ইষ্টিপত্র

ইষ্টিপত্র
কবি
প্রকাশনী এবং অধ্যায়
সম্পাদক ধীমান
প্রচ্ছদ শিল্পী দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বত্ব বিকাশ দাস
প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০২১
বিক্রয় মূল্য ১৫০

ভূমিকা

বিকাশের ইষ্টিপত্র : মলয় রায়চৌধুরী

এর আগে বিকাশের একটা কবিতার বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছিলুম । কী লিখেছিলুম মনে নেই । মনে না থাকায় ভালোই হয়েছে । এই বইটার কবিতাগুলোর সঙ্গে আগের কবিতাগুলোর মিল বা পার্থক্য খোঁজার দরকার পড়বে না । তবে প্রেম ওকে এখনও ধরে রেখেছে, কবিতার মাধ্যমে আর তার বাইরেও । বিকাশের এই কবিতাগুলো পড়ে যে কথা মাথায় এলো তা হলো যে ওর এই কবিতাগুলো একটা উদ্দীপনা নিয়ে গড়ে উঠেছে । ইষ্টিপত্র বা উইল লেখার সময়ে বিকাশ বৌদ্ধিক, শৈল্পিক, ভাষা-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা অনুশীলনকে শ্রেণিবদ্ধ ও উদ্দেশ্যময় করে তুলতে চেয়েছে । জ্ঞান সম্পর্কে জটিলতা, দ্বন্দ্ব, দ্ব্যর্থতা এবং বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করেছে। কবিতার ভাষা গঠনের চিন্তাভাবনা এবং অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ভাঁড়ার ব্যবহারের উপর জোর দিয়েছে । পঞ্চম কবিতাটা পড়া যাক :

ইষ্টিপত্র- ৫


যেদিন জ্যোৎস্নার আবির শরীরে মাখিয়ে নিলাম

দু’চোখ থেকে ঘুম একটু একটু করে সরতে লাগলো।

অনেক গোছগাছ সত্তেও কিছুতেই ঘুম এলোনা।

অন্ধকার পর্দায় চাঁদ দেখা দিলে

জানলা দরজা বন্ধ করে আকাশ দেখা বন্ধ করে দিলাম।

তবু ঘুম এলো না।

এই ভাবে কেটে গেলো বহুদিন...

শরীরে সংযম ধৈর্য ভাঙতে শুরু করলো।

শরীর বৃদ্ধ হলো।

.

অব্যর্থ টানে

নির্ভয়ে শুয়ে পড়ে নির্ঘুম, জ্যোৎস্না মুড়িয়ে চাঁদের পাশে

বিভ্রম বোঝে না পাপপুণ্য

ভালোবাসা,বয়সের ছোঁয়াছুৎ।


বিকাশের পূর্বসূরিদের কবিতা ধ্রুপদী, বাস্তববাদী এবং রোম্যান্টিক অর্হৎ, যেগুলো সমস্তই বাইরের বিশ্বের সাথে মোকাবেলা করতো, বিকাশ ওর কবিতায় সমকালীন সাহিত্যচিন্তার বিপরীতে চেতনায় আধুনিক জীবনের বিভিন্ন দিককে অন্তর্ভুক্ত করে স্বায়ত্তশাসিত এলাকা গড়ে তুলতে চেয়েছে । ফলে অনেকসময়ে মনে হবে কবিতার গঠন যেন এক ফ্রি-হুইলিং নির্মাণ । এমন এক ভাষা-শরীর যা মূলত ওর নিজের দিকে নির্দেশ করে । নবম কবিতাটা পড়া যাক :

ইষ্টিপত্র – ৯


মিছিমিছি হলেও যাবো তোমার কাছে

ফিরিয়ে দিলেও থাকবো তোমার কাছে।

.

তোমার বিষণ্ণ দিনে

নতজানু হতে হলে আমি হবো

তোমার বিপণ্ণ দিনে

নতজানু হতে হলে আমি হবো

দু’হাত সনির্বন্ধ প্রকাশ্য আলোড়নে।

.

খরা-দুপুর তৃষ্ণা-উপুড়

আকাশ ঢাকা বৃষ্টি-তলায় ভিজবো দু’জন একসঙ্গে।

পাতলে পা নির্বাসন সুদূর

তোমার যাযাবর মন আমার মন একই অন্তরের রঙে।

.

চোখ বুজে থাকা

বিশ্রাম বা মৃত্যুর উপমা নয়।

চোখ খুলে থাকা

জীবন বা বাঁচার তকমা নয়।

তবু আদিঅন্ত বন্ধ-কপাট ভেঙ্গেচুরে

অন্তরে অন্তরে অন্তরীক্ষ জুড়ে তোমাকে ভালবাসবো।


ক্রমাগত কবিতা লেখায় আত্মনিয়োজিত বিকাশের মননে এই অনুভূতি গড়ে উঠে থাকবে যে কবিতা খুব একঘেয়ে, পশ্চাৎমুখী আর সংযত হয়ে গেছে। ষাট ও তার পরবর্তী আন্দোলনগুলোর আভাঁ গার্দ নির্মাণ ক্রমে সম্মানজনক হয়ে উঠেছে, এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে । তারপর এবং তার আগেও প্রকৃতপক্ষে কবিতা রচিত হচ্ছিল সাংবাদিক ও শিক্ষকদের দ্বারা - স্বনির্ভর, সুসংহত এবং বিপরীতমুখী । অবশ্যই সেগুলো ছিল চতুর, তাতে ছিল আকর্ষণীয় ছবি, প্রতীকবাদ এবং কাঠামোগত সাশ্রয় । কিন্তু মজার ব্যাপার সেই কবিতাগুলো প্রথম লাইন থেকেই বেশি অনুমানযোগ্যও ছিল। এই ভ্যাকুয়ামের মধ্যে মাঝেমধ্যে এসেছে র‌্যাডিক্যাল তত্ত্ব, এবং সাহিত্যের বামপন্থী ভাবনা । তেইশতম কবিতাটা পড়া যাক :

ইষ্টিপত্র-২৩


সবকিছু থেকেও কিছুই নেই

যবে থেকে সবটুকু আমার বলে দাবী করেছি

বলেই কি আমার বলতে কিছু নেই?

.

যেখানে তুমি ছিলেনা সেখানে আলো ছিলোনা

গাছের ছায়ায় পরিচিত অরণ্যের আতর ছিলোনা।

.

তবু যথা সময়ের আমার শুভেচ্ছা ভালোবাসা

তোমার কাছে পৌঁছে দিয়েছি অভিমান ঠাসা।

.

আজও দুঃসময় এলে,

তোমার অফুরান অনুভব ভীষণ ভাবে করে কাতর

আমার সারা গায়ে যখন তখন লাগলে প্রখর-জ্বর

তোমার দু’হাতে অবসর শীতল করে আমার ঘর।


বিকাশের কবিতা পড়ার সময়ে ফকনার আর হেমিঙওয়ের বিতর্ক মনে পড়ে যায় । ফকনার বলেছিলেন যে হেমিংওয়ে তাঁর পাঠককে অভিধানের পাতা ওলটাতে পাঠান না । বিকাশের নিজের শব্দ-ভাঁড়ার আছে এবং সম্ভবত হেমিংওয়ের রাস্তাও ধরেছে তবে বিকাশ ওর পাঠকদের বোঝার সুবিধার জন্য মধ্যবর্তী পথ অনুসরণ করেছে। কেউই বলেন না ফকনার ভুল, তবে মনে হয় বিকাশের ব্যক্তিগত ইষ্টিপত্রে লেখার ধাঁচের দুজনের পন্হার মিশেলের দিকে পাঠকদের নিয়ে যায়। এমনকি যখন লেখকরা পথপ্রদর্শক জয়েসের সঙ্গে বেকেটের তুলনা করেন, যিনি কিছু সময়ের জন্য জয়েসের শিষ্য ছিলেন, বেকেটে শব্দের সংজ্ঞা, ভাষা, স্টাইল, স্পষ্টতা ইত্যাদির সরলতার দিকে জয়েসের বিপরীতে এক ধরণের আকর্ষণ দেখতে পাই । বিকাশ কাউকে অভিধানের পাতায় ঝুঁকে পড়তে পাঠায় না, যেমনটা বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত প্রমুখ করেছেন । বিকাশ ওর কবিতায় সচেতনভাবে চেষ্টা করে যে পাঠককে যেন আগের প্রজন্মগুলোর কবিদের কথা না ভাবতে হয় । কথোপকথনের স্টাইলে লেখার বিষয়টি বিকাশের কাছে স্বাভাবিকভাবে আসে। পড়া যাক ছাব্বিশতম কবিতা :

ইষ্টিপত্র-২৬


আমি হাত পেতে তোমার প্রসাদ খেতে আসি রোজ

এ তো আমার পেটের ক্ষুধা জুড়ানো মহা ভুরিভোজ।

.

মানুষের মন্ত্রে তুমি ঈশ্বর নামাঙ্কিত।

মানুষের যত্নে তুমি সংরক্ষিত।

মানুষের আলোতে তুমি আলোকিত।

মানুষের প্রেরণায় তুমি পূজ্যপ্রণীত।

.

যদিও যতটুকু নিঃশ্বাস ততটুকু উচ্ছ্বাস।

অগাধ জলে সোজাসুজি সাঁতরে যাও।

অন্ধ-অন্ধকার হাতড়ে গন্তব্য খুঁজে নাও।

মানুষের বন্ধনে আনন্দের স্পন্দন পাও।

.

প্রতিভার লক্ষণ

জীবনমন্থন

চৈতন্য বিবরণ

ঈশ্বরে ঈশ্বরীয় পুঙ্খানুপুঙ্খ উপমার মায়ার উদাহরণ নয়।

শব্দে শব্দে সাদাপাতা ভরে যাওয়া কবিতার দর্পণ নয় ।

স্বপ্নে একটু গরম ভাত খাওয়া,দর্শন ছাড়া আর কিছু নয়।


বিকাশের কবিতায় আছে এই দ্বন্দ্ব যে বিশ্বের বিশৃঙ্খলার পিছনে একটি নিয়মানুগ প্রণালী রয়েছে, আবার কোনও নিয়মানুগ প্রণালী বিদ্যমান নেই, সুতরাং অন্যের দ্বারা অনুমোদন অযৌক্তিক। বিকাশ কখনওবা মানব অভিজ্ঞতাকে অস্থিতিশীল, অভ্যন্তরীণ বিরোধী, দ্ব্যর্থহীন, অনির্বাচিত, অনির্দিষ্ট, অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন, হিসাবে দেখতে চেয়েচে যার নির্দিষ্ট কোনও বাস্তবতা সম্ভব নয় । অতএব, কবিতা-বিশেষটি এক দ্বন্দ্বমূলক, খণ্ডিত, অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট, অসম্পূর্ণ, অথচ জাগ্রত বিশ্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। যেমন চতুর্থ কবিতা:

ইষ্টিপত্র – ৪


বাড়িঘর সম্পর্ক নামের সঙ্গোপনে

বুকের নিঃশ্বাস প্রাণের অন্তঃকরণে

জীবনযাপন হৃদয়ের আয়োজন

প্রেম-প্রণয় অরণ্যের উন্মোচন

এ’সব ভাঙলে,জলশূন্য ভাঙা কুয়োর অন্ধকার ছায়ায়

জ্যোৎস্না এসে নিরিবিলিতে নিঃসঙ্গতার অসুখ সারায়।


বিকাশের কাছে খণ্ডিতকরণ এবং বিচ্ছিন্নতা ব্যাপারগুলো ট্র্যাজিকমিক নয়। বৈশিষ্ট্যগুলো বিকাশ উদযাপন করে। কবিতাবিশেষ বিভাজন এবং বিকেন্দ্রীকরণকে অস্তিত্বের একমাত্র সম্ভাব্য উপায় হিসাবে বিবেচনা করে এবং এই পরিস্থিতি থেকে পালানোর চেষ্টা করে না। বইয়ের প্রথম কবিতাতেই তা স্পষ্ট :

ইষ্টিপত্র-১



কতটা দুঃখ গিললে জানবো

হৃদয়।

কতটা বুক পুড়লে জানবো

হৃদয়।

.

ফুলের গন্ধ ফুরিয়ে গেলে

বাতাস কি মুখ ঘুরিয়ে নেবে অন্য পথের দিকে?

আকাশ চোখ সরিয়ে নিলে

মাটি কি সুখ কুড়িয়ে নিয়ে যাবেনা ঘরের দিকে?

.

কতটা বিদ্রুপ মাখালে জানবো

হৃদয়।

কতটা নগ্নতা জড়ালে জানবো

হৃদয়।

কতটা ভালোবাসা

রোদ্দুরে রোদ্দুরে গাছ গাছালির গৃহস্থালি জীবনযাপন।

বৃষ্টির বৃষ্টি খেলা হৃদয়পোড়া অন্তঃস্থলে অনন্যনির্বাসন।





উৎসর্গ

অজিতেশ নাগ ও দেবব্রত সান্ন্যাল

কবিতা

এখানে ইষ্টিপত্র বইয়ের ২টি কবিতা পাবেন।

শিরোনাম
মন্তব্য