবার আমি খুব একটা দূরে কোথাও বের হই না। সারা সপ্তাহ অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই একটা দিন পুরোপুরি বিশ্রামই নিই। কিন্তু এই সপ্তাহে বিশ্রাম আর হল না। শনিবার রাতে ওয়ান সুণ থাং ফোন করে বলল, “কি বন্ধু, কালকের কি প্লান?”
বললাম, “আমার কোন প্লান নেই। পড়ে পড়ে ঘুমবো আর কি। কেন?”
“আমি ভাবছিলাম একটু আমার দেশের বাড়ি যাব লোয়াঙ-এ। যাবে নাকি?” জিজ্ঞেস করল ওয়ান সুণ থাং।
সাধারণত না বেরলেও, ওয়ান সুণ থাং –এর অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। তাই রাজি হয়ে গেলাম। আরও ভাবলাম, ওর সঙ্গে যেতে যেতে যদি লেখার কিছু রসদ পাওয়া যায় তাহলে মন্দ কি।  
ওয়ান সুণ থাং বেশ ভালো গাড়ি চালায়। এদিক ওদিকের বিভিন্ন গল্প করতে করতে আমরা পৌছোলাম লোয়াঙ-এ। দুপুরে ওর বাড়িতে ভাত, ওদের নিজেদের বাগানের সবজি আর কাঁকড়া দিয়ে সুন্দর লাঞ্চ হল। কিন্তু আমার আশা মিটল না। আমি ভেবেছিলাম চীন দেশের কবিদের নিয়ে একটু গল্প শুনব। কিন্তু সে গুড়ে বালি। যত বারই আমি প্রসঙ্গ তুলি ততবারই ওয়ান সুণ থাং কোন উপায়ে এড়িয়ে যায়। তাই একটু মনমরা হয়ে পড়লাম। ভাবলাম, ‘যা, বিশ্রামও গেল আর গল্পও শোনা হল না।’
যাই হোক, খেয়ে উঠে সবে একটু বসেছি, অমনি ওয়ান সুণ থাং বলল, “চল, একটু বেড়িয়ে আসি।”
কি আর করি, উঠে পড়লাম। আবার গাড়ি চলতে লাগলো। মিনিট পনেরো চলার পর একটা বিশাল বাগানের সামনে গাড়িটা দাড় করাল ওয়ান সুণ থাং।
বলল, “তুমি হয়তো ভাবছো তোমার সাথে কবিতা নিয়ে আলোচনা করছিনা কেন, তাই তো?”
আমি কোন উত্তর দিলাম না। কি উত্তর দেব ঠিক বুঝতে না পেয়ে একটু হাসলাম মাত্র। ওয়ান সুণ থাং ও হাসি মুখে এগিয়ে চলল বাগানের মাঝখানের নুড়ি বিছানো রাস্তা দিয়ে। আমিও ওকে অনুসরণ করলাম। কিছু দূর গিয়ে, ও একটা সাদা পাঁচিল ঘেরা মাটির ঢিবির সামনে দাঁড়াল। পাঁচিলে একটা ফলকে চীনে ভাষায় কি যেন লেখা আছে। পাশে ইংরেজি বোর্ডে লেখা “In Memory Of Bai Juyi।”
“বাই জুই –এর নাম শুনেছ বলে তো মনে হয় না?” বলল ওয়ান সুণ থাং।  
“না, শুনিনি,” সংক্ষেপে উত্তর দিলাম।
“বাই জুই চীন দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। ওনাকে ‘Hermit of Xian Shan’ বলা হয়। এই যে ঢিবিটা দেখছ, এটা ওনার সমাধি।” তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটু আশ্চর্য হলে মনে হয়?”
“তা তো একটু হলাম বটেই। তুমি বলছ এত বড় কবির এই সমাধি?” সত্যিই বেশ আবাক হলাম এই চাকচিক্যহীন সমাধি দেখে।
“সেটা ওনারই ইচ্ছে ছিল। মৃত্যুর আগে উনি বলে গিয়েছিলেন ওনাকে যেন এই রকম আড়ম্বরহীন, চাকচিক্যহীন সমাধি দেওয়া হয়,” বলল ওয়ান সুণ থাং।
সেই সমাধিটার পাশেই দুজনে বসে পড়লাম। ওয়ান সুণ থাং তৈরি হয়েই এসেছিলো। কাঁধের ঝোলা থেকে একটা বই বের করে আমার হাতে দিল। চীনে ভাষায় কবিতার বই। তারপর শুরু হল বাই জুই-র গল্প।
বাই জুই ট্যাঙ সাম্রাজ্যের কবিদের একজন। ৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে টাইয়ূয়ানে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ওনার কবিতায় সাধারণত প্রকৃতি আর সেই সময়কার জীবনের নানান দিক উঠে আসে। উনি একদম সহজ সরল ভাষায় লিখতেন যাতে সাধারণ মানুষের বুঝতে অসুবিধে না হয়। ওনার এই লেখার ধরনের জন্য ওনার কবিতা চীনের সর্বত্র পড়া হয়। একটা উদাহরণ দিলাম। এই কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক লাও জী-র একটি বই পড়ে।


                         লাও জী-র লেখা পড়ে


যারা জানে না তারাই কথা বলে, যারা জানে তারা সব চুপ থাকে,
আমি এটা শুনেছিলাম এক বৃদ্ধের থেকে।
যদি বৃদ্ধ মানুষটি দুনিয়াটা না চিনত,
তাহলে কি করে সে এত সুন্দর লেখে।


৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে যখন আন লুসান বিপ্লব সবে শেষ হয়েছে, তখন চীন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভীষণ খারাপ। এই সময় দেশের মানুষের দুঃখ দেখে উনি সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি রাজ সভা ছেড়ে গ্রামে চলে যান। সেই সময় তিনি বেশ কিছু কালজয়ী কবিতা লেখেন।


                              শেষ শরতের ঘুম


বালিশটা নিচু, চাদরটা নরম, আমার শরীরটাও শান্ত এদের মাঝে,
সূর্য আমার দরজায় টোকা দিয়ে যায়, আমি তবে পর্দা সরাই না,
এখনও শরত পুরোপুরি বিদায় নেয় নি,
তার গন্ধ এখনও হাওয়ায় ভাসমান।


গ্রামে থাকা কালীন, বাই জুই এই কবিতাটি লিখেছিলেন ঝেনইয়ান-কে নিয়ে। ইয়াং জি নদীর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এই ঝেনইয়ান নামক গ্রামটি। উনি ওনার ছেলেবেলার অধিকাংশই কাটিয়ে ছিলেন সেখানে। ওনার প্রিয় ইয়াং জি নদী সম্পর্কে ওনার লেখা আরও একটি কবিতা অনুবাদ করলাম।


                     ১) নদীর দক্ষিণ দিকের শোভা


নদীর দক্ষিণ দিকটা সুন্দর,
বহুদিন আগে, আমিও জানতাম এই দিকটাকে,
সূর্যোদয়ের সময়, নদীর জল রক্তিম ফুলের মত দেখায়,
শরতে জল সবুজ হয়ে যায় নতুন পাতার মত,
কি করে ভুলব বল, এই নদীর দক্ষিণ দিকটাকে।।


                            ২) সূর্যাস্তের গান

সরু নদীটা শান্ত এই সূর্যাস্তের সময়,
অর্ধেকটা নীলচে আর বাকিটা লাল,
এই সময়টা আমার ভীষণ প্রিয়,
শিশিরগুলো যখন মুক্তোর মত ঝরে পড়ে নদীর জলে।


উনি ওনার জীবন কালে, ২৪০০ –র বেশি কবিতা লিখেছিলেন। শোনা যায়, উনি ওনার কবিতা গুলো প্রথমে ওনার চাকরদের পড়ে শোনাতেন। যদি ওদের কেউ কোন জায়গা বুঝতে না পারত, বাই জুই তখনি ওই স্তবকটা পালটে দিতেন যাতে ওরা বুঝতে পারে। ওনার এই সহজ ভাষায় লেখা কবিতার জন্য ওনার জনপ্রিয়তা আজও চীন দেশে আকাশ ছোঁয়া। ওনার আরও একটা কবিতার অনুবাদ দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি। আশা করি বাই জুই-র কাহিনী ও কবিতা আপনাদের ভালো লাগবে।

                           প্রাসাদের গান


রূমালটা ভিজে গেছে কান্নার জলে, ঘুম তার চোখে নেই,
মস্ত প্রাসাদের প্রতিধ্বনি তার কানে গান শুনিয়ে যায়।
তার রক্তাভ গাল বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা,
কুয়াশায় ঢাকা রাতে সে অপেক্ষা করে ভোরের।