আমার বিচারধারা রূপ নেয় রাষ্ট্রচিন্তায়,
যেখানে মানুষ নয়, চিন্তাই শাসনের উৎস।
আইনের অক্ষরে যদি ন্যায়ের পংক্তি না বাজে
তবে শৃঙ্খল হয়ে ওঠে প্রতিটি বিধি, প্রতিটি নীতির ব্যঞ্জনা।
আমি বলি, রাষ্ট্র নয় এক পরিশীলিত দানব,
যদি তার হৃদয়ে না থাকে আত্মার বিন্দুমাত্র ন্যায্যতা।

আমার বিচারধারা জেগে ওঠে
শোষণের অন্তঃস্থ চক্রান্ত ভেদ করে—
যেখানে নীতির নামে লুকিয়ে থাকে স্বার্থ,
আর উন্নয়নের সংজ্ঞায় খুঁজে পাই শাসকের মুখচ্ছবি।
আমি খুঁজি এমন এক রাষ্ট্রকে
যার মূল রচনায় থাকবে চিন্তার স্বাধীনতা—
যেখানে প্রশ্ন করাও হবে দেশপ্রেম,
আর প্রতিকূলতা হবে গণতান্ত্রিক শক্তির উৎস।

আমার বিচারধারা বলে—
সমাজ গঠিত নয় কেবল সংস্কার আর আচার বিধির দাস্যে,
বরং গঠিত হয় মানুষের বোধ, তার বিবেক আর আত্মজ্ঞানের আলোয়।
আমি যদি বলি, ‘প্রেম’ রাষ্ট্রের ভিতরেও স্থান পেতে পারে?
প্রেম, যেখানে মানবিকতার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে প্রশাসন,
যেখানে ব্যথার প্রতিধ্বনি শুনে তৈরি হয় নীতি।

আমি জানি, তারা এই কথাও অস্বীকার করবে।
তারা বলবে, ‘রাষ্ট্র চলবে শৃঙ্খলায়, যুক্তিতে, কর্তৃত্বে’।
তাদের অজানা, বিচারের পরমার্থ যুক্তির আগেও জন্মায়
যেখানে যুক্তি নিজেই আত্মবিশ্বাসের এক কাব্য।
আমি চাই এমন রাষ্ট্র,
যেখানে শাসক নিজেই বিচারধারার ছাত্র,
যেখানে আইন নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় জনতার স্বরবোধে।

আমি চাই, সমাজে যদি কেউ একবার প্রশ্ন তোলে—
'কেন এমন হলো?'
তবে সে যেন বন্দি না হয়, নির্বাসিত না হয়,
বরং তার চিন্তা থেকে জন্ম নেয় পরবর্তী সংবিধান,
পরবর্তী অর্থনীতি, পরবর্তী মূল্যবোধ।

আমার বিচারধারা রাষ্ট্রের পাষাণ-ভিত্তিতে ফাটল ধরায়—
সেখানে জন্ম নেয় আলো,
জন্ম নেয় এমন এক শাসন যেখানে শাসক নয়,
চিন্তা হয় সর্বোচ্চ অধিকারী।

আমার বিচারধারা এবার প্রশ্ন তোলে শিক্ষার বেদীতে—
কী শেখে তারা, যাদের পাঠ্য পুস্তকে নেই প্রশ্নের সাহস?
যে শিক্ষা শেখায় মুখস্থ অনুশাসন,
যে শিক্ষক নিজেই শিখে নি নিজস্বতা—
সেই শিক্ষায় সৃষ্টি হয় কেবল কর্মচারী, নয় চিন্তক।

আমি চাই শিক্ষা হোক আত্মার আর কল্পনার যৌথ চর্চা,
যেখানে ছাত্র প্রশ্ন করে ঈশ্বরকেও,
আর উত্তর হয় না নীতির ব্যাখ্যা মাত্র,
বরং হয়ে ওঠে চিন্তার মুক্ত ঝর্ণাধারা।
আমি চাই পাঠ্যপুস্তকে লেখা থাকুক—
"সন্দেহ করো, কারণ সন্দেহই সত্যের প্রথম ধাপ।"

আমার বিচারধারা ঢুকে পড়ে ধর্মের অন্দরে—
যেখানে ঈশ্বরকে ব্যবহার করে মানুষকে দমন করা হয়,
যেখানে আধ্যাত্মিকতা হারিয়ে ফেলে মানবিকতা,
আর লিপির আড়ালে মরে যায় মুক্তি।
আমি প্রশ্ন করি,
ধর্ম কি সত্যিই ভয় শেখায়, না কি ভালোবাসা?

আমি চাই ঈশ্বর থাকুক প্রতিটি চেতনায়—
না যে উপাসনায়, বরং আত্মবিশ্বাসে, সহমর্মিতায়, বিবেকে।
যেখানে মসজিদ-মন্দির নয়, মানুষই হয়ে ওঠে পবিত্র।
আমার বিচারধারা ধর্মকে ফিরিয়ে আনে মানুষের হৃদয়ে,
সেখানে প্রার্থনা হয়— “আমি যেন সত্য বলি, তবু যেন কাউকে আহত না করি।”

প্রযুক্তি আসে, ঝড়ের মতো, আশীর্বাদ ও অভিশাপ একসাথে।
তারা বলে—এটি অগ্রগতি, এটি ভবিষ্যৎ।
আমি বলি— যদি নীতিহীন প্রযুক্তি হয়, তবে তা কেবল নিঃশব্দ যুদ্ধ।
যদি বুদ্ধিমত্তা ছাড়াই বুদ্ধিমান যন্ত্র গড়ে তুলি,
তবে তা নিজেই এক নৈতিক শূন্যতায় আমাদের গ্রাস করবে।

আমি চাই প্রযুক্তি হোক বিবেকের দাস,
না যে ক্ষমতার যন্ত্র, বরং সহানুভূতির বাহক।
চিকিৎসা হোক প্রযুক্তিনির্ভর, কিন্তু যত্ন হোক হৃদয়ভিত্তিক।
কম্পিউটার হোক সহচর, কিন্তু সিদ্ধান্ত হোক মানবিক।

আমার বিচারধারা তখন গড়ে তোলে এক ভবিষ্যৎ নাগরিক সমাজ—
যেখানে পাসপোর্টের চেয়ে মূল্যবান হয় নৈতিকতা,
যেখানে রাষ্ট্রের সীমারেখা পেরিয়ে
মানুষ মানুষকে আপন ভাবে।

সেই সমাজে নেতা হয় জনতার শ্রোতা,
আর আইন হয় প্রশ্নযোগ্য, পরিবর্তনশীল—
যাতে প্রতিটি প্রজন্ম তার নিজস্ব ন্যায়ের সংজ্ঞা রচনা করতে পারে।

আমি জানি, তারা আবারও বলবে—
"এ তো কল্পনা, বাস্তব নয়!"
কিন্তু আমি জানি,
প্রতিটি বাস্তব কল্পনারই সন্তান।

আমার বিচারধারা আমাকে তাড়িত করে,
এই ভবিষ্যৎ গড়ার দায়ে,
যেখানে সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা ও প্রযুক্তি—
সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে একটিই কথা—
“মানবিকতা।”

আমার বিচারধারা যখন রক্তের রঙ ধরে,
তখন জেগে ওঠে ক্ষমতার দুর্গপ্রাচীর।
আমি দেখি, ন্যায়বোধের ছায়া পড়ে বন্দুকের নলের পাশে,
আর সত্য উচ্চারণ মানে হয় রাষ্ট্রদ্রোহ,
সেই সমাজে যেখানে ‘চুপ থাকা’ই একমাত্র জ্ঞান।

আমি যখন বলি,
“তুমি প্রশ্ন করো— কারণ তবেই তুমি নাগরিক”,
তারা বলে, “তুমি বিদ্রোহী— কারণ তুমি প্রশ্ন করেছো!”
তখন আমি বুঝি,
বিচারধারা যতই ন্যায়গর্ভ হোক,
শাসকের কানে তা প্রতিধ্বনি নয়— বরং বিকৃত প্রতিচ্ছবি।

আমার আদর্শ তখন সহ্য করে পুড়িয়ে ফেলার নীতি,
অস্বীকৃত, অপবাদে ভরা—
যে সমাজ গড়ে তুলেছি ভাবনায়,
তাকে ডাকা হয় আজ ‘অবাস্তব’, ‘উদ্ভ্রান্ত’, ‘উন্মাদ’।
তারা কাগজে লেখে— “এই চিন্তা বিপদজনক”,
আর পর্দায় দেখায়— “সুরক্ষার নামে নিঃস্বতা।”

আমি দেখি,
ধর্ম আবার ফিরে আসে রক্তে— ভালোবাসায় নয়,
শিক্ষা আবার তৈরি করে দাস— চিন্তক নয়,
প্রযুক্তি আবার শাসকের হাতিয়ার,
আর মানুষ?
মানুষ হয়ে পড়ে পরিসংখ্যানে পরিণত।

তবু আমি থেমে যাই না।
আমার বিচারধারা নয় কোন দার্শনিক বিলাস,
এ এক আত্মরক্ষার বিদ্রোহ—
যেখানে অস্ত্র নয়, যুক্তিই বিপ্লবের পাথেয়।

তারা আমাকে বন্দি করে ভাবনায়,
নির্বাসন দেয় আমার কণ্ঠস্বরে,
কিন্তু তারা জানে না—
বিচারধারা কখনো একক মানুষের নয়,
যা সত্য, তা বহু হৃদয়ে জন্ম নেয়।
তারা জানে না—
প্রশ্নের আগুন নিভিয়ে রাখা যায়,
কিন্তু একদিন তা অগ্ন্যুৎপাত হবেই।

আমার বিচারধারা তখন হয়ে ওঠে জ্ঞানের গেরিলা,
বিচারে ছদ্মবেশী এক বিপ্লবী—
যে সমাজের অন্তরে ঢুকে
ভিতর থেকে জন্ম দেয় পরিবর্তনের জোয়ার।

আমি জানি, ন্যায় পেতে সময় লাগে—
তবু আমি বয়ে চলি এই অস্থিরতা, এই নিন্দা, এই প্রতিরোধ—
কারণ আমি বিশ্বাস করি:
একদিন—
যখন তারা নিজেরাই ক্লান্ত হবে দমন আর ভয়ের নীতিতে,
তখন তারা নিজেই ডেকেই আনবে আমার চিন্তার সেই রূপরেখা।

সংঘাত পেরিয়ে, অস্বীকৃতি অতিক্রম করে
আমার বিচারধারা দাঁড়ায় ধ্বংসস্তূপের পাশে—
যেখানে একদিন স্বপ্ন ভেঙে পড়েছিল,
আজ সেখানে নতুন ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে।

আমি গড়ি এক রাষ্ট্র—
যার ভিত্তি অস্ত্রে নয়, বিশ্বাসে;
যেখানে আইনের ভাষা কঠোর নয়,
বরং যুক্তিময়, মানবিক, কবির মতো নমনীয়।

সেই রাষ্ট্রে শাসক নয় সর্বজ্ঞানী,
বরং জনতার নির্বাচিত শ্রোতা—
যার কাজ প্রশ্ন শুনে উত্তর খোঁজা,
আর ন্যায়ের মানদণ্ডে নিজেকেই প্রতিনিয়ত বিচার করা।

সেখানে শিক্ষা হয় অন্ধ আনুগত্যের অবসান,
পাঠ্যপুস্তকে লেখা থাকে—
"তুমি ভুল করতে পারো,
কিন্তু নিজের চিন্তা নিজেই নির্মাণ করো।"

প্রতিটি বিদ্যালয় হয় চিন্তার এক গবেষণাগার,
যেখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হয় বিনিময়ের—
জ্ঞান নয়, বোঝাপড়াই হয় কেন্দ্রবিন্দু।

ধর্ম সেখানে নয় বিভাজনের রচনা,
বরং আত্মজিজ্ঞাসার উপলক্ষ।
প্রার্থনা হয়—
“আমাকে দাও এমন মন,
যে বোঝে আরেকজনের দুঃখ না বলে কেঁদে ফেলে।”

প্রযুক্তি সেখানে হয় মানুষের সহচর,
শাসকের গুপ্তচর নয়।
যন্ত্র তৈরি হয় জ্ঞানের জন্য,
না যে নজরদারির জন্য।

অর্থনীতি চলে নৈতিকতার বিনিময়ে,
যেখানে মুদ্রার বদলে মূল্যায়িত হয় শ্রমের সততা,
মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব।

এই সমাজে নাগরিক পরিচয় লেখা থাকে না কার্ডে,
বরং প্রকাশ পায় আচরণে, চিন্তায়, সহযোগিতায়।

সেই সমাজে পত্রিকা নয় চাটুকার,
সাহিত্য হয় দ্রোহের মৌলিক চিত্রকর,
আর কবিতা—
হয় রাষ্ট্রের গোপন আত্মজৈবনিক।

আমি জানি, এ সমাজ ত্রুটিমুক্ত নয়,
কারণ ত্রুটি মানবতার এক অনুসঙ্গ।
তবু, এখানে ত্রুটি ঢেকে রাখা হয় না—
বরং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া হয়।

আমার বিচারধারা তখন আর একার নয়,
সে হয় এক গণতান্ত্রিক আলো—
যেখানে মানুষ নিজের ভিতরেই দেখে সমাজের আয়না।

এমন রাষ্ট্রে আমি বাস করতে চাই না কেবল,
বরং রেখে যেতে চাই এমন বীজ,
যা থেকে জন্ম নেবে শত শত চিন্তক,
যারা শাসক নয়,
আলোকবর্তিকা হয়ে উঠবে আগামীর।

এখন সমাজ গড়া হয়ে গেছে,
রাষ্ট্রের ভিত শক্ত— ন্যায়ের উপর নির্মিত।
তবু, আমি স্থির হতে পারি না।
কারণ আমি জানি,
ন্যায় কখনো চিরস্থায়ী নয়,
তা প্রতিটি প্রজন্মের ভেতর পুনর্গঠিত হয়।

আমার বিচারধারা তখন ফিরে আসে মানুষের ভেতর,
জিজ্ঞাসা করে:
“এই ন্যায়, এই সমাজ—
তোমার অন্তরেও কি তার প্রতিচ্ছবি আছে?”

আমি দেখি,
শাসক সৎ, আইন ন্যায্য, শিক্ষা মুক্ত—
তবু মানুষের হৃদয়ে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ক্লান্তি।
তারা চায় স্থিতি, তবু ভয় পায় দায়িত্ব।
তারা চায় স্বাধীনতা,
তবু ভুলে যায়— স্বাধীনতা মানে নিজের ভুলের দায়ও নিজেই নেওয়া।

সেই সমাজে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন দ্বন্দ্ব—
মানবতার নয়,
বরং অন্তর্জাত স্বস্তি বনাম বিবেকের অস্বস্তি।
আমি দেখি—
মানুষ আর নিপীড়ক নয়,
তবু তারা হয়ে উঠছে নির্লিপ্ত।
তারা সহ্য করে অন্যায়ের ছায়া,
যেহেতু এখন তা আর ছায়ার থেকেও হালকা।

তখন আমি প্রশ্ন করি—
যদি কেউ একদিন সত্য উচ্চারণ করে
কিন্তু সমাজ বলে, “এ তো গুরুত্বহীন!”
তবে সেই ন্যায় আর কতটা মূল্যবান?
যদি কেউ চোখে দেখে বিভ্রান্তি,
তবু সমাজ বলে— “তুমি রঙিন দৃষ্টিতে দেখো”,
তবে সত্য কি হারিয়ে যায়?

আমি বুঝি,
ন্যায় শুধু রাষ্ট্র বা আইনের কাঠামো নয়,
এটি প্রতিটি ব্যক্তির আন্তরিক সততার উপর নির্ভরশীল।

আমার বিচারধারা তখন ফেরে আত্মজিজ্ঞাসায়—
আমি কি সত্যিই ন্যায়ের পক্ষে আছি,
না কি আমি কেবল ন্যায়ের এক কল্পনার ভিতর বসবাস করি?

আমি চাই,
এই সমাজে জন্ম হোক এমন নাগরিকের,
যে কেবল আইন মানে না,
বরং প্রতিনিয়ত নিজেকেই প্রশ্ন করে—
“আমি কী করলাম? আমি কী এড়িয়ে গেলাম?”

আমি চাই,
এই সমাজে কবি হোক চেতনাবন্ধুর মতো,
যে বলে— "ভালো আছি", বলার আগে ভাবো—
"তোমার আশেপাশেও কি কেউ ভালো আছে?"

এভাবে গড়ে ওঠে এক আত্মনিয়ন্ত্রিত সভ্যতা,
যেখানে প্রতিটি বিবেক হয় সংবিধানের একেকটি জীবন্ত ধারা,
আর প্রতিটি মানুষ হয়—
একটি চলমান আদালত, একটি জাগ্রত কবিতা।

আমার বিচারধারা যখন থিতু হয়েছে চেতনাজগতে,
ঠিক তখনই নেমে আসে এক অজানা অন্ধকার।
কোনো যুদ্ধ নেই, নেই বিদ্রোহ, নেই একনায়ক,
তবু সমাজে ছড়িয়ে পড়ে নির্বাকতা, উদাসীনতা, ক্লান্তি।

না কোনো নিষেধাজ্ঞা, না কোনো সেনাবাহিনী,
তবু মানুষ কথা বলে না,
সত্য বলে না— কারণ ভয় নয়, সন্দেহ নয়— অবিশ্বাস জন্মেছে বিশ্বাসেই।

আমি বুঝি,
এই বিপর্যয় বাহ্যিক নয়—
এ এক নৈতিক ক্লান্তির মহামারী।

মানুষ আর যুদ্ধ করে না,
কারণ তারা বিশ্বাস হারিয়েছে পরিবর্তনের শক্তিতে।
তারা আর প্রশ্ন তোলে না,
কারণ তারা ভাবে— “সব প্রশ্নই তো করেছিল পূর্বজনেরা, আর তাতেই কীই বা হয়েছিল?”

বিচারধারার আলো তখন মলিন,
কারণ কেউ আলো চাইছে না—
তারা চাইছে শান্ত ছায়া, যেখানে ভুল আর ঠিক একাকার হয়ে যায়।

আমি দেখি,
পাঠশালায় ছাত্রেরা বই পড়ে,
তবু চিন্তা করে না—
কারণ তারা বলে,
“চিন্তা করা মানেই বোঝা বয়ে বেড়ানো,
আমরা শুধু পাস করতে চাই।”

আমি শুনি,
প্রার্থনায় কণ্ঠ বলে উঠছে,
তবু ঈশ্বর নীরব—
কারণ ঈশ্বর জানেন,
এখানে ডাক নয়,
শুধু আবৃত্তি চলছে।

আমি দেখি,
প্রযুক্তি মানুষের দুঃখ কমিয়ে দেয়,
তবু কেউ হাসে না, কেউ কাঁদেও না—
কারণ অনুভূতির সংজ্ঞা আজ অ্যালগরিদমের মতো নিখুঁত,
তাতে হৃদয়ের অবাধ্যতা নেই।

এটা সেই সমাজ—
যেখানে সব ঠিক আছে,
তাই কিছুই বাঁচে না।

তখন আমার বিচারধারা প্রশ্ন তোলে নিজেকেই—
“তুমি কী গড়েছো?
এই কি সেই আদর্শ?
যেখানে ন্যায়ের ভিতর থেকেও উঠে আসে অবিবেচনার বিষণ্নতা?”

আমি জানি, সময় এসেছে আবার সেই সংঘাতের—
কিন্তু এবার তা বাহিরে নয়,
প্রতিটি ব্যক্তির অন্তরে।

এই বিপর্যয় থেকে মুক্তি পেতে হলে,
তাদের ফিরতে হবে নিজের ভিতরে,
যেখানে বোধের আগুন নিভে গেছে,
সেখানে আবার শ্বাস নিতে হবে নৈতিক সাহসে।

তখন আমি চাই—
জন্ম নিক এক নতুন প্রজন্ম,
যারা বলবে:
“আমরা শুধু উত্তর চাই না—
আমরা আবার প্রশ্ন করতে চাই।”
তারা গড়বে এমন সমাজ,
যেখানে চিন্তাকে আবার বাঁচানো হবে,
যেখানে প্রতিটি নাগরিক হবে অস্থির আত্মার সাহসী সৈনিক।

নীরব সমাজে যখন শব্দেরা হারিয়ে যায়,
যখন চোখে থাকে দৃষ্টি, তবু দৃষ্টিতে থাকে না স্পন্দন—
ঠিক তখনই,
আমি শুনি এক ক্ষীণ আর্তনাদ—
না কোনো বিক্ষোভ, না কোনো ধর্মঘট,
সে এক নিঃশব্দ চিৎকার—
“তোমরা কি বাঁচতে ভুলে গেছো?”

একজন দাঁড়ায় জনতার মাঝখানে—
বিধ্বস্ত মুখ, আগুনহীন চোখ,
তবু তার কণ্ঠে স্পষ্ট আত্মার ক্ষোভ।

সে বলে,
“তোমাদের আইন সুশৃঙ্খল,
তোমাদের শহর নীরব,
তোমাদের মুখে নেই বিদ্বেষ—
তবু আমি কোথাও দেখি না মানুষ!”

সে প্রশ্ন তোলে সেই সমাজকে,
যে গড়েছিল ন্যায়ের ছাঁচে,
তবু ভুলে গিয়েছিল ন্যায়ও খোঁজে হৃদয়ের উষ্ণতা।

সে পুড়িয়ে ফেলে প্রশংসার পদক,
ছিঁড়ে ফেলে পুরস্কৃত বক্তৃতা,
আর দেয়ালে লেখে—
“জাগো, না হলে তোমার ন্যায় একদিন হয়ে যাবে নিস্তব্ধতার নরক।”

সে ছুটে চলে পাঠশালায়,
ছাত্রদের চোখে চোখ রেখে বলে—
“তোমরা উত্তর জানো, কিন্তু প্রশ্ন চেনো না।
তোমরা পরীক্ষা দাও, কিন্তু ভয় করো আত্মপরীক্ষাকে!”

সে যায় ধর্মকেন্দ্রে,
নতমস্তক ভক্তদের বলেঃ
“তোমরা প্রার্থনা করো, তবু ভালোবাসো না।
তোমরা ঈশ্বর চাও, তবু প্রতিবেশীকে চেনো না।”

সে প্রশ্ন তোলে আদালতে—
“আইন কি ন্যায়ের শ্বাস নেয়,
নাকি শ্বাসরোধ করে দায়িত্বের নামে?”

সে প্রশ্ন তোলে কবিকে—
“তোমার কলম কি শুধুই স্মৃতির প্রতিচ্ছবি,
নাকি ভবিষ্যতের বজ্রধ্বনি?”

তার উপস্থিতি হয় অস্থিরতার ছায়া,
যা মৃত নদীতে ঢেলে দেয় পাথরের ঝাঁপ।
তারা ভাবে, আবার কি ভাঙন আসছে?
তারা ভাবে, এই তো শান্তি,
তবু কেউ কেউ চুপিচুপি কান পাতে—
তাদের হৃদয়ে হয় তো
কিছু কিছু ঢেউ জাগে।

সে তখন বলে—
“আমি একা এসেছি না,
আমি এসেছি তোমার সেই অন্তর্জাত স্বর নিয়ে,
যে আজ চুপ, তবু এখনো বেঁচে আছে।
তোমার বিবেক, তোমার প্রতিবাদ, তোমার স্বপ্ন—
আমি শুধু তাদের জাগিয়ে তুলতে এসেছি।”

সেই এক কণ্ঠ—
যে প্রশ্ন তুলেছিল নীরবতার বুকে,
আজ তা হয়ে উঠেছে সহস্র মানুষের হৃদয়স্পন্দন।

আর কোনো শ্লোগান নেই,
কিন্তু প্রতিটি নীরব চোখে জ্বলে উঠছে প্রশ্নের অগ্নিশিখা।
আর কোনো মিছিল নেই,
তবু মানুষের পথচলা এক দিকেই— নিজের অন্তরের দিকে।

এ এক অভিনব আন্দোলন—
যেখানে পোস্টার নয়, উঠে আসছে কবিতা,
যেখানে পতাকা নয়, উড়ছে চিন্তার রঙিন চাদর।

পাঠশালায় ছাত্রেরা প্রথমবার বই বন্ধ করে
শুধু একে অপরের দিকে তাকায়—
জিজ্ঞাসা করে,
“তুমি কেমন ভাবো?”

ধর্মস্থানে প্রার্থনার মাঝে থেমে যায় ভাষা—
আর হৃদয় ফুঁপিয়ে ওঠে এক অকথ্য সত্যে—
"ভক্তি ছাড়া ভালোবাসা নয়,
ভালোবাসা ছাড়া কোনো ভক্তিও পূর্ণ নয়।"

কর্মস্থলে কেউ আর ছুটে চলে না কেবল সাফল্যের দিকে,
বরং তারা প্রথমবার প্রশ্ন তোলে—
"আমি যা করছি, তাতে কার উপকার হচ্ছে?"

কবিরা কবিতা লেখে,
তবু সেসব ছাপা হয় না কাগজে,
ছাপা হয় চোখে, চেতনায়, সিদ্ধান্তে।

এ আন্দোলনে রক্ত ঝরে না,
তবু নীরবতা চূর্ণ হয়।
এখানে শাসকের পতন নয় মূল বিষয়,
বরং নাগরিকের পুনর্জন্ম।

এই আন্দোলনে কেউ কাউকে ঘৃণা করে না,
বরং শত্রু হয়ে উঠে নিজের অবহেলিত অংশ।
লড়াই চলে অভ্যন্তরে—
আর জয়ের মাপকাঠি হয় আত্মোপলব্ধি।

এভাবে আমার বিচারধারা গড়ে তোলে এক জ্ঞানচক্র—
যেখানে সমাজ, ধর্ম, বিজ্ঞান, রাজনীতি—
সবই ঘুরে ফিরে দাঁড়ায় মানবিকতার কেন্দ্রে।

এই আন্দোলনের মুখ নেই,
তবু প্রতিটি মানুষ এর মুখপাত্র।
এই আন্দোলনের পতাকা নেই,
তবু প্রতিটি হৃদয়ই তার বাহক।

এটি সেই আন্দোলন—
যা শুরু হয় একা,
তবু শেষ হয় সমষ্টিগত আত্মবোধে।