আমার আবার ঘুমঘোরে হাঁটার অভ্যেস আছে কীনা-
দাদী বলতেন আমার প্রয়াত দাদারও
নাকি নিদ্রাভ্রমন রোগ ছিলেন!


একবারতো তিনি ঘুমের ঘোরে হাঁটতে হাঁটতে দুদিনের জন্য লাপাত্তাই হয়ে গেলেন--
শেষে ফিরলেন কীনা আমার দ্বিতীয়া
দাদুকে হাতে কোরে!


সে যাই হোক
আজকের গল্পটা কিন্তু আমাদের দাদা
কিংবা দ্বিতীয়া দাদু;মানে আমার দাদীর সতীনকে ঘিরে নয়-


গতরাতেও চিরঅভ্যেসবশতঃ ঘুমের
ঘোরে আমি হাঁটছিলাম-
রাত গভীর বলে হয়তোবা আমাকে
আটকাবার মত কেউ ছিলো না-


যাই হোক ;
এর পরের গল্পটা কিছুটা রোমাঞ্চ আর
খানিকটা ভীতিকর হোলেও
আমি আমার হাঁটার কাজটা চালিয়েই
গেলাম--


কিছুদূর যেতেই
দেখলাম-
আমার সামনে জলজ্যান্ত আট-আটটা
জঙ্গল ; তাদের হা-করা দরোজা খুলে
আমার দিকে মুখিয়ে আছে-


আমিতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে রইলাম-
এতগুলো উন্মূখ দরোজার ভীড়ে
আমাকে কোন দরোজার পথ ধরে
এগুনো উচিৎ!


এমন গহীন অন্ধকারে আমাকে
কেইবা বলে দিতে পারে
কোনটা ঠিক
আমার জন্য সঠিক গন্তব্য!


দাদা সাথে থাকলে তবুও একটা কথা
ছিলো--


এরপরও কপালে চিন্তার বলিরেখা
ফুটিয়ে অংক পরীক্ষার হলের মত
নিমগ্নে ভাবতে থাকলাম-


শেষমেষ যে জঙ্গলটাকে সবচে
গাঢ় আর সবুজ বলে মনে হলো
তারই হা-করা বুকের অভ্যন্তরে
নিজেকে সঁপে দিলাম-


প্রারম্ভিক মূহুর্তে জঙ্গলের সার্বিক
দৃশ্যগুলোকে আমার কাছে তুমুল
উপভোগ্য মনে হোলেও;
হঠাৎ করে দূর থেকে ভেসে আসা একটি তারস্বরে প্রতিধ্বনিত চিৎকার
নিমেষেই, আমার সাথেসাথে আমার
শরীরের সকল রক্ত প্রবাহকেও থামিয়ে
দিলো-


বরফের পাহাড়সদৃশ নিশ্চল;আমি দাড়িয়ে রইলাম
আর
মনেমনে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে থাকলাম--


মৃত্যুকে অবধারিত জেনেও
আমি আবার কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে
সন্তর্পণে হাঁটতে আরম্ভ করলাম ---


জঙ্গলজুড়ে নাম না জানা বিস্তৃত গাছ-গাছালি লতাগুল্ম
জঙ্গলের পীতাব মাটির সাথে যেন
প্রাচীন সঙ্গমসুখে মত্ত-


মাটি আর অরণ্যের কামজ শিৎকারে
আমি শিহরিত না হয়ে পারলাম না-


ভয় শঙ্কা আর তারোধিক কামজ অনুভূতি নিয়ে
আমি জঙ্গলের যে পথ ধরে হাঁটছিলাম-
তারই দুপাশে সারিসারি দেবদারুসদৃশ
বৃক্ষরাজি থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ফুলের
ঝর্ণা বর্ষিত হতে থাকলো-


অসংখ্য ফুলের এমন নীরব সৌরভে আমার নাসারন্ধ্র কেমন অবশের মত
হয়ে গেলো --


আমার কেবল মনে হোতে থাকলো
এ জঙ্গলের এমন বিচিত্র মোহে আবিষ্ট
হয়ে
আমি কত যুগইনা অতিক্রম করেছি
একই পথের উপর--


কয়েকযুগ পর
অাচমকা পুরো জঙ্গলজুড়ে তুমুল কোলাহল শুনে সাহসের বদলে
উল্টো আমি ভূত দেখার মত চমকে
গেলাম-


এমন গহীন জঙ্গলে
এত নিবিড় কোলাহলকে
আমার চোখে নিতান্ত ভীতির কারণ বলেই মনে হলো--


আবারও তন্ত্রেমন্ত্রে
আমি সাহসের আশ্রয়ই নিলাম-


এতক্ষণ যে কোলাহলকে নিতান্ত ভয়ের
কারণ হিসেবে মানতাম
কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই; সে কোলাহলগুলোই কীনা
আমাকে একটি আশ্চর্যজনক পথের
ইঙ্গিত দিয়েই চুপসে গেলো --


বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই
আমি সেসব কোলাহলের ছাপ
ধরে নিজের ছায়াকে অনুসরণ করতেকরতে এগুতে থাকলাম--


সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করতেই দেখতে
পেলাম
অদূরে একটি প্রাসাদোপম দরোজা আমাকে নৈশব্দের স্বরে
নিজের দিকেই ডাকতে লাগলো---


বিশেষ কোরে
দরোজার রঙচঙহীন রাজকীয় কারুকাজ
আমাকে সাপের জিহ্বার মত অস্থির
আর
বাতাসের মত ধাবমান করে তুললো -


আমি একদৌড়েই দরোজাটির ঠিক
সামনেই উপনীত হলাম--
এমন রাজকীয় দরোজায় কোনো
পাহারাদার নেই দেখে, আমি কিছুটা
আশ্চর্যই হলাম-


আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়বার
আগেই দুজন হরিণীনয়না
সেবিকামত রমণী সহাস্যে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন -


শ্যামাঙ্গী হোলোও দুজন রমণীর
রূপ-লাবন্য
অপার লোভনীয় বলেই
পুরুষ বলতেই মানতে বাধ্য--


দুজন রমণীই কোনো এক অচেনা ভাষায়
আমাকেই লক্ষ্য করে মনে হলো
এমনসব সম্ভাসনের গজল শোনালেন
ভাষাজ্ঞানহীন আমার কর্ণযুগল
সেসব অচেনা সুরকে
কেবল বিলালের আযানের সাথে
তুলনা করার ঔদ্ধ্যত্ব দেখালো--


বর্ণাঢ্যসব বরণডালা হাতে রমণীযুগল
আমার আরও নিকটে উপবিষ্ট হয়ে
হীরার চেয়েও জ্বলজ্বল একটি
বর্গাকার পাত্র আমার দিকে বাড়িয়ে
দিলেন--


পাত্রটির ঠিক মাঝপটে গোলাপের
মিহিন পাপড়ির মত একটি বিরল
পদার্থ-


চর্বচোষ্যপানীয় কিংবা লেহ্য নয়
এমন একটি খাবার!
তাঁরা সবিনয়ে আমাকে গ্রহন করতে বললেন--
আমি আমার আশুকরণীয় ঠিক করতে
ব্যর্থ হয়ে
কেবল দুগালে আমতা আমতা করতে
থাকলাম-


আমার বিস্ময়ের তুমল ঘোরকে এক
ঝটকায় অজানায় হারিয়ে দিয়ে
দুজন সুলোচনার একজন
পাত্রটি আমার ওষ্ঠ আর অধরের সাথে
আলতো ঢঙয়ে ঠেকালেন---


নিমেষেই আমার সমগ্র অনুভূতিজুড়ে
এক বিরল সুখের টাইফুন/টর্নেডো
বয়ে গেলো-
মেশকে-জাফরান
কিংবা সুগন্ধি লোবানের স্বাদ-গন্ধতো
আমার চেনাই আছে-
কিন্তু-
পাত্রের সে খাবারকে আমার কাছে
সেরূপ কিছুই মনে হোল না


আমি বেশিক্ষণ চিন্তা করতে পারলাম না
বস্তুটির স্বাদ-গন্ধ আর অবিশ্বাস্য ঝাঁঝে
আমি মূহুর্তেই মূর্ছিত হয়ে পড়লাম-


এরপর কতযুগ কেটে গেছে এরূপ
সুখমূর্ছায়
আমার হিসেব থাকার কথা নই-


মূর্ছা ভাঙতেই
নিজেকে যখন আমি ফিরে পেলাম
তখন
একটি দোদুল্যমান দৈত্যকায় খাটের
ঠিক মাঝখানটায়


কার্পাস আর মখমলের চেয়েও কোমল
রেশমের চেয়েও মিহি
দুধের চেয়েও শাদা
বরফের চেয়েও শীতল
বাতাসের চেয়েও হালকা
কয়েকশোস্তরবিশিষ্ট একটি আচ্ছাদনের নিচে
শায়িত আমি তখনকার কল্পানাতীত
সুখকে
কেবল শৈশবে আমার মায়ের অপত্যস্নেহের সাথেই তুলনা দেয়ার
সৎসাহস দেখালাম--


এর পরের ঘটনার জন্য
রক্তে-মাংসে-চর্বিতে গড়া
কোনো মানুষই প্রস্তুত থাকবার কথা নয়-


একটি ডানাওয়ালা সফেদ ঘোড়ায় চড়ে
আমাদের প্রয়াত আব্বা!
আমার শিয়রের ঠিক দক্ষিণপার্শ্বে এসে দাড়ালেন-


সাথে একজন শোড়শি রমণী-


হোমার চসার এলিয়ট বায়রন
রুমি হাফিজ গালিব খৈয়াম
নজরুল রবি কিংবা জীবনানন্দ


কারো কবিতার চরণেই তার তুলনা করার দুঃসাহস আমি দেখাতে পারবো না-
যদি বলতে হয়
শুধু এটুকুনই বলতে পারি
সে নারী! কোনো হুরপরী নয়
যেন জলজ্যান্ত কামনার কোনো
কামসরোবর
কলকল বইছে আপাদমস্তক তার--
আর;
আমাকে আহবান কোরছে
তার অন্তহীন রূপসাগরের ভেতর--


পাশেই আব্বা
আমাকে শীতল গলায় অপরাধীর মতন আলতো করে বললেন


খোকা ;
বেঁচে থাকতেতো তোর জন্য কোনো
পছন্দই দিতে পারি নি --
বৌ হিসেবে এমন মেয়েরা
তোর পছন্দ হবে কীনা দ্যাখ--


আচমকা আমার জিহ্বার ডগায় একরকম তেতো বিস্বাদ অনুভূত হোতে থাকলো
মাথা-মগজ-চোখ চরকির মত কেমন
ঘুরতে থাকলো-
অথচ-
আমার সামনে থেকে আব্বা আর
তাঁর পছন্দ করা বৌমা
কেউই সরে দাড়ালো না --


কিন্তু--
হঠাতই
আমার চিন্তায়
আমার চেতনায়
আমার স্মরণের সরোবরে ভেসে উঠলো
সতেরশো সাতান্ন সালে
যেসব প্রতিশ্রুতিগুলো আচানক ভেঙে
গিয়েছিলো;


ঠিক একশোবছর পর
কোনো এক বিকেলে এলিনার গা ছুঁয়ে
কসম করে দেয়া
ভালোবাসার প্রতি আমার শেষ প্রতিশ্রুতি--