অনেকেই রাইটিং ব্লকের কথা বলে থাকেন।অনেকেরই মাসের পর মাস লেখা আসে না।যাদের নিয়মিত পাঠাভ্যাস এবং বিস্তীর্ণ জীবন ও প্রকৃতির সাথে পরিচয় আছে তাদের এমনটা হবার কথা নয়।বরং তাদের মনে ও মননে এত কথা ঘুরপাক খায় যে তারা লিখে শেষ করতে পারেন না।তাদের অনেকেই লেখাটাকে গুছিয়ে বের করার অবসর পান না।ফলে কেউ কেউ অনেক চিন্তা হারিয়ে ফেলেন।যাই হোক,রাইটিং ব্লক মূলত পুনরাবৃত্তিমূলক জীবনের প্রভাবে হয়ে থাকে।এরকম হলে জীবনযাত্রায় সামান্য হলেও পরিবর্তন আনুন।নতুন মানুষদের সাথে মিশুন,নতুন জীবনকে জানুন।দূরে না হোক আপনার হাতের কাছেই অনেক মানুষ আপনার অচেনা,অনেক জায়গায় কোনদিনও যাননি শুধু নাম জানেন।সেদিকে ঘুরে আসুন।মানুষের যাপন,প্রকৃতির সাথে তার সংগ্রাম ও সম্পর্ক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করুন।বই পড়ার ক্ষেত্রেও রুচি পরিবর্তন করতে পারেন।ভারী ভারী বই পড়ে ক্লান্ত হয়ে গেলে কিছুদিন রম্যরচনা,ভ্রমণকাহিনী বা ইতিহাস পড়ুন।এসব জীবনের রসবোধ বাড়ায় ও অনুভূতিকে জীবন্ত করে।মন যখন শুকিয়ে যায়,জীবনের প্রতি কৌতূহল হারিয়ে ফেলে তখনই তা অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে।তাকে পিটিয়েও তখন আর কোন কথা বের করা যায় না।


যারা কবিতা লিখেন তারাই মূলত রাইটিং ব্লকের কথা বেশি বলে থাকেন।কবিতা মূলত বুদ্ধিমত্তার ব্যাপার নয়,তাতে মনের বিশেষ অবস্থার ভূমিকাই বেশি।একজন সাধারণ মানুষ যিনি আধুনিক কবিতার সাথে পরিচিত নন,যিনি হয়তো রবীন্দ্র- নজরুল যুগের কাব্যভাষাতেই এখনও দু'চারটি মনের কথা লিখেন,হয়তো তা প্রকাশ করেন বা করেন না,হয়তো তার কাছের মানুষদের শুনিয়েই তৃপ্ত থাকেন,তিনিও সব সময় চাইলেই তার ঐ সাধারণ মানের কবিতাও লিখতে পারেন না।জীবনের কোন ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তার মন যখন খুব গাঢ় হয়ে আসে তখনই তিনি লিখতে পারেন।আকাশে মেঘ জমে কালো হয়ে এলেই মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বৃষ্টি আসে।তাই কবিদের এই মেঘ জমানোর কায়দাটা জানতে হয়।শুধু প্রতিভা বা কবিতা সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান তাকে কবিতা লিখতে সাহায্য করবে তখনই যখন তার কবিতা একটা বিশেষ ভাব নিয়ে মনে আসবে।অনেকেই অবশ্য অভ্যাসবশত শুধু কাঠামো ও শব্দগত কবিতাহীন কবিতা লিখে যান।কবিতার অনেক ফরম্যাট আছে।কবিতার জগতে মোটামুটি বিচরণ থাকলে ও কবিতা লেখায় কারিগরী দক্ষতা থাকলে নির্দিষ্ঠ কাঠামোর ছাঁচে ফেলে এই ধরনের কবিতা দিনের পর দিন লিখে যাওয়া যায় কিন্তু তাতে তার নিজের বা সাহিত্যের বিশেষ উপকার হয় না।বাংলা কবিতা কারিগরীর দিক দিয়ে প্রচুর এগিয়েছে কিন্তু অনুভূতিতে পিছিয়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানের কোন কবিই পাঠক বা সমসাময়িক অন্যান্য কবিদের মনে বড় আকারের প্রভাবসঞ্চারী হয়ে ধরা দেননি।অনুভূতিতে পিছিয়ে যাওয়ার কারণ কবির জীবনাভ্যাস ও বিস্তীর্ণ প্রকৃতি,জীবনের সাথে তার সংযোগ সরু হয়ে যাওয়া।এ বিষয়টি ব্যাপক ব্যাখ্যার দাবী রাখে যা অন্য কোন আলোচনায় ব্যাখ্যা করা যাবে।


বলছিলাম যে কবিদের মনে মেঘ জমানোর কায়দাটা জানতে হয়।এজন্য কবিরা খুব যত্ন করে দুঃখ পুষে থাকেন।কবিরা দুঃখে খুব কাতর হয়ে পড়লেও কোন কবিই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না যিনি দুঃখকে ছুটি দিতে চান।এ যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর 'প্রাগৈতিহাসিক' গল্পের সেই ভিক্ষুকের মত যে চায় না তার ক্ষত সারুক।
কেউ যেন ভাববেন না আমি কবির সাথে ভিক্ষুকের তুলনা করলাম।এজন্য কবিদের জীবন দুঃখের জাদুঘর হয়ে উঠে।কোন শৈশবে কোন বন্ধু কী বলেছিল,কৈশোরে কোন বান্ধবী তার মনের কথা বুঝেনি--বড় হয়েও এসব সে ভুলতে পারে না।তখন "তুই ফেলে এসেছিস কারে/মন মনরে আমার" জাতীয় গানে তার এই অনুভূতিকে সে আরও জটিল ও গাঢ় করে তোলার চেষ্টা করে।এই যে যত্ন করে এত দুঃখ পাওয়া,এর বিনিময়ে দু লাইন লিখতে পারলে কবিরা ব্যথা ভুলে যায়।কবিরা মনের দিক দিয়ে এমনই চিরশিশু।কোন কোন কবি আছে দুঃখ পাবার জন্যই অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পথে জীবনকে নিয়ে যান,কোন পরিণতি নিয়ে ভাবেন না।জীবন তার কাছে একটা এক্সপেরিমেন্ট মাত্র।কোন ফলাফলই তার গন্তব্য নয়।সমাজের সাথে ভেতরে ভেতরে খুব যুক্ত থেকেও কবিরা তাই বাইরের দিক থেকে প্রচণ্ড সমাজ বিচ্ছিন্ন হতে পারেন।তখন তাদেরকে অসামাজিক বলে ভুল হয়।তবে কবিদের তার দুঃখের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি যা বেশিরভাগের থাকে না।ফলে ইতিহাসের অনেক বড় বড় কবি তিমির হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছেন,অস্বাভাবিক জীবন যাপনে স্বাস্থ্যহানী ঘটিয়েছেন,কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছেন।শিল্পী যেমন ছবি আঁকা শেষে তার রঙের টিউবের মুখ বন্ধ করে রাখেন,কবিকেও তেমনি কবিতা ধারণ শেষে তার দুঃখের মুখে ছিপি এঁটে দিতে হয়।নাহলে কবি আমির ছন্নছাড়া জীবন তার ব্যক্তি আমিকে কোণঠাসা করে ফেলে।ফলে সাহিত্য করতে এসে নিজেকে ও চারপাশের মানুষকে খুব বেশি কষ্ট দেওয়া হয়ে যায়।


রাইটিং ব্লক নিয়ে লিখতে গিয়ে কোথায় কোথায় চলে গেলাম।রাইটিং ব্লকে যেহেতু কবিরাই বেশি ভুগে থাকেন আর কবিতা যেহেতু চাইলেই লিখে ফেলার ব্যাপার নয়,তাই কবিদের মাঝে মাঝে অন্য শিল্পমাধ্যমেও সময় কাটানো উচিত।তিনি তার জীবনের টুকটাক স্মৃতিকে সঞ্চয় করে গল্প লিখতে পারেন,না হয় না হল তা উচ্চমানের।যা নিয়ে ভাবছেন সেটা নিয়েই যেকোন আলোচনা লিখতে পারেন।লেখার বিষয়ের তো শেষ নেই।এই যেমন 'লেখা কেন আসে না'--এই বিষয় নিয়েও শেষ পর্যন্ত আমি এটাও তো একটা লেখাই লিখে ফেললাম!এসব লেখালেখি ও বই পড়ার মাঝে মাঝে কবিতার দুই একটি পঙক্তি বা চিত্রকল্প বিদ্যুৎ চমকের মত হঠাৎ মনে উকি দেবে।তখন দেড়ি না করে তৎক্ষণাত তাকে ধরে ফেলতে হবে।দিব্যজ্ঞানের মত পাওয়া সেই দুই-একটি পঙক্তিকে তখন নিজের দক্ষতার গুণে কবিতা করে তোলতে হবে।বক যেমন মাছ ধরার জন্য নিবিড় সাধনায় থাকে,কবিকেও এমনই ধ্যানী ও সুযোগ সন্ধানী হতে হয়।সুযোগ সন্ধানী কথাটা কবিচরিত্রের সাথে বেখাপ্পা শুনালেও প্রফেশনালিজমের গুরুত্ব সব শাখাতেই রয়েছে।বৃক্ষ কোন প্রক্রিয়ায় ও কোথায় কোথায় শেকড় চাড়িয়ে দিয়ে গাছে ফুল ফুটিয়েছে তা বড় কথা নয়।বড় কথা হল সে সে ফুল বা ফল ফলিয়েছে কিনা।যাদি ফলিয়ে থাকে তবে তার সাত খুন মাফ।শোনা যায় জীবনানন্দ তার চারপাশের অনেক বিষয় ও চিত্রকল্প খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাতায় লিখে রাখতেন পরবর্তীতে কবিতায় ব্যবহারের জন্য।অনেক আঞ্চলিক,কথ্য ও অব্যবহৃত শব্দও তিনি একইভাবে সঞ্চয় করতেন নিবিষ্ট সাধনায়।


বর্তমানের কবি ও লেখকেরা অভিযোগ করে থাকেন যে,তারা বই পড়ার অবসর পান না।অনেকেই আবার এক ধরনের বই পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে যান।ফলে তার মনে নতুন কোন ভাবনা বা কৌতূহল সৃষ্টি হয় না।বই পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলে অথবা জীবিকা ক্লান্তিতে বই পড়ার ধৈর্য্য না থাকলে মাঝে মাঝে অডিওবুক শুনতে পারেন।মোবাইলে অডিওবুক ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম নিতে নিতেও তা শুনতে পারবেন।প্রচুর আবৃত্তি,গল্প ও প্রবন্ধপাঠের চ্যানেল আছে ইউটিউবে।ইতিহাস,দর্শনচর্চা ইত্যাদি সকল শাখার জন্যই আলাদা আলাদা চ্যানেল রয়েছে।আপনার প্রয়োজনীয় সব হয়তো সেখানে পাবেন না কিন্তু যা পাবেন সেটাও একেবারে কম নয়।বরং সেসবের বই জোগাড় করাই আপনার পক্ষে বেশি শক্ত।যখন বই পড়ার মত এনার্জি পাবেন তখন আপনার নির্দিষ্ট বইগুলো পড়তে পারেন।
ছোট্ট ও নগরসভ্যতার পোকায় খেয়ে ফেলা সীমাবদ্ধ জীবনে  ক্লান্তির সময়টুকু কীভাবে ফলপ্রসূ করা যায় তার জন্যই অডিওবুকের কথা বললাম।


কোন  একটা চিন্তা মনে আসা মাত্র সেটা ফেসবুকে শেয়ার করা উচিত নয়,অন্তত কবি বা লেখকের পক্ষে তো নয়ই।চেষ্টা করতে হবে সেই চিন্তাকে বিস্তৃত করে কোন লেখায় রূপান্তরিত করে তা প্রকাশ করা যায় কিনা।এজন্য সময় নিতে হবে।নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সব লেখকের জন্যই জরুরি।
সর্বোপরি ফেসবুকিংটা কমিয়ে দিতে পারেন।এটা চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করে ফেলে,এক জায়গায় জমতে দেয় না।দিনের একটি বা দু'টি নির্দিষ্ট অংশে আধঘন্টা-একঘন্টা শুধু ফেসবুকিং করতে পারেন।আর কোনকিছু পড়তে বা লিখতে বসার আগে ভুলেও ফেসবুকে ঢুকবেন না বা কোন স্ট্যাটাস দেবেন না।তাহলে আপনার স্ট্যাটাসে কে কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তার চিন্তা আপনার লেখা বা বই পড়ায় মনোযোগী হতে দেবে না।দেখা যাবে স্ট্যাটাসে কারও মন্তব্যের উত্তর-প্রতিউত্তর দিতে গিয়ে সেদিনের বইপড়া বা লেখালেখি সবই চুকে গেছে।


কেউ কেউ রুচি অনুযায়ী গান শুনতে পারেন।বিশেষ করে লোকসঙ্গীতে মন ডুবাতে পারলে মন আর শুকনো থাকবে না।চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের কবিতায় হারিয়ে যেতে পারেন।ইউটিউবে প্রচুর লিঙ্ক রয়েছে।শুধু আধুনিক কবিতাই পড়তে হবে এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন।আমি বৈষ্ণব পদাবলী,মৈমনসিংহ গীতিকা ও বিহারীলালের কবিতা আবৃত্তি শুনে দারুণ আনন্দ পেয়েছি।ইদানীং ইউটিউবে সার্চ দিয়ে রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতাও শুনছি।উত্তরাধুনিক কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা তাতে কোন বাধা হয়ে আসতে পারেনি।


মনের দরজা জানালা খোলা রাখতে পারলে,জীবনের দিকে জিজ্ঞাসাপূর্ণ সজাগ দৃষ্টি রাখলে আশা করা যায় রাইটিং ব্লক কোন লেখককে দীর্ঘদিন ভোগাতে পারবে না।তবে সামান্য বিরতি স্বাভাবিক,হতে পারে তা নতুন পরিবর্তনের ইঙ্গিত।


(লেখাটি কাউকে পরামর্শ দেওয়া নয়,ভালোবেসে উৎসাহ দেওয়ার তাগিদ থেকে লেখা।টাইপজনিত ভুল মার্জনীয়)