বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী।আধুনিক মানুষ মানেই একেকটা নিঃসঙ্গ নির্জন দ্বীপ।মূলত মানুষের সত্ত্বার মাঝেই একাকীত্বের বীজ লুকনো আছে।কখনও কখনও কোলাহল থেকে সরে গিয়ে একা থাকতে সে ভালোবাসে।এটা তার একাকীত্বের একরকম বিলাস।একাকীত্বের মাঝে তিনি তখন নিজেকে অনুভব করতে চান গভীরভাবে।তাই একাকীত্ব মানে পুরোপুরি নিঃসঙ্গতা নয়,কখনও কখনও আমি'র সাথে গভীর সঙ্গ।মানুষের এই অন্তর্মুখী একাকীত্বের বাইরেও বহির্মুখী এক একাকীত্ব আছে যা বাইরে থেকে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া।অন্তর্মুখী একাকীত্বে যদিও বা আছে নিজেকে অনুভবের ও সৃষ্টিশীল কিছু আনন্দ কিন্তু বাইরে থেকে আরোপিত একাকীত্ব প্রচণ্ড হতাশাময় ও মর্মন্তুদ।


মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই শারীরিকভাবে মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।এই থেকে তার একাকীত্বের সূচনা।তারপর বয়সের সাথে সাথে পাওয়া না পাওয়া,মান-অভিমান ইত্যাদির মাধ্যমে তার এই একাকীত্ব নানা মাত্রা পেতে শুরু করে।ক্রমেই তার মনে হতে থাকে তাকে কেউই বুঝে না,এমনকি ঈশ্বরও তার নিতান্ত প্রয়োজনের প্রার্থনায় সাড়া দেন না।সে যখন শিক্ষাজীবনে থাকে অতিরিক্ত সিলেবাসের চাপে সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে।পরিবার,সমাজ,সভ্যতার চাপিয়ে দেওয়া একপ্রকার বাধ্যবাধকতা তার উপর চেপে বসে।সে হয়তো শিল্পী হতে চেয়েছিল বা স্বাধীন ব্যবসায়ী হতে চেয়েছিল কিন্তু পরিবার তাকে প্রতিনিয়ত উপদেশ দিতে থাকে এই হও সেই হও।এভাবে নিজের স্বপ্নের সাথে বাইরের বিরোধে তার এই বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও গাঢ় হয়।


এভাবে ক্রমেই সে একটা ছাঁচে ঢালা মানুষে পরিণত হতে থাকে।তার সকল চিন্তা,সকল অভ্যাস এমনকি তার অসামঞ্জস্যও একটি ফ্রেমের ভেতর বন্দী থাকে।সে আর তখন স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে না।সে যখন স্বাধীনতার কথা বলে তখনও স্বাধীনতা শব্দটিকে কতিপয়ের স্বার্থ উদ্ধারের দলিল হিসেবে দেখতে পায়।এই রকম শিক্ষা পদ্ধতি অতিক্রম করে ব্যক্তি যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করে সেখানেও সে দেখে অতীতের চেয়ে আরও বড় শৃঙখল।আটটা-ছয়টা অফিস আর রাস্তাঘাটের সময় মিলিয়ে তার আর নিজের জন্য কিছু থাকে না।কর্ম থেকে বাসায় ফেরা যেন তার পরবর্তী দিনে আবার কাজ করার চার্জ সঞ্চয়ের জন্যই।এভাবে সে বুঝতে পারে সভ্যতা আসলে তার নিজের প্রয়োজনে তাকে একটি নির্দিষ্ট মাপে তৈরি করেছে,তার অঙ্গগুলির বিকাশ হয়েছে ততটুকুই যতটুকু সভ্যতার প্রয়োজন।এইসব অনুভূতি তাকে  নিক্ষেপ করে নিঃসঙ্গতার এক অন্ধকার গুহায়।আর যদি জীবিকার সন্ধান না পেয়ে বেকারত্ব নামক অভিশাপের মুখোমখি হতে হয় তবে তার কথা আর উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই।


অপরদিকে যারা সমাজের পশ্চাদপদ মানুষ,যারা শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পান না তাদের জীবনেও একাকীত্বের এই বোধ আসে ভিন্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে।জন্ম থেকেই ক্ষুধা ও দারিদ্র‍্যের নিষ্পেষণে তারা পিষ্ট হন।অসুস্থ হলে চিকিৎসা পান না,শীতে উষ্ণ কাপড় পান না,চোখের সামনে নিজের সন্তানদের কঙ্কাল হতে দেখেন।এর ফলে প্রথম থেকেই তারা সমাজের অপেক্ষাকৃত সভ্য মানুষদের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করেন।অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগ সুবিধা পাওয়া উপরের স্তরের মানুষদের তাই তারা সন্দেহের চোখে দেখতে থাকেন ও তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে নিশ্চেষ্ট মনে করেন।


পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে ব্যক্তির এই বিচ্ছিন্নতাবোধ অনেক বেড়ে যায়।তার প্রথম বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় তার নিজের শ্রম থেকে।সে লক্ষ্য করে তার নিজের শ্রমই তার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে,শ্রমের পূর্ণ বিনিময় সে পাচ্ছে না।সে শুধু কোন রকমে মাথা গুজে বাঁচার মত অল্প জীবনোপকরণ পাচ্ছে মাত্র আর পুঁজির বড় অংশ চলে যাচ্ছে পুঁজিপতিদের হাতে।উৎপাদন প্রক্রিয়ার শ্রমবিভাজন বিচ্ছিন্নতা বোধের আরেকটি উপকরণ।এখানে একজন শ্রমিক পূর্ণ একটি আইটেমের শুধু একটি অংশের কাজ করে এবং প্রতিনিয়ত এভাবেই তার এই একঘেয়ে কাজ চলতে থাকে।সে কখনও তার শ্রমে নির্মিত পূর্ণাঙ্গ প্রোডাক্টটি দেখতে পায় না কারণ নানা বিভাগে সমন্বিত হয়ে তা অবশেষে পূর্ণাঙ্গ চেহারা পায়।এভাবে নিজের সৃষ্টিকে দেখতে না পেরে সে সৃষ্টির আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয় ও ক্রমেই নিজেকে এক বৃহৎ যন্ত্রের ক্ষুদ্র অংশ বলে মনে করতে থাকে।ফলে তার ভেতর সৃষ্টি হয় চরম বিচ্ছিন্নতাবোধ ও নিঃসঙ্গতা।


অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্পবিপ্লব দর্শন-বিজ্ঞান-সাহিত্য সব শাখার জন্যই নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।গ্রাম থেকে শত শত মানুষ কাজের জন্য শহরে এসে ঘিঞ্জি অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে থাকে।ফলে সেখানে এক বিরাট মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়।শহুরে মানুষ ক্রমেই প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।চারদিকে সে শুধু দেখে ইট-পাথরের কারবার।কোথাও একখণ্ড সবুজ দেখে নিজেকে প্রশান্ত করবে এরকম উপকরণ খুঁজে পায় না।প্রকৃতি থেকে,পাখির গান থেকে,নদীর কলতান থেকে,বৃষ্টির শব্দ থেকে এই বিচ্ছিন্নতা তাদের ভেতরের নিঃসঙ্গতাকে অত্যন্ত প্রকট করে তোলে এবং ক্রমেই তারা নিজেদের ইট-পাথরের মতো চেতনাহীন জড়বস্তু হিসেবে আবিষ্কার করে।


ভারতবর্ষে বিচ্ছিন্নতাবোধের শুরু হয় বহু বছর আগে থেকেই।বলা যেতে পারে আর্যরা যখন তাদের নতুন ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে ভারতবর্ষে আসে তখন থেকেই।প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু সমাজে বর্ণপ্রথার প্রচলন এই বিচ্ছিন্নতাকে আরও স্থায়ী করে।তারপর নানা সময়ে ভারতবর্ষে নানা বিদেশী শক্তির অনুপ্রবেশ,মুসলিম শাসন ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের মানুষের মনে রাষ্ট্রের প্রতি এক বিবমিষা তৈরি হতে থাকে।ফলে রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে সামাজিকভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ থেকে তারা বাঁচার চেষ্টা করে।এই কারণে ভারতীয় সমাজে রাষ্ট্রব্যবস্থার চেয়ে সমাজ ব্যবস্থা চিরকালই দৃঢ় ছিল।মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ইংরেজ শাসন আমলে ব্রিটিশদের শাসনতান্ত্রিক নানা কড়াকড়ি আরোপ ভারতবর্ষীয় সমাজের সাধারণ মানুষের জীবন জটিল করে তোলে।এভাবে রাষ্ট্র থেকে,ক্ষমতা থেকে,ন্যায় থেকে,স্বাধীনতা থেকে তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবতে শুরু করে।


সভ্যতা যত আধুনিক হতে থাকে মানুষের সাথে মানুষের বন্ধন তত কমতে থাকে।যতটুকু টিকে থাকে নিতান্ত স্বার্থচেতনাই তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করে।পারিবারিক বন্ধন ভেঙে পড়ে।ভালোবাসার চেয়ে জৈবিকতাই বড় হয়ে দেখা দিতে থাকে।আত্মপরিচয় ভুলে নগর সভ্যতার মানুষগুলো একেকটা পোকার মতো জীবন যাপন করতে থাকে।তার এই বিচ্ছিন্নতা কাটাতে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাতদিন পড়ে থাকে,রেস্টুরেন্টে গিয়ে ফাস্টফুড সমেত সেলফি প্রচার করে,কেউ কেউ নানারকম পার্টিতে যায়।এতকিছু করেও আবিষ্কার করে যে সে তার নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারেনি।বিচ্ছিন্নতাবোধ তার ভেতরে জেঁকে বসে।মেট্রোপলিটনের হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে সে নিজেকে একা হিসেবে শনাক্ত করে।


সমাজ থেকে,পরিবার থেকে,নিজের স্বপ্ন ও সত্ত্বা থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন হতে হতে সে সবকিছুর উপর সনাতন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।সবকিছুকেই সে তখন সন্দেহের চোখে দেখতে চায়।কারণ সে দেখেছে সমাজ,পরিবার,রাষ্ট্র কেউ তার সহযোগী নয় বরং সবাই তার উপর বিনিয়োগকৃত পুঁজির ফসল সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত।এভাবে ব্যক্তির মনে ঈশ্বর সম্পর্কেও অবিশ্বাস তৈরি হতে থাকে।তার কাছে মনে হতে থাকে ঈশ্বর থাকলেও তার প্রতি নিদারুণ উদাসীন অথবা তিনি নেই।ঈশ্বর থেকে এই বিচ্ছিন্নতা তার নিঃসঙ্গতাবোধকে সর্ববিস্তৃত ও ঘনায়িত করে তোলে।


মানুষের অন্তর্মুখী,বহির্মুখী এই বিচ্ছিন্নতার সাথে ইদানীং আবার যোগ হয়েছে মহাজাগতিক বিচ্ছিন্নতা।বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে ক্রমেই সে উপলবদ্ধি করেছে যে বিশ্বের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশে সে বাস করে এবং এই বিপুল আয়তন বিশ্বের অল্পকিছুই তার জ্ঞানের আওতাভুক্ত।এটাও আধুনিক মানুষের এক সূক্ষ্ণ বিচ্ছিন্নতাবোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।তাই সে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানতে চায় এবং সেখানে তার স্বজাতির খুঁজে ব্যতিব্যস্ত হয়।যদি কোনদিন মহাবিশ্বের দূর প্রান্তে কোন স্বজাতিকে সে পেয়েও যায় তখন সে কী করবে?হয়তো তার এই হাজার বছরের নিঃসঙ্গতার কথাই বলবে।



সমাজের প্রতি ব্যক্তির অনুভূতি সরাসরি ছায়া ফেলে তার শিল্পচিন্তায়।জীবন ও সমাজ তরঙ্গের সমান্তরালে বা তার সাথে সচেতন বোধজাত বৈপরীত্যে তৈরি হয় এই শৈল্পিক ভাবমণ্ডল।ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন যুগ এলেও,মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা স্বীকৃতি পেলেও ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে ব্যক্তিমানুষ নতুন বিচ্ছিন্নতায় প্রবেশ করে।নগর সভ্যতার উষ্ণশ্বাসে জীর্ণ মানুষজন বাস্তবতায় তাদের সুখোপকরণ খুঁজে না পেয়ে ডুব দেয় অগাধ কল্পনায়।সেখানে সে গভীরভাবে অনুভব করতে থাকে ইন্দ্রিয় ও অতিন্দ্রিয়জাত সব অনুভূতিকে।প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতায় প্রকৃতির প্রতি তার প্রগাঢ় মমতা জেগে ওঠে।ফলে শিল্প-সাহিত্যে রোমাণ্টিকতাবাদের সূচনা হয়।তারা গ্রীক ক্লাসিক্যাল ধারা থেকে বের হয়ে প্রকরণ ও চিন্তা সমস্ত ক্ষেত্রেই এক নতুন শাখার সৃষ্টি করে।ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ 'লিরিক্যাল ব্যালাডস' গড়ে তোলেন।ধীরে ধীরে রোমান্টিকতাবাদ ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্স হয়ে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শিল্পী-সাহিত্যিকগণ প্রাচীন বুর্জোয়া শ্রেণীর মূল্যবোধকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেন।তাদের এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল হতে শুরু করে যে, যেহেতু প্রচলিত মূল্যবোধ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারেনি সেহেতু তা মানব সমাজের অনুপযুক্ত।এই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে যৌক্তিকতা বিরোধী এক শিল্প আন্দোলনের সূচনা হয় যা ডাডাবাদ নামে পরিচিত।মহাযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক বিপর্যয়ে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতাবোধই তাদের এই শিল্প আন্দোলন সৃষ্টিতে প্রেরণা জুগিয়েছিল।এইসব শিল্পীরা নিজেরা দলবদ্ধ হলেও বৃহত্তর সমাজ থেকে তারা ছিলেন চিন্তা ও আদর্শগতভাবে বিচ্ছিন্ন।


ডাডাবাদ থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে একদল শিল্পী-সাহিত্যিক আরও একধপ এগিয়ে বাস্তবতা থেকে নিজেদের মনোযোগ সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে তাকে নিবদ্ধ করলেন অবচেতনের সৌন্দর্যের উপর।তারা ক্রমেই উপলব্ধি করলেন বাস্তবের এই পুনঃপৌনিক ক্লান্ত ও অমানবিক দৃশ্যের চেয়ে অবচেতন অনেক বেশি প্রণোদনাময়।অবচেতনের এই দিশা পেয়েছিলেন তারা তৎকালীন সময়ে ফ্রয়েডের দ্বারা উত্থাপিত অবচেতন বিষয়ক নানা তত্ত্ব থেকে।তারা শিল্পসৃষ্টি করতে গিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে বাস্তবতার বিকৃতিসাধন করতে থাকেন।চিত্রশিল্পীরা বিভিন্ন জন্তুর অদ্ভূত আকৃতির এমনসব ছবি আঁকতে শুরু করেন বাস্তবতা থেকে যার শুধু ধারণা নেওয়া হয়েছে কিন্তু আদতে অঙ্গ সংস্থানের দিক থেকে বাস্তবের সাথে তার কোন মিল নেই।এই শিল্প আন্দোলনের নাম সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ যা এখন পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্য তো বটেই বাংলা সাহিত্যেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।


সাহিত্যের মতো চিত্রশিল্পেও সমাজ বিচ্ছিন্নতার এই প্রভাব পড়তে থাকে নানা ভাবে।প্রকৃতির হুবুহু নির্মাণে আর আনন্দবোধ না করে চিত্রশিল্পীরা আঁকতে থাকেন বস্তু ও দৃশ্যের মানসিক রূপ।বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পিকাসোর হাত ধরে সৃষ্টি হওয়া কিউবিজম হল এরকম একটি ধারা।এটি মূলত বস্তুর বাস্তব চেহারার দিকে না তাকিয়ে দৃষ্টি দেয় তার জ্যামিতিক স্ট্রাকচারের উপর এবং নানাদিকের আলো-ছায়ার অভিঘাতে বস্তুকে দেখতে থাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।ধীরে ধীরে কিউবিজমের প্রভাব ভাস্কর্যে,সিনেমায় ছড়িয়ে পড়ে এবং কবিতাতেও এর কৌশল প্রয়োগ করা হয়।


বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে মানুষের সমস্ত আশা,আদর্শ ও মূল্যবোধ ধ্বসে যায়।ক্রমেই সে নিজেকে নির্বান্ধব বিপন্ন এক জীব হিসেবে শনাক্ত করতে থাকে।তার কাছে মনে হতে থাকে শূন্যেই তার শুরু আর শূন্যেই শেষ।সুতরাং বেঁচে থাকাটা এক অর্থহীন ব্যাপার।এ ধরণের অনুভূতি থেকে নাট্যশিল্পে অ্যাবসার্ড বা উদ্ভট নাটকের সূচনা হয়।জাঁ পল সার্ত্র ও আলবেয়ার কামু এরকম নাটক নির্মাণে নেতৃত্ব দিতে থাকেন।এইসব নাটকে সুপরিকল্পিত মানবিক চরিত্র দুর্লভ,যুক্তির ধারাবাহিকতাহীন এবং পরিণামহীন এক উপসংহার দিয়ে তা শেষ হয়।রাস্তায় দলবদ্ধ জনতাকে ডাক দিয়ে যদি কেউ বলে "শুনেন,আমার আসলে কিছু বলার নেই" তাহলে যে জাতীয় উদ্ভট ব্যাপার সৃষ্টি হবে এই নাটকগুলোর ক্রিয়াকলাপ ছিল এরকম।জীবন ও জগতের প্রতি সুগভীর নৈরাশ্যই এই জাতীয় শিল্পরীতির ছিল প্রধান উপকরণ।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকায় বিট জেনারেশন নামে একটি সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয়।শিল্পের স্বীকৃত মানদণ্ড প্রত্যাখ্যান,নতুন শৈলী নির্মাণ,ড্রাগ পরীক্ষণ,মুক্ত ও বিকৃত যৌনতা,বস্তুবাদ প্রত্যাখ্যান ও প্রাচ্য ধর্মের প্রতি উৎসাহ ছিল এই আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।শিল্প-সাহিত্যে তারা মানবিক অবস্থার স্পষ্ট চিত্রায়ন করতে থাকেন এবং জীবন ও শিল্পের মধ্যেকার ব্যবধানকে ঘুচিয়ে দেন।ফলে শিল্প অনেকটা বাস্তবতার কর্কষ স্বাদযুক্ত হয়।হতাশা ও প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের প্রতি অশ্রদ্ধার কারণে বিট জেনারেশনের সাহিত্যিকরা অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে পড়েন।ফলে প্রশাসন তাদের উপর খড়গহস্ত হয় এবং তাদের অনেককেই জেলে বন্দী করেন।বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গও ছিলেন এই দলের অন্তর্গত।বলা যেতে পারে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে মানবিক মূল্যবোধের ভাঙন ও বিচ্ছিন্নতাই এইজাতীয় সাহিত্য আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রধান কারণ।


সমাজ,রাষ্ট্র,প্রতিষ্ঠান সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এভাবে শিল্পীরা ক্রমেই নিজেদের মানবিক বোধকে হারিয়ে ফেলতে থাকেন।সমাজের প্রতি,মানুষের প্রতি তারা আর দায় অনুভব করেন না।ব্যক্তিগত দুঃখ ও দিনাতিপাতই তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়।ইউরোপীয় সাহিত্যে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।দস্কয়ভস্কি,বোদলেয়ার,কাফকা প্রমুখ লেখকের সাহিত্যে চরমভাবে দেখা যায় সমাজবিচ্ছিন্ন আত্মপীড়িত মানুষের যন্ত্রণা।জগত ও জীবনের সাথে নিজদের ঐক্যসূত্র আবিষ্কার করতে না পেরে তাদের সৃষ্ট চরিত্রগুলো ডুব দিতে থাকে আত্মমগ্নতার গভীর মায়াজালে।তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর বহু আগে শেক্সপিয়রের রচনাতেও তার প্রধান চরিত্রগুলোর মাঝে বিচ্ছিন্নতাবোধ লক্ষ্য করা গেছে।তার সৃষ্ট হ্যামলেট-ম্যাকবেথ-লীয়র সকল চরিত্রেই হীনম্মন্যজাত বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতার আত্মযন্ত্রণা দেখা গেছে।হয়তো সূক্ষ্ণানুভূতি সম্পন্ন সকল মানুষই স্বভাবগতভাবেই এই বিচ্ছিন্নতা দ্বারা আক্রান্ত হন।আধুনিক কালে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া বিচ্ছিন্নতায় তার এই বিচ্ছিন্নতাবোধ আরও গাঢ় হয়েছে।হাজার বছর ধরে সমাজ মানুষকে নানাভাবে পীড়ন করেছে বলেই সাহিত্যে প্রতিবাদী ও বিচ্ছিন্ন প্রত্যয়গত চরিত্রকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়ে থাকে।



বাংলা সাহিত্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ বলতে গেলে তার প্রাচীন নিদর্শন থেকেই পাওয়া যায়।চর্যাপদের আলো-আঁধারি সান্ধ্যভাষা তার বিচ্ছিন্নতাবোধেরই পরিচয় বহন করে।মধ্যযুগের সাহিত্য একান্তভাবে ঈশ্বর বন্দনা ও সাধারণ মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার না পাওয়া ভিন্ন রকমের বিচ্ছিন্নতাবোধকে নির্দেষ করে।শিল্পী ও শিল্পমানস নিঃসঙ্গ বোধ করেছে বলেই হয়তো দলগতভাবে একত্র হয়ে ঈশ্বরবন্দনায় রত হয়েছে।ভুলতে চেয়েছে তার একাকীত্ব,যুক্ত হতে চেয়েছে চির আত্মার সাথে।পুরো মধ্যযুগীয় সাহিত্যে এভাবে ঈশ্বর বন্দনা অথবা বীরধর্মের স্তুতি গেয়ে পারতপক্ষে নিজেদের অসহায়ত্ব ও বিচ্ছিন্নতা ঘুচানোরই চেষ্টা করা হয়েছে।


আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যে বিচ্ছিন্নতার সূচনা হয় মূলত হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিওর দ্বারা প্রভাবিত 'ইয়ং বেঙ্গল' এর প্রথাবিরোধী চিন্তাধারা দ্বারা।'ইয়ং বেঙ্গল' এর সদস্যরা অন্ধভাবে পাশ্চাত্যমুখী ছিল এবং তারা হিন্দু ধর্মের নানান প্রথাকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতো।ফলে সমাজের সাথে তাদের এক সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ জেঁকে বসে।তারা নতুনভাবে সবকিছু চিন্তা করতে চায় এবং তাদের মধ্যে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা লক্ষ্য করা যায়।'ইয়ং বেঙ্গল' গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য প্যারিচাঁদ মিত্রের হাতেই প্রথম বাংলা উপন্যাসের খসড়া 'আলালের ঘরের দুলাল' আত্মপ্রকাশ করে।ধারণা করা হয় 'ইয়ং বেঙ্গল' আন্দোলনই পরবর্তীতে বঙ্কিমচন্দ্র ও মাইকেল মধুসূদনের মতো বড় শক্তির আগমনকে সহজ করে দেয়।


রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ভাবনায় এই নিঃসঙ্গতাবোধ আক্ষরিক অর্থে ধরা দেয়নি।রবীন্দ্রনাথ যেকোন বস্তুকে বিশ্বের সাথে যুক্ত করে তাকে সার্বজনীন দৃষ্টিতে দেখতে চাইতেন।সেই হিসেবে নিজেকেও তিনি জনমানসের সাথে এক সূক্ষ্ণ সুতায় বেধে রাখতে পেরেছিলেন।অন্যদিকে নজরুল ছিলেন সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের মুখপাত্র।সুতরাং বাইরের নিঃসঙ্গতা তাকেও দখল করতে পারেনি।তবে তারা দুজনেই ইংরেজ শাসনের ফলে পরাধীনতার বিচ্ছিন্নতাকে অনুভব করেছিলেন তীব্রভাবে।সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল কবি স্বভাবজাত অন্তর্মুখী নিঃসঙ্গতাও।তাদের সাহিত্যে নিঃসঙ্গতার চেয়ে তাই নিঃসঙ্গতা থেকে উত্তরণের চেষ্টাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।যেখানে মুক্তি অসম্ভব মনে হয়েছে সেখানে আপাত দুঃখবোধকেই দেবতার আসন দিয়ে তাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে।


বাংলা কবিতায় ব্যাপকভাবে নিঃসঙ্গতার চর্চা করেন তিরিশের কবিরা।পঞ্চপাণ্ডবখ্যাত এই পাঁচ কবি তাদের সাহিত্যে নিঃসঙ্গতার সুগভীর ছায়াচিত্র আঁকেন।জীবনানন্দ যখন বলেন "সকল লোকের মাঝে ব’সে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা?" আবার যখন বলেন " দূরে কাছে কেবলি নগর ঘর ভাঙে/গ্রাম পতনের শব্দ হয়" কিংবা "এ বিকেল মানুষ না মাছিদের গুঞ্জরণময়!" তখন একই সাথে তিনি অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী বিচ্ছিন্নতারই প্রকাশ ঘটান।সাহিত্যজীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এই নিঃসঙ্গতার চর্চা করেছেন এবং জলের মতো ঘুরে ঘুরে নিজের সাথে নিজেই কথা বলেছেন।


সুধীন্দ্রনাথের কবিতাতেও সীমাহীন বিচ্ছিন্নতাবোধ লক্ষ্য করা যায়।নগর জীবনের হাজার হাজার মানুষতো তাকে কোন সাহচর্য দিতে পারেইনি বরং জনতাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন "সহে না সহে না আর জনতার জঘন্য মিতালি"। তার এই নিঃসঙ্গতাবোধ তাকে লিখতে বাধ্য করে সেই অবিস্মরণীয় বাণী " বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী" এবং সর্বব্যাপী এই নিঃসঙ্গতা তাকে নিয়ে যায় নাস্তিবাদে।কবির 'প্রশ্ন' কবিতায় তাই শুনা যায় এই আর্তনাদ "ভগবান,ভগবান,রিক্ত নাম তুমি কি কেবলই?/নেই তুমি যথার্থ কি নেই?/তুমি কি সত্যই/আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন?"।স্রষ্টার প্রতি এই সন্দেহ ও অবিশ্বাস তীব্র বিচ্ছিন্নতাবোধ,প্রকৃতি ও প্রেম বিরহেরই কারণ।


বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস ও কবিতায় লক্ষ্য করা যায় নগরজীবনের প্রকৃতিহীন,ঈশ্বরহীন নিস্ফল নিঃসঙ্গতা।তার উপন্যাসের চরিত্রগুলো সামাজিক সব আচার-অনুষ্ঠান থেকে নিজেদের পৃথক করে নিয়ে নিজের বোধেই বিচরণ করতে থাকে।তারা হয়ে উঠে আধুনিক নিঃসঙ্গ মানুষের প্রতিভূ।কবিতায় তিনি এই অনুভূতি থেকেই উচ্চারণ করেন "দিন মোর কর্মের প্রহারে পাংশু,/রাত্রি মোর জ্বলন্ত জাগ্রত স্বপ্নে"।আবার তিনি যখন উচ্চারণ করেন " বুদ্ধি কল্পনা বিস্ময় বাসনা-কিছু আমার নয়,/আমি চির বন্ধ্যা,চির-নিঃসঙ্গ" তখন তার বিচ্ছিন্নতা ও নির্জনতার অঞ্চল খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না।


মার্ক্সবাদী কবি হয়েও বিষ্ণু দে ও  সমর সেনও নাগরিক বিচ্ছিন্নতায় ভুগেছেন।স্বভাবতই এই নাগরিক বিচ্ছিন্নতার আর্তস্বর উঠে এসেছে তাদের কবিতায়।তাই বিষ্ণু দে যখন লিখেন "সেই দিন দেখেছি তোমাকে/কোলাহলে--কুৎসিত এ নগরের ভিড়ে/দুষ্টশ্বাস জনতা আধারে--" তখন প্রস্ফোটিত হয় তার জনতা বিচ্ছিন্নতা ও অন্তর্দহনের সুর।নাগরিক কবি সমর সেনও একইভাবে তিক্ত যন্ত্রসভ্যতার বিষবাষ্পের আচ্ছাদনে।তাই তিনি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেন "মহানগরে এল বিবর্ণ দিন,/তারপর আলকাতরার মতো রাত্রি"। এতটাই সুদূরপ্রসারী তার নিঃসঙ্গতা যে 'একটি বেকার প্রেমিক' কবিতায় সভ্যতার রূঢ়তা প্রকাশ করে শেষ পঙক্তিতে তিনি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেন "আর সমস্ত ক্ষণ রক্তে জ্বলে/বণিক সভ‍্যতার শূন‍্য মরুভূমি"।এই সকল পঙক্তিমালার বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতাবোধ পাঠকের চেতনায় ছড়িয়ে যায় নিমেষেই।


এসবতো গেল বাংলা সাহিত্যের নানা কবি ও ঔপন্যাসিকের ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতাবোধ।এর বাইরে গোষ্ঠীগতভাবে বাংলায় প্রতিষ্ঠানবিরোধী যে সাহিত্যিক আন্দোলন শুরু হয় তা হল হাংরি আন্দোলন।প্র‍তিষ্ঠানবিরোধিতা,রাজনীতি বিরোধিতা ও শিল্পের প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের বিরোধিতা তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।তারা শব্দের আদি ব্যবহারকে ঘুচিয়ে তার নতুন অর্থ প্রয়োগ করতে থাকে,নির্বিচারে ব্রাত্য ও যৌন অনুভূতিজাত শব্দ কবিতায় স্থান দেয়।নিজের পরিপার্শ্ব থেকে নিজেকে বেমানান ও বিচ্ছিন্ন অনুভব করাই এই ধরনের শিল্প আন্দোলনের প্রধান কারণ।উগ্রবাদের কারণে প্রশাসনিকভাবে দমন করা হলে পরবর্তীতে নকশাল আন্দোলনকারীরা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ থেকেও হাংরির এই টোনকে আবার তাদের চেতনায় উজ্জীবিত করতে চেষ্টা করেন।অবশেষে রাজনীতির কড়া হাতুড়িতে পিষ্ট হয়ে তারাও বিলীন হয়ে যান।


এছাড়া দেশভাগজনিত নিঃসঙ্গতা থেকে দুই বাংলাতেই অনেক শিল্পসৃষ্টি হতে থাকে।বাঙালী সংস্কৃতির এই ভাঙন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সহজে মেনে নিতে পারেননি।তাই তাদের গল্প-উপন্যাস-কবিতায় নানাভাবে তা উঠে আসে।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখের রচনায় এ ধরনের সুর বেশ গাঢ়ভাবে লক্ষ্য করা যায়।বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক ও সামাজিক সফলতা না আসায় কবিদের কণ্ঠে তার করুণ সুর ফুটে ওঠে।শামসুর রাহমান,আল মাহমুদ,নির্মলেন্দু গুণ তাদের অন্যতম।সমসাময়িক কালেও এই সামাজিক ও নাগরিক বিচ্ছিন্নতা কবিমানসে বহমান।সমকালের কবি আবু হাসান শাহরিয়ার যখন বলেন "জীবিকাচাতুর্য আছে; প্রেম নেই তোমাদের কাচের শহরে" কিংবা উত্তুঙ্গ সময়ের কাছে প্রশ্ন তুলে যখন উচ্চারণ করেন "নদীর পাশে মানুষ কেন একা" তখন এই অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী নিঃসঙ্গতার চিত্র বুঝতে আমাদের কোন অসুবিধা হয় না।


শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবিরা একধাপ এগিয়ে বিষয়কে এড়িয়ে নির্লিপ্ততাকেই তাদের কবিতার মূল উপজীব্য করেছেন।সমাজ,সভ্যতা ও ইতিহাসের সাথে সম্পূর্ণভাবে শেকড়হীন হয়ে খণ্ডিত আকাশের দিকে,শূন্যের দিকে সমর্পিত হয়েছে তাদের সাহিত্যচিন্তা।তাই তাদের কবিতা গন্তব্যমুখী নয়,তার পরিবর্তে আবর্তনমুখী ও বর্ণবিমুখ।ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের নির্মোহ চর্চা ও ব্যক্তি নির্বাসনের সর্বোচ্চ বিন্দুতে অবস্থানই তাদের এ ধরণের শিল্পচিন্তার কারণ।


শিল্প-সাহিত্য ও ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতাবোধের সাথে সাথে আধুনিক পৃথিবীতে আবার দেখা দিয়েছে জাতিগত,ধর্মগত,ভাষাগত,অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষমতায়নজাত বিচ্ছিন্নতাবোধ।একজাতি আরেক জাতির উপর প্রাধান্য বিস্তার করছে,উপজাতীয় সংস্কৃতিগুলো নিঃশেষিত হচ্ছে,এক ভাষা আরেক ভাষাকে গিলছে,এক সভ্যতা আরেক সভ্যতাকে চোখ রাঙাচ্ছে।সর্বোপরি মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধের অঞ্চল দিন দিন আরও প্রসারিত হচ্ছে ও প্রতিনিয়ত তা নতুন মাত্রা পাচ্ছে।ফলে শিল্প-সাহিত্য ও মানুষের অন্তদর্শনে তার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে।