দেশে ফেরার পর লেখার সময়ই পাই না। এক বছর পর ফিরে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। চীন দেশের কবিতা নিয়েও কিছু লেখা হয় নি প্রায় এক মাস। আপনাদের মধ্যে অনেকেই অনুরোধ করেছেন চীনা কবিতা নিয়ে লিখতে। আজ সময় পেয়েছি বেনারসে বেড়াতে এসে। পরিবারের সবাই মার্কেটিং এ গেছে। আমি হোটেলে একা। তাই লিখে ফেললাম চীন দেশে বিখ্যাত কবি বাই দাও কে নিয়ে। 'চীন দেশের পাঁচ কবিতা' সিরিজের পরের পর্ব।
ঝাও ঝেঙ্কাই ১৯৪৯ সালের ২ রা অগস্ট বেজিং শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। উনি বাই দাও ছদ্মনামে লেখালিখি করতেন। চীনা সাহিত্যের বিখ্যাত মিস্টি কবিদের মধ্যে সবচেয়ে নামি ছিলেন বাই দাও।
যৌবনকালে, বাই দাও, মাও জেদং এর সংস্থা 'রেড গার্ড' এর সদস্য ছিলেন। এই 'রেড গার্ড' রাই সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনতে সাহায্য করে কিন্তু সহিংস ভাবে। ১৯৭৮ সালে মাঙ কে সাথে উনি জিয়ান্তিয়ান (আজ) পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকা থেকেই 'মিস্টি পোয়াট' নামক সংগঠনের জন্ম। পত্রিকাটি ১৯৮০ সালে ব্যান করা হয়।
মিস্টি পোয়াট আর বাই দাওয়ের কবিতাই পরবর্তী কালে চীন দেশে বিপ্লবের অনুপ্রেরণা যোগায়। ওনার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতার নাম 'হুইদা' (উত্তর)। এই কবিতাটি ১৯৭৬ সালে তিয়ানান্মেন স্কয়ারে জনসমাবেশের সময় লেখা। এই কবিতাটি পরবর্তীকালে বিপ্লবীদের সঙ্গীত হয়ে যায়। ১৯৮৯ সালে তিয়ানান্মেন স্কয়ার বিপ্লবের সময় 'হুইদা' কবিতাটি বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। সেই সময় বাই দাও বার্লিনে একটা সাহিত্য সম্মেলনে ছিলেন। এই ঘটনার পর ২০০৬ সাল অবধি বাই দাওকে চীনে ফেরার অনুমতি দেয়নি চীন সরকার।(বাকি তিনজন মিস্টি কবি গু ছেং, দুও দুও আর ইয়ান লিয়ানকেও নির্বাসিত করা হয়।) বাই দাও-এর স্ত্রী সাও ফেই আর তাঁদের কন্যাকে চীন দেশের বাইরে বাই দাওএর কাছে যাওয়ায় অনুমতি দেওয়া হয়নি আগামি ছ'বছর।
১৯৮৭ সালের পর বাই দাও ইংল্যান্ড, জার্মান, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকায় থেকেছেন ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ওনার লেখা কবিতা পঁচিশটি আন্তর্জাতিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
বাই দাও সারা জীবনে একাধিক পুরুস্কার পেয়েছেন, তার মধ্যে সুইডেনের তুচলস্কি পুরুস্কার, আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরুস্কার, বারবারা গোল্ডস্মিত লেখক স্বাধীনতা পুরুস্কার অন্যতম। উনি আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ আর্টস এ্যান্ড লেটার সংস্থার সাম্মানিক সদস্য। সাহিত্যে নোবেল পুরুস্কারের জন্য ওনার নাম একাধিকবার মনোনীত করা হয়।
ওনার কিছু বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হল 'উত্তর' (১৯৭৬), 'পুরানো বরফ' (১৯৯০), 'শূন্যের উপর জমি' (১৯৯৬)। ওনার লেখা পাঁচটা কবিতা দিয়ে এই লেখা শেষ করলাম। কেমন লাগল জানাবেন।    


                              আজকের দিনে


বাতাসে একটা ভালবাসা উড়ে বেড়ায়।
গ্রীষ্ম কাঁপে রাজনৈতিক রঙে।
কেউ বা মাছ ধরতে গিয়ে দেখে ফেলে
পৃথিবীর গভীর ক্ষত।
বন্ধ ঘড়িটাও ঠিক, দিনে দুবার।
যারা শুধুই হেঁটে বেড়াচ্ছে, সারা দুপুর,
তারা কি বুঝেছে ক্ষিদের মানে?


কেউ কেউ মজে আছে পিয়ানোয়,
কারুর বা কাধে একখান মই।
তন্দ্রা ভাবটা কেটে যাবে এখুনি,
কয়েক মুহূর্ত।
সূর্যটা গবেষণা করে ছায়া নিয়ে,
আমি আয়না দিয়ে মাপি জলের গভীরতা।
হঠাৎ খেয়াল করি মনের কোনেই শত্রুর বাস।


ভোরের দিকে আবার কেউ গান গাইবে,
সমুদ্রটা ভরে উঠবে তেলের জাহাজ।
তবু আমি ভেঙে দেব অ্যাকুয়ারিয়াম
মাছগুলো ছেড়ে দেব আলোর সাগরে।


                                  ফেব্রুয়ারি


রাত্রি ছুটছে পূর্ণতার দিকে।
আমি ভেসে যাই সঙ্গীতের সুরে
খুব কাছে চলে আসে মৃত্যু,
বরফ ঢাকা, শান্তির সুর।
আমার কবরের উপর দাঁড়িয়ে কেউ গান গাইবে,
তিক্ত হয়ে যাবে জল,
আগুনের মাথায়ও রক্তক্ষরণ চাই,
তারাগুলো সব নিভে গেছে একে একে।


ভোরের আকাশে আবার
স্বপ্ন খেলে বেড়ায়, নতুন সুর।
রাত জাগা পাখিটা,
কাছে চলে আসে সত্যের।
আমি আর আমার কবিতা,
ডুবে যাই হাত ধরাধরি করে।


বইয়ের পাতায় ফেব্রুয়ারি:
কত বিপ্লব, কত প্রতিবিম্ব।


                                  আমরা


অন্তর অবধি ভীত,
আমরা লণ্ঠন হাতে শরত খুঁজি।
কাটা দাগ আবার ফিরে আসে,
ফিরে আসে আলোয় ফেরার ইচ্ছে।
মুহূর্তের ইন্দ্রজাল!
চুরি হয়ে যায় বাড়িতে পাঠানো চিঠি,
হায়!
চুরি হয়ে যায় স্বপ্নের শিশির বিন্দু।


ভীষণ অনন্দ!
কোনদিন হয়তো পালটাবে না এই গানের স্বরলিপি।
পোড়া কাঠ পড়ে আছে একত্র
শ্রোতাদের অপেক্ষায়।
অপেক্ষায় আছে শীতল হৃদয়ের।
মোহনার শেষ দেখায়,
মাঝিটা ভেসে আছে নতুন সকালের আশায়।


কেউ তো আবার নতুন করে শেখাবেই
ভালবাসার মানে।


                            শূন্যের উপর জমি


একটা সামুদ্রিক পাখি, সঙ্গীতকে সাঁতার কাটা শেখায়
একটা সঙ্গীত, প্রথম খুঁজে পেয়েছিল বাতাসের উৎস।
আমরা কত সুখই না ভাগ করে নিই
বিভিন্ন দরজা দিয়ে সেই একই ঘরে প্রবেশ করি।

একটি পিতা, প্রথম চিনতে শেখে অন্ধকার,
একটু অন্ধকার, আমাদের টেনে নিয়ে দেখায় বজ্রপাত।
ক্রন্দনরত দুয়ার বন্ধ হয়ে যায় মুখের উপর
তারই প্রতিধ্বনি ভেসে যায় কান্না হয়ে।

একটা কলম, জন্ম দিয়েছিল দুঃখের,
একটা ফুল, প্রতিবাদ করেছিল প্রথম বারের জন্য।

শুধু সাড়া দিয়েছিল এক ফালি ভালোবাসা,
শূন্যের উপরের জমিতে খেলে যায় বিদ্যুৎ ছটা...


                                 বক্তব্য


হয়তো শেষ সময় আসন্ন
আমি কোন কথা দিয়ে যাচ্ছি না
শুধু একখানা কলম রেখে যাচ্ছে আমার মায়ের জন্য।
এই নায়ক বিহীন সময়ে,
শুধু ব্যক্তি রুপেই বাঁচতে চাই।


শান্তির দিগন্ত
জীবন আর মৃত্যুকে আলাদা করে দেয়।
আমি আকাশের পানেই তাকাই
হাঁটু মুড়ে বসতে আমার আপত্তি।
জল্লাদকে অনেক উঁচু মনে হবে তোমার
এই পরাধীনতার শহরে।


এই গুলি বিদ্ধ তারাদের শরীর থেকে
ঝরে পড়বে রক্তে রাঙা স্বাধীনতা।