নবাবী বাংলা তথা ভারতবর্ষের পথে প্রান্তরে, ইটের পাঁজরে কান পাতলে
আজো শোনাযায় ইতিহাসের ফিসফিসানি, যখন মিত্রতা ছিল প্রায় দুঃস্বপ্ন
প্রতি মুহুর্তে হিংসা, অবিশ্বাস, অসহিষ্ণুতা, চক্রান্ত, লোভ দেশের
মানুষকে ভীষণ অন্ধকারে, দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল
বারবার প্রলুব্ধ করেছিল বিদেশী শাসক, লুটেরা, তস্করের দলকে,
যারা দুস্তর পথ অতিক্রম করেও বার বার হানা দিয়েছিল বাংলায়
লুঠ হয়েছিল সম্পদ, নারী, পুরুষ, অত্যাচারীর কৃপানে মাটি হয়েছিল লাল,
তবুও একহতে পারেনি এই উর্বর মাটির ভুমি পুত্রেরা,
রুখে দাঁড়াতে পারেনি অশুভ-শক্তির বিরুদ্ধে, কারণ বিবাদ, অনৈক্য।
গ্রীক, পারস্য, ইরান, তুর্কি, ইউরোপ, মঙ্গোলিয়া থেকে
এসেছিল আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস, তৈমুর, মোগল, হুন প্রভৃতি যুদ্ধবাজ,
লুটেরা যাযাবর, কোটি কোটি মানুষের লহুর ধারায় ভেসে গিয়েছিল এ মাটি
শতকের পর শতক, বিত্ত হারানো, স্বজন হারানো বিলাপে ভারি হয়েছিল বাতাস
এ ভূমি দেখেছিল শবের মিছিল, মানুষ নিঃস্ব হয়েছিল বারবার
এসেছিল ফরাসী, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, সাম্রাজ্য বিস্তারে বনিকের বেশে
সফল হয়েছিল তারাও, দশকের পর দশক, শতক জুড়ে কায়েম করেছিল
উপনিবেশ, এ দেশের ধন সম্পদ লুটে জাহাজ ভিড়িয়েছিল নিজের দেশে।
এ দেশ দীর্ণ হয়েছিল বারবার, লাঞ্ছিত হয়েছিল মানুষ, অসহ্য যন্ত্রনায়
এ মাটি পরিণত হয়েছিল কুচক্রী, লুটেরাদের লাম্পট্যের লীলা ক্ষেত্রে।
বনিকের বেশে এসে কেহ কেহ পত্তন করেছিল নিজ গোষ্ঠীর সাম্রাজ্য
ইতিহাসের পাতায় পাতায় পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় আজো,
বিরোধের অর্থ ছিল বিনাশ, স্বপক্ষে আনার কৌশল ছিল অমিত অত্যাচার,
লাশের মিছিল ছিল বিজয়ীর সেরা উপহার, মোড়কে ধর্মাচার।
একের পতনে অন্যের উথ্যান, চিরদিনের নসিব লিখন – এভাবেই চলে জীবন
নবাবী পিলখানার পরিচালক, ভাগ্যান্বেষণে সপরিবার বাংলায় আগমন
সাহসী; রণনিপুণ; কর্মদক্ষ ও দূরদর্শী পুরুষ সময়ে তাঁর প্রাপ্য পান
নিষ্ঠা ও দক্ষতার স্বীকৃতিতে মির্জা মুহম্মদ আলী খাঁ (আলীবর্দী) বাংলা বিহার
ওড়িষ্যার স্বাধীন নবাবী সিংহাসনে করেছিলেন আরোহণ।
কিন্তু, সময় হাসে নীরবে প্রতিপদে, কখনো নিষ্ঠুর কখনো বা আহ্লাদে
ধর্মনিষ্ঠ ও সচ্চরিত্র, দক্ষ শাসক হয়েও চলে গেলেন আলীবর্দী হৃদরোগে
মাটি পেলেন এই বাংলায়, মুর্শিদাবাদের, খোশবাগে।
দিন আসে দিন যায়, রেখে যায় বহু কীর্তি, উত্থানে, বেদনায়, পতনে
হয়ত ইতিহাস সব জানে অথবা নিরুত্তর থেকে যায় সময়ের প্রয়োজনে
নানার স্নেহধন্য মির্জা মহাম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা পেলেন বাংলার মসনদ
মহলে মহলে ফিসফাস, চক্রান্তে আত্মীয় পরিজন, স্বভাব সুলভ জ্ঞানে
আবেগ, অপরিণত বুদ্ধি কখনো হয়না সহায়ক রাজ কার্য সম্পাদনে
মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার, কাশিমবাজার দূর্গ অবোরোধ, গৃহবিবাদ নিরসনেও
বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কুচক্রী সেনাপতি মানিকচন্দ্রের কারারুদ্ধে
ভীত সন্ত্রস্ত মীরজাফর, রাজবল্লভ, ইয়ার লতিফ মিলিত হয় জগতশেঠের মন্ত্রণাভবনে
শুরু হয় চক্রান্ত, ইংরেজ সাহায্যে কিভাবে সিরাজকে সরিয়ে মীরজাফর বসবে সিংহাসনে
কিছুটা সন্দেহ, খানিক আভাসে ক্রুদ্ধ সিরাজ, বন্দী না করে মীরজাফরকে
শপথ করালেন ধর্মের বেড়া জালে সেনাপতি মীরজাফর কে পবিত্র কোরানে
কিন্তু, শয়তান কি মানে ধর্মের বেড়া ? যেখানে থাকে লোভ, ঈর্ষা, সিংহাসনে !
একটা ভুল, হাজার ভুলের জন্মদাতা, ধর্ম তাকেই চেনে যে তাকে মানে
সিরাজ হয়ত বোঝেনি একথা অপরিণত জ্ঞানের কারণে।
১৭৫৭, ২৩ শে জুন, সকাল ৮ টা, পলাশীর প্রান্তর
সেনাপতি মীর মদনের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ ইংরেজ, বিচলিত ক্লাইভ
অন্যদিকে স্বসৈন্যে নিস্পৃহ দাঁড়িয়ে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভ
বীর বিক্রমে মীরমদন, মোহন লাল, পলাশীর প্রান্তরে মরণ পণ লড়াই
অদৃস্টের পরিহাস, কামানের নল ফেটে গোলার আঘাতে ধরাশায়ী মীরমদন
মীরজাফরের নির্দেশ শিবিরে ফেরার, ক্লাইভের দখলে সিরাজের ছাউনি
বিকেল ৫টা যুদ্ধ শেষ, ডুবে গেল বাংলার শেষ স্বাধীন সূর্য পলাশীর প্রান্তরে।
পারল না মির্জা মোহাম্মদ (সিরাজ-উদ-দৌলা), পারল না বাংলার স্বাধীন
সূর্য কে রক্ষা করতে, মুছে গেল নবাবী ইতিহাস, সামান্য ভুলের কারণে
বন্দী নবাবের শেষ নিঃশ্বাস, ঘাতক মুহম্মদিবেগের নৃশংস ক্রূর তরবারিতে
যদি বুঝত সিরাজ, যদি না সরত পূর্ব সিধ্যান্ত থেকে, যদি বুঝতে পারত
লোভ, লালসা, ক্ষমতার কাছে বিশ্বাস, ধর্ম চিরকাল অসহায় ।
সোনারপুর
২০.০৬.২০১৯